বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কেমন?
ভারত একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি হয়ে উঠলেও অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র যেমন: পাকিস্তান, চীন, নেপাল, মালদ্বীপের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষমতাশীল দল ক্ষমতায় থাকার লোভে তাদের অনুগত হয়ে থেকেছে এবং ভারতের সব ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। অথচ ভারত বন্ধুত্বের নাম দিয়ে আমাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী আচরণ করেছে।
প্রকাশ | ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
নাজমুল ইসলাম জোবায়ের
ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়ায় ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কেমন হবে? এ প্রশ্ন বরাবরই বাংলাদেশের রাজনীতিতে চলে আসছে! স্বাধীনতার পরই একটি মহল এ দেশের মানুষকে ভারতপ্রেমিক বানানোর জন্য কাজ শুরু করে। কখনো ভারতের সাফাই গেয়ে আবার কখনো ভারতপ্রেমকে বাংলাদেশের জনগণের জন্য বাধ্যতামূলক করে।
হায়দার আকবর খান রনো, 'শতাব্দী পেরিয়ে' বইয়ে বলেন, স্বাধীনতার পরে পত্রিকার ডিক্লারেশন নিতে হলে একটা শর্ত মানতে হতো- তা হলো, বন্ধু দেশ (তথা ভারতের) বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না।
২০০৯ সালে হাসিনা ক্ষমতায় আশার পরে ভারতপ্রেমকে রীতিমতো এ দেশের জনগণের জন্য ফরজ করে দেওয়া হয়। ভারত বিরোধিতাকে স্বদেশ বিরোধিতা হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। এমনকি যারা ভারতের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাচেতনার বিরোধী সরব হয়েছে তাদের দেশীয় অপশক্তি, পাকিস্তানের প্রেতাত্মা ইত্যাদি ট্যাগ লাগিয়ে গুম খুন ও হত্যা করা হয়।
জোর করে চাপিয়ে দেওয়া এই ভারতপ্রেমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রশ্ন করা উচিত ভারত কী আসলেই আমাদের বন্ধু?
ভারত আমাদের বন্ধু নাকি শত্রম্ন? এটি বুঝতে হলে আমাদের আগে ফিরে যেতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে। কারণ, বছরের পর বছর ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার বলে এসেছে, ভারতের সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, আত্মার সম্পর্ক! আর এ সব সম্পর্কের কারণ হচ্ছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ!
এজন্য আমাদের জানা প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কি ছিল? ভারত কেন বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিল? এবং হাল আমলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক কেমন?
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পর থেকেই পাকিস্তানকে দুর্বল ও অস্থিতিশীল করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নেয় ভারত। এজন্য তারা একটি নীতি অনুসরণ করে তা হলো- শত্রম্নর শত্রম্ন আমার বন্ধু। এ নীতির ভিত্তিতে টার্গেট করা হয় পূর্ব পাকিস্তানকে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানকে দুর্বল করে রাখা এবং পূর্ব পাকিস্তানের ওপর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে পাকিস্তানকে হুমকিতে রাখা এবং বিভিন্ন সুবিধা আদায় করা।
এজন্য শেখ মুজিবসহ অনেক নেতারা ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে গোপনে মিটিং করতেন। ফলে, পাকিস্তান যে কিছু বাংলাদেশির বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেছিল তা পরিপূর্ণ অসত্য ছিল না। অর্থাৎ বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে তখন ভারত এসে নিজের স্বার্থ হাসিলে পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রেখেছে।
কিন্তু একপর্যায়ে এসে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে- যা ছিল ভারতের প্রত্যাশার বাইরে। এ পর্যায়ে এসে তারা নতুন দু'টি পস্ন্যান হাতে নেয় : ১. বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন অঙ্গরাজ্য বানানো। ২. দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা এবং নিজেদের অনুগত শাসক ক্ষমতায় বসিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাতিয়ে নেওয়া।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা 'র' মুক্তিযোদ্ধাদের ২ ভাগে ভাগ করে ফেলে, তার মধ্যে এক অংশ প্রবাসী সরকার দ্বারা পরিচালিত হতো। তাদের নেতৃত্বে ছিল তাজউদ্দীন আহমেদ, নজরুল ইসলাম। আর আরেকটি অংশ মুজিব বাহিনী যারা সরাসরি 'র'-এর মাধ্যমে ট্রেনিং প্রাপ্ত হতো। এরা প্রবাসী সরকারের কোনো আদেশ মান্য করত না। এরা 'র'-এর কথা অনুযায়ী বিভিন্ন গোপন মিশন পরিচালনা করত এমনকি তারা 'র'-এর স্বার্থবিরোধী মুক্তিবাহিনীর সদস্যদেরও হত্যা করত। তাজউদ্দীন আহমেদসহ অন্য নেতারা তাদের কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন। একপর্যায়ে তিনি ভারত সরকারের কাছে এ ধরনের কর্মকান্ডের জবাব চান, কিন্তু ভারত সরকার তাতে চুপ থাকে। প্রবাসী সরকার নিরুপায় হওয়ার কারণে তারাও এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি।
ভারতের পরিকল্পনা ছিল প্রবাসী সরকারের মাধ্যমে পস্ন্যানে তথা স্বাধীন অঙ্গরাজ্য বানানোর জন্য চেষ্টা চালাবে। এজন্য তারা প্রবাসী সরকারকে একটি গোপন চুক্তি করতে বাধ্য করে। যে চুক্তিতে ছিল : বাংলাদেশের নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকবে না, ভারতের সেনাবাহিনী বাংলাদেশে অবস্থান করবে। যে কোনো ধরনের পররাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নিতে হলে আগে ভারতের কাছে অনুমতি নিতে হবে- ইত্যাদি। প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে নজরুল ইসলাম এটিতে স্বাক্ষর করেন এবং এ চুক্তির ভয়াবহতা বুঝে তিনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলে বাংলাদেশ সরকার এ চুক্তি থেকে সরে যায় এবং আন্তর্জাতিক কারণে ভারতও এটি থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। একপর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের চাপে ভারত তার সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নেয়।
প্রথম পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে 'র'-এর হাতে থাকা মুজিব বাহিনীর মাধ্যমে এবার তারা পস্ন্যান বি বাস্তবায়ন শুরু করে। আর তা হচ্ছে, বাংলাদেশেকে অস্থিতিশীল করা এবং নিজেদের অনুগত শাসক ক্ষমতায় বসিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাতিয়ে নেওয়া। এ পরিকল্পনার প্রাথমিক অংশীদার ছিল শেখ মুজিব ও জাসদ এবং তা পরিপূর্ণতা দান করে শেখ হাসিনা।
ফলে, স্বাধীনতার সময় ভারত বন্ধু হিসেবে আমাদের সাহায্য করেছে এটি সত্য নয়, বরং তারা তাদের নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্যই সাহায্য করেছিল। তবে এটি সত্য যে যুদ্ধের সময় তাদের থেকে আমরাও লাভবান হয়েছি। ফলে, এখানে কেউ কারও কাছে দায়বদ্ধ নয়, কারণ এ যুদ্ধে দুই পক্ষেরই উইন উইন সিচুয়েশন ছিল!
ভারত যে তার নিজের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ভারতের কর্মকান্ড এবং বাংলাদেশকে নিয়ে তার পররাষ্ট্রনীতির দিকে লক্ষ্য করলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্রথমত, বাংলাদেশে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক নদীর সংখ্যা ৫৮টি। এর মধ্যে ৫৫টি নদীর উৎপত্তি স্থল ভারত থেকে। তার মধ্যে ৫৪টি নদীতেই বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রেখেছে ভারত। এতে করে আমাদের নদীগুলো মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীগুলো আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে চিহ্নিত। এসব নদীর উজানে কিছু করতে হলে আন্তর্জাতিক আইন মেনেই করতে হবে। কিন্তু ভারত এ আইনের কোনো তোয়াক্কাই করছে না।
বিশেষজ্ঞদের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের সার্বিক ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তখন থেকে আজ অবধি প্রতি বছর প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
আবার আমাদের যখন পানির প্রয়োজন নেই তখন পানি ছেড়ে দিয়ে প্রতি বছর লাখো পরিবারকে বন্যাতে ভাসিয়ে দেয়, এর মাধ্যমে তারা আনন্দ উপভোগ করে।
দ্বিতীয়ত, ভারত কখনো চায়নি বাংলাদেশ একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশে পরিণত হোক। স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত বাংলাদেশের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে শুধু নিজের স্বার্থ উদ্ধারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে আসছে। এজন্য নিজেদের অনুগত রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে সব ধরনের স্বার্থ উদ্ধার করেছে। এমনকি বছরের পর বছর একটি স্বৈরাচারী দলকে সমর্থন করে পুরো বাংলাদেশের মানুষকে পদানত করার চেষ্টা করেছে।
গত পনেরো বছরে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে কে বসবে, কার প্রমোশন হবে, কাকে সরিয়ে দিতে হবে এগুলো নির্ধারণ হতো দিলিস্ন থেকে। সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে সেনাবাহিনীসহ ডিফেন্সের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতেও নিয়োগ দেওয়া হতো ভারতের ইচ্ছা অনুযায়ী।
প্রণব মুখার্জী তার বইয়ে বলেন : ২০০৮ সালে সেনাপ্রধান আমার কাছে আসেন এবং আমার কাছে প্রত্যাশা করেন যাতে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আশার পরে তাকে তার পদে বহাল রাখা হয় এবং এ ব্যাপারে আমি তাকে নিশ্চয়তা দেই। পরবর্তী সময়ে ভারতের ইচ্ছা অনুযায়ী মঈন খানকে সেনাপ্রধানের পদে বহাল রাখে শেখ হাসিনা।
তৃতীয়ত, ভারত একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি হয়ে উঠলেও অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র যেমন: পাকিস্তান, চীন, নেপাল, মালদ্বীপের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষমতাশীল দল ক্ষমতায় থাকার লোভে তাদের অনুগত হয়ে থেকেছে এবং ভারতের সব ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। অথচ ভারত বন্ধুত্বের নাম দিয়ে আমাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী আচরণ করেছে।
যেমন সীমান্ত হত্যার দিকে নজর দিলেই এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। দ্যা বিজনেস স্টান্ডার-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক সীমান্ত হিসেবে উলেস্নখ করা হয়েছে। সংরক্ষিত হিসাবেই গত এক দশকে এই সীমানায় ১,০০০ বাংলাদেশি নিহত হন। অথচ পাকিস্তান, চীন সীমান্তে এটা কল্পনা করা তো দূরের কথা প্রতিনিয়ত ভারত মার খেয়ে ফিরে আসে।
তারপরও শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ খুবই গর্বের সঙ্গে বলত ভারত আমাদের প্রকৃত বন্ধু রাষ্ট্র!
বিশ্লেষকদের অনেকে বলেন, ভারত বাংলাদেশের নয় বরং আওয়ামী লীগের বন্ধু। কারণ, স্বৈরাচারী হাসিনা ছাত্র-জনতার বিপস্নবে মুখে পালিয়ে গেলে দিলিস্ন তাকে আশ্রয় দিয়ে বন্ধুত্বের প্রমাণ দিয়েছে।
প্রতিবেশী হিসেবে ভারতকে তার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি বাদ দিয়ে এ দেশের সাধারণ জনগণের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। বাংলাদেশের প্রাপ্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। এতে করে উভয় দেশই লাভবান হবে।
নাজমুল ইসলাম জোবায়ের : কলাম লেখক