জয়ের ধারা অক্ষুণ্ন থাকুক বিশ্বকাপে

ব্যাটিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে বোলিংয়েও বাংলাদেশ যথেষ্ট শক্তিশালী। মাশরাফির সঙ্গে মোস্তাফিজ দারুণ এক কম্বিনেশন। যে কোনো সময় বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের আতঙ্ক হয়ে দেখা দিতে পারেন তারা।

প্রকাশ | ২৩ মে ২০১৯, ০০:০০

অলোক আচার্য
প্রথমবারের মতো ত্রিদেশীয় ক্রিকেট সিরিজে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বিশ্বকাপের দ্বারপ্রান্তে এই সাফল্য সত্যিকার অর্থে বিরাট অর্জন। এটা যেমন ক্রিকেটারদের মনোবল চাঙা করবে পাশাপাশি দলের দিকে তাকিয়ে থাকা দেশ-বিদেশের কোটি কোটি ক্রিকেট ভক্তকেও উজ্জীবিত করবে। ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশ এখন পরাশক্তি। অথচ পিছনে ফিরে তাকালে খুব বেশিদিন বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া, প্রথম টেস্টে ভারতের সঙ্গে খেলা। প্রথম টেস্টেই দারুণ খেলার অভিজ্ঞতা। এসব যেন সেদিনের কথা। তবে সময় ঠিকই চলে গেছে অনেকটা। ক্রিকেট আজ অন্য উচ্চতায়। এখন যোগ হয়েছে টি-টুয়েন্টি নামের আলাদা একটি ফরম্যাট। অথচ তখন উত্তেজনা বলতে ওয়ানডে ম্যাচ আর টেস্ট দেখাতেও ছিল ব্যাপক আগ্রহ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেটের অনেক আইনেও এসেছে নতুনত্ব। এখন বাংলাদেশ নতুন এক শক্তি। প্রতিটি দেশ এখন বাংলাদেশের সঙ্গে খেলার আগে পরিকল্পনা সাজায়। বিশেষ বিশেষ খেলোয়াড়কে নিয়ে আলাদা কাজ করে। যেমনটা একসময় বিশ্বের বড় বড় খেলোয়াড়দের নিয়ে হয়েছে। ভালো কোনো বোলার থাকলে প্রতিপক্ষ সেই বোলারকে সামলাতে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা করবেই। বাংলাদেশেও আছে বৈচিত্র্যময় বোলার। যারা প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে বেকায়দায় ফেলতে পটু। বিশ্বকাপের জার্সি থেকে দল নির্বাচন পর্যন্ত ছোটখাটো একটা বিতর্ক লেগে ছিল। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে এমন একটা জোরালো প্রস্তুতি সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। এখন আমাদের ক্রিকেটীয় সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার কেউ নেই। এটাই বাংলাদেশ। গতবিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলেই বাংলাদেশ প্রমাণ করেছিল বিশ্ব ক্রিকেটে পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এরপর থেকে আর কেউ ছোট দল বলে অবহেলার কাতারে ফেলতে পারবে না বাংলাদেশকে। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছিল তখনো অনেক বড় বড় বিশেষজ্ঞই এই সাফল্যকে হঠাৎ জ্বলে ওঠা বলে ভুল করেছিল। আমরা যে একসময় ক্রিকেট বিশ্বে রাজত্ব করতে পারি তা যেন অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। একের পর এক সাফল্য বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের দক্ষতারই প্রমাণ রাখে। অবশ্য কয়েকবছর আগে থেকেই বাংলাদেশ বড় বড় সাফল্য পেতে শুরু করেছিল। বাকি ছিল শুধু ধারাবাহিকতা। এবং বড় দলগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সক্ষমতা। বাস্তবিকপক্ষে বাংলাদেশের কাছে এখন বড় দল, ছোট দল, আলাদা করার দরকারই নেই। কারণ যে কোনো দলের সঙ্গে যে কোনো কন্ডিশনে খেলার যোগ্যতা বাংলাদেশের আছে। আমাদের জাতীয় দলে অনেকদিন ধরেই কয়েকজন বিশ্বমানের খেলোয়াড় রয়েছে যারা যে কোনো পরিস্থিতিতে খেলার হাল ধরতে সক্ষম। তারা ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলছেন। বাইরের দেশ তাদের সমীহ করেই চলে। আমাদের রয়েছে সাকিব আল হাসানের মতো বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। যাকে পেয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম সত্যিকার অর্থেই ভাগ্যবান। সাকিব নিয়মিতভাবেই ভালো খেলে চলেছে। তার ধারাবাহিকতা সত্যিকার অর্থেই অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সে কাউন্টি ক্রিকেটসহ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আইপিএল খেলেছে। এতে তার বিশ্বের উঁচু মানের খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলার সুযোগ ঘটছে এবং তার দক্ষতা ক্রমেই বাড়ছে। যার ফল আমরা খেলার ফলাফলে পাচ্ছি। ওপেনিং জুটিতে তামিম এবং সৌম্য নিজেদের প্রমাণ করেছে। সৌম্যর ওপর আস্থার প্রতিদান সৌম্য দিয়েছে। বিশ্বকাপেও এমন পারফরম্যান্স ধরে রাখতে পারলে অনেকদূর পৌঁছানো সম্ভব। এ ছাড়া উইকেটের পেছনে মুশফিকুর রহিম অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে সুনামের সঙ্গে খেলে যাচ্ছেন। একটা সময় বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমকে নিয়ে নানা ধরনের তীর্যক মন্তব্য করা হয়েছে। বিশেষ করে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পরে টেস্ট মর্যাদা নিয়েও অনেকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করতে ছাড়েনি। ওয়ানডে ক্রিকেটে ছিল ধারাবাহিকতার অভাব। তবে এসব যে একটা সময় বাংলাদেশ কাটিয়ে উঠবে সে বিশ্বাস বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের ছিল। তাই তো নিজ দেশের দুঃসময়েও মাঠে গিয়ে বাংলাদেশ বাংলাদেশ করে চিৎকার করে পুরো গ্যালারিকে মাতিয়ে রেখেছে। এগুলো হচ্ছে শুধু ক্রিকেট দলের প্রতিই না বরং নিজ দেশের প্রতি ভালোবাসারও প্রকাশ। কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার কথা মনে পড়ছে। শাবাশ বাংলাদেশ এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়। আজ বাংলাদেশ ক্রিকেটের যে অর্জন তা যেন গোটা বিশ্ব দেখছে। সমন্বিত নৈপুণ্যে বাংলাদেশ দল আজ কোথায় পৌঁছে যাচ্ছে তা যেন কোনো সীমায় বাধা যায় না। গত বিশ্বকাপে একটি সমালোচিত ম্যাচে বাংলাদেশের বিদায় ছিল হতাশাজনক। সেই হতাশা ঝেড়ে ফেলে নতুন করে লড়াই করতে হবে। আমরা তো থেমে যাওয়ার জন্য শুরু করিনি। স্বপ্নের বিশ্বকাপ একদিন বাংলার সোনার ছেলেরা এই দেশের মাটিতে নিয়ে আসবে এই আমাদের বিশ্বাস। এই বিশ্বাস থেকেই আমরা সবসময় আমাদের ক্রিকেটারদের পাশে থাকি, তাদের উৎসাহ দিই অনুপ্রেরণা দিই। দলের দুঃসময় এবং সুসময় সব পরিস্থিতিতেই এই দর্শকরাই যে ক্রিকেটের প্রাণ তা প্রমাণ করেছে। দেশের পতাকা হাতে নিয়ে, বাঘের রং শরীরে লাগিয়ে গ্যালারিময় উলস্নাসে মাতিয়ে রাখে এই দর্শকরাই। দর্শকদের অনুপ্রেরণা যে কত বড় পাওনা সে ক্রিকেটার মাত্রই জানেন। একজন অভিনেতার যেমন দর্শকের ওপর বাঁচতে হয় তেমনি কোনো খেলোয়াড়কেও অনুপ্রেরণার কাজটিই করে এই ক্রিকেটপাগল দর্শকরা। মোদ্দাকথা হলো- আমরা সাধারণ দর্শক। ক্রিকেটের সঙ্গে আমাদের দেশের সম্মান জড়িত। দল হারলে আমাদের চোখেও জল আসে। আমরা ব্যথিত হই। দল জিতলে আমরা উলস্নাস করি। আমাদের ভালোবাসা প্রকাশ করি। বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বলে চিৎকার করি। আমরা এভাবেই আমাদের ক্রিকেট দলকে নিয়ে চিৎকার করতে চাই। আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে চাই তাকিয়ে দেখ আমরা ক্রিকেট জগতে রাজত্ব করতে এসেছি। ব্যাটিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে বোলিংয়েও বাংলাদেশ যথেষ্ট শক্তিশালী। মাশরাফির সঙ্গে মোস্তাফিজ দারুণ এক কম্বিনেশন। যে কোনো সময় বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের আতঙ্ক হয়ে দেখা দিতে পারেন তারা। তা ছাড়া মাঝে সাকিবের স্পিন বা অন্য বোলাররাও দারুণ কাজ করেন। জয়ের জন্য বাংলাদেশের দরকার একটি টিম হয়ে খেলা। কোনো একজন বা দুজন ক্রিকেটার কোনো বিশেষ দিনে জ্বলে উঠলে খেলায় জয় হয়তো পাওয়া যায়। কিন্তু ধারাবাহিক জয়ের জন্য দরকার সম্মিলিত পারফরম্যান্স। লাল সবুজের বীরত্বগাঁথা অর্জন করে আনতে হবে। এবারের বিশ্বকাপে আমাদের ক্রিকেট সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাক- এ দেশের মানুষের এটাই প্রত্যাশা। এ দেশের সব মানুষের সমর্থন সবসময় থাকবে মাশরাফি বাহিনীর ওপর। অলোক আচার্য : কলাম লেখক