'অংশগ্রহণ তত্ত্ব' এবং বাজার ও সড়ক ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা আনয়ন

আমি মনে করি, প্রতিটি উপজেলা সদরে নয় জন ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগ করা উচিত এবং তাদের মধ্যে ছাত্র হবে চারজন, বাকিরা পুলিশ সদস্য। আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়কের প্রতিটি বাসস্ট্যান্ডে সাত জন ট্রাফিক পুলিশ এবং তাদের মধ্যে তিন জন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। জরিমানা থেকে অর্জিত অর্থ থেকে শিক্ষার্থীদের সম্মানী প্রদান করা হবে। মোট জরিমানার ত্রিশ শতাংশ সম্মানী হিসেবে পাবেন শিক্ষার্থী ও পুলিশ।

প্রকাশ | ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

ড. কে এম আতিকুর রহমান
জ্যাকুলিন লেন তার 'পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি ডেভেলপমেন্ট' বইয়ে লিখেছেন, 'জনসাধারণের অংশগ্রহণ হলো উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সকল পর্যায়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ এবং অবিলম্বে কাজ শুরু করা। ব্যক্তির অনুন্নয়নের মূল কারণগুলো প্রতিরোধ করার একমাত্র উপায় হলো তাদের সমস্ত সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে সক্ষম করা, সমস্ত স্তরে, যা তাদের জীবনকে প্রভাবিত করে।' সমস্যা সমাধান থেকে উন্নয়ন পর্যন্ত আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ বাংলাদেশে কখনোই কার্যকর ছিল না। নীতিনির্ধারক এবং আমলাতন্ত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের সঙ্গে যুক্ত ন্যস্ত গোষ্ঠী দ্বারা এগুলো বাস্তবায়ন করা হয়। ফলে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন কখনোই পুরোপুরি অর্জিত হয়নি, এমনকি জনগণও এর ভালো ফল ভোগ করতে পারেনি। বিভিন্ন সময় আমাদের সামনে অনেক সুযোগ এসেছিল, কিন্তু সবসময় আমরা ফল অর্জনে সফল হতে পারিনি। বাংলাদেশ একটি সভ্য ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের আরেকটি বড় সুযোগ লাভ করেছে। কিন্তু সব ব্যক্তি উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে সমর্থন করতে খুব একমত নয়। তারা জাতীয় স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থেই বেশি ব্যস্ত। বর্তমানে আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা তাদের সংঘবদ্ধতা, লোভ, স্বার্থপরতা এবং সামাজিক অসচেতনতার কারণে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে না। আমি মনে করি, বর্তমানে সামাজিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় 'অংশগ্রহণ তত্ত্ব' অত্যন্ত কার্যকর। শিক্ষার্থীরা শুধু বাংলাদেশেই নয় সারা বিশ্বে বহু বিপস্নব সফল করেছে। জুলাই বিপস্নব-২০২৪ আমাদের ছাত্র-জনতার মস্তিষ্কের সন্তান। অংশগ্রহণ তত্ত্বের অর্থ কী আমরা এই বিপস্নব থেকে দেখতে পারি? আমি মনে করি, শিক্ষার্থীরা যদি এক মাসের মধ্যে বাজার ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত হয় তাহলে তা স্থিতিশীল হবে। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পর শিক্ষার্থীরা বাজার এবং ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নিযুক্ত ছিল এবং সেই মুহূর্তে বেশিরভাগ সেক্টর নিয়ন্ত্রণে ছিল। রাস্তাঘাট, প্রতিষ্ঠান, বাজার সবকিছুই ছিল সুশৃঙ্খল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরই সব মহলে অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। কারণ অসাধু ব্যক্তিরা আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকে অশান্ত করতে সামনের সারিতে এসে দাঁড়ায়। সম্মানিত উপদেষ্টারা অরাজনৈতিক ব্যক্তি এবং অপরাধীরা ভেবেছিল রাজনীতিতে পুনর্বাসনের এটাই সময়। তারা বাজার, রাস্তা, অফিস অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে। জনসাধারণ কিছুটা হতাশ হয়েছিল, কারণ তারা ৫ আগস্টের পরে একটি মানসম্পন্ন জীবন পাওয়ার আশা করেছিল। এই মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ জরুরি কেন? তারা যুবক, তাদের রক্ত পরিষ্কার এবং উত্তপ্ত। তাদের পরিবারের প্রতি ভারী দায়িত্ব নেই, তাই তারা দুর্নীতিগ্রস্ত হয় না। তাদের শক্তি, স্বপ্ন, কঠোর পরিশ্রমী মানসিকতা এবং দেশপ্রেম রয়েছে, যা তাদের ইতিবাচক কর্মকান্ডে উদ্বুদ্ধ করে। অনেকে বলছেন, যানজট নিয়ন্ত্রণ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতা ও ধারণা তাদের নেই। তাই তারা এটা করতে পারবে না, বরং তারা সেখানে নৈরাজ্য ও স্বৈরাচার সৃষ্টি করবে। কিন্তু এটা প্রমাণিত যে, তারা সর্বত্র সফল। কারণ তাদের শক্তি, ইচ্ছা এবং উদ্যোগ যথেষ্ট সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি অভিজ্ঞ প্রশাসন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ। কারণ তাদের মধ্যে লোভ ও স্বার্থপরতা আছে এবং তাদের দেশপ্রেম নেই। এইভাবে তারা তাদের ইচ্ছাশক্তি, দেশপ্রেম, শক্তি এবং সহনশীলতা হারায়। তাই এখানে অভিজ্ঞতা কম গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি উপজেলার জন্য একটি বাজার মনিটরিং টিম গঠন করা যেতে পারে। ছাত্র-জনতাকে নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হবে। টিমের সদস্য হবেন দুই জন সরকারি কর্মকর্তাসহ সাত জন। জরিমানা আদায়ের ২৫ শতাংশ টাকা তারা পাবেন। প্রতিটি উপজেলায় দুটি 'সস্তা বাজার' চালু হতে পারে। শিক্ষার্থীরা খন্ডকালীন ভিত্তিতে এসব বাজার পরিচালনা করবে। স্থানীয় প্রশাসন তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করবে। শিক্ষার্থী সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে কৃষি সামগ্রী কিনবে এবং সরকারি মূল্যে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করবে। বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা কৃতিত্বের পুরস্কার (সার্টিফিকেশন) পাবে, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য কাজ করবে। সেরা অর্জনকারী শিক্ষার্থীরা একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে এই সেক্টরগুলোতে স্থায়ী হয়ে যাবে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর স্থানীয় প্রশাসন ও অভিজাত শ্রেণির লোকদের পৃষ্ঠপোষকতায় 'সস্তা বাজার' স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। আমার জানা মতে, প্রতিটি সরকারি অফিসেই কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংকট রয়েছে। প্রতিটি অফিস ইউনিট প্রয়োজন অনুযায়ী ২ জন ইন্টার্ন নিয়োগ করতে পারে। যে ছাত্রদের এইচএসসি এবং স্নাতক ডিগ্রি আছে এবং ২০২৪ সালের গণ-অভু্যত্থানকে সমর্থন করে, তারা ইন্টার্ন হিসাবে নিয়োগ পেতে পারে। ফিল্ড অফিস নিজেই রাষ্ট্রীয় নীতি অনুসরণ করে ছাত্রদের নিয়োগ করবে। জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ না করে সংশ্লিষ্ট দপ্তর তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ইন্টার্নদের বেতন বা ভাতা বহন করবে। আমার অভিজ্ঞতা বলছে, সব ফিল্ড অফিসের জন্যই সেটা করা সম্ভব। অন্যান্য খরচ কিছুটা কমিয়ে তা করা সম্ভব। নিয়োগপ্রাপ্তরা হবে অস্থায়ী এবং ৩ বছরের জন্য। আলোচনা ও নিয়ম অনুযায়ী তাদের ভাতা ১০ থেকে ১৮ হাজার টাকা হতে পারে। বেকারত্ব নিরসন, দক্ষতা উন্নয়ন এবং শহীদদের রক্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে 'নতুন বাংলাদেশ' পুনর্গঠনে এই ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে। প্রয়োজনীয় এবং কর্মক্ষমতা হিসাবে তারা ভবিষ্যতে স্থায়ীভাবে নিয়োগ বা অপসারণ হতে পারে। নিয়োগপ্রাপ্তরা যে কোনো সময় ইন্টার্নশিপ ছেড়ে যেতে পারেন। যানজট আমাদের দেশে একটি গুরুতর সমস্যা এবং বর্তমানে এটি ঢাকা শহর এবং আশপাশের এলাকায়ও বিরাজ করছে। বিশেষভাবে অগণিত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা উদ্বেগকে আরও তীব্র করেছে। এ ছাড়া যানজট নিয়ন্ত্রণ ও সড়ক ব্যবস্থাপনায় ট্রাফিক পুলিশ সড়কে থাকলেও দায়িত্ব পালনে তৎপর নয়। কারণ পূর্ববর্তী সময়ে তাদের অপকর্মের কারণে তারা হতাশাগ্রস্ত। তারা মামলা ও কারাভোগের ভয়ে ভীত। এমনকি তারা অবৈধ অর্থ উপার্জন করতে পারে না এবং দায়িত্বও পালন করে না। ফলস্বরূপ, ঢাকা শহর ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পরে যানজটের সম্মুখীন হয় এবং এটি পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্র বলেও মনে হয়। সম্প্রতি সরকার ট্রাফিক পুলিশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা হবে তিন শত। আমি মনে করি, ছাত্রদের ব্যাপকভাবে নিয়োগ করা উচিত যাতে পুলিশ চাকরি হারানোর ভয়ে দায়িত্বশীল হতে পারে। আমি মনে করি, প্রতিটি উপজেলা সদরে নয় জন ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগ করা উচিত এবং তাদের মধ্যে ছাত্র হবে চারজন, বাকিরা পুলিশ সদস্য। আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়কের প্রতিটি বাসস্ট্যান্ডে সাত জন ট্রাফিক পুলিশ এবং তাদের মধ্যে তিন জন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। জরিমানা থেকে অর্জিত অর্থ থেকে শিক্ষার্থীদের সম্মানী প্রদান করা হবে। মোট জরিমানার ত্রিশ শতাংশ সম্মানী হিসেবে পাবেন শিক্ষার্থী ও পুলিশ। এছাড়া সমস্ত রাস্তার মোড়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য বারোজন পুলিশ সদস্য থাকতে হবে। এর মধ্যে শিক্ষার্থী হবে পাঁচজন। সব শিক্ষার্থী পুলিশ সদস্যদের অধীনে দায়িত্ব পালন করবে। এই মডেলের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও জনসাধারণের চাপে পুলিশ বাহিনী আরও দায়িত্বশীল হবে। শহীদদের রক্তস্নাতকে স্মরণ করে নতুন বাংলাদেশ গড়তে এই মুহূর্তে অন্যান্য সেক্টরেও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত প্রয়োজন। ড. কে এম আতিকুর রহমান : কলাম লেখক