ট্রাম্প কি বুশের পথেই হাঁটছেন

এখন পর্যন্ত ইরান কারো উস্কানি কানে না নিয়ে ধৈর্য ধারণ করে প্রশংসনীয় অবস্থানে আছে। ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণ বুশকে সেবার নির্বাচনী যুদ্ধে সাহায্য করেছিল। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে একের পর এক বিতর্কিত কাজ ও মন্ত্যবের জের ধরে যখন ইমেজ সংকটে ট্রাম্প, তখন দখলদার মিত্র ইসরাইলের পরামর্শে ইরান হামলার মধ্যে দিয়ে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা হয়তো পূর্বসূরির কাছ থেকেই সেখা। দেখার বিষয় ট্রাম কোন পথে হাঁটে!

প্রকাশ | ২৪ মে ২০১৯, ০০:০০

মেহেদী হাসান
পৃথিবী এখনো ভোলেনি ২০০৩ সালের কথা, মার্চের ২০ তারিখে হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার তীর্থ ভূমি ইরাক, ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর চক্রান্তমূলক আগ্রাসী আক্রমণে চূর্ণবিচূর্ণ হয়। বিশ্ব রাজনীতির স্বৈরশাসক আমেরিকার তাবেদারি আচরণ ও বশ্যতা স্বীকারের অপরাগতার জন্য সাদ্দাম হুসেনকে সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হয়েছে। বুশ প্রশাসনের তীব্র ইরাক বিদ্বেষী মনোভাব ওইরাকের বিরুদ্ধে তথাকথিত ভয়ানক অস্ত্র মজুদের নাটকে ইরাক ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। বাগদাদের কোনো প্রকার যুক্তিকে সেদিন সামান্য বিবেচনায়েও রাখা হয়নি। তৎকালীন জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শক হ্যান্স বিলিক্স ও তার দল দীর্ঘদিন ইরাক পরিভ্রমণ করে যে অনুসন্ধানি রিপোর্ট দিয়েছিলেন, সেখানে বলা ছিল ইরাকের হাতে কোনো প্রকার ভয়ানক অস্ত্রের মজুদ নেই। জাতিসংঘ ইরাক আক্রমণের আমেরিকার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অনস্থা প্রস্তাব পাস করেছিল, আমেরিকার যুদ্ধবাণিজ্যের অন্যতম শরিক ন্যাটোও সেদিন এই আক্রমণের বিরোধিতা করেছিল তবুও সেদিন জর্জ বুশ তার যুদ্ধংদেহী উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করতে স্বাধীন সার্বভৌম ইরাককে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। সেই যন্ত্রণার ক্ষতের রক্তক্ষরণ এখনও শেষ হইনি, এমন সময় বুশের যোগ্য উত্তরসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের লোলুপ দৃষ্টি এখন প্রতিবেশী দেশ ইরানের ওপর। আবারো একটি বর্বরোচিত, অমানবিক, নগ্ন হামলার দ্বারপ্রান্তে আমেরিকা, নীরব দর্শকের ভূমিকায় পুরো বিশ্ব। ইতোমধ্যে ইরান অভিমুখে তাক করা হয়েছে আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজ। যদিও আমেরিকার যুদ্ধ বাণিজ্যকে রূপ দিতে কোনো ইসু্যর প্রয়োজন পড়ে না- তবুও ঘটা করে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি থেকে ইরানের ওপর চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে আমেরিকা বের হয়ে আসে। বহুপাক্ষিক ওই চুক্তির অন্যদেশগুলো এমনকি চুক্তি পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বলছে এখন পর্যন্ত ইরান জেসিপিও সম্পূর্ণ রূপেই মেনে চলেছে। খামখেয়ালি, উন্মাদ, হটকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে স্বীকৃত ট্রাম্প সব ধরনের যুক্তিকে উপেক্ষা করে ইরানকে অবরোধের যুদ্ধে অর্থনৈতিকভাবে পুরো বিধ্বস্ত করে ছেড়েছে, এখন পালা বারুদের আগুনে ইরানকে ছাই করে পারস্য সাগরে মিশিয়ে দেয়া। তবে এবারে এই যাত্রাটি খুব সহজ হবে না বলেই মনে হচ্ছে। তেলনির্ভর অর্থনীতির দেশ ইরানের প্রধান ক্রেতা ও চুক্তির অন্যতম শরিক দেশ চীন অবরোধ উপেক্ষা করে এখনো ইরান থেকে তেল ক্রয় করছে। প্রয়োজন হলে মার্কিন ডলারকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো মুদ্রা দিয়ে হলেও এই লেনদেন চলবে বলে চীন ঘোষণা দিয়েছে। ১৭ মে চীনের স্টেট কাউন্সিলর ওয়া ঈ বলেন, 'চীন দৃঢ়তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নিষেধাজ্ঞার বাস্তবায়নের বিরোধিতা করছে' এবং একতরফা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিরোধী এবং স্বার্থ সুরক্ষায় তেহরানের চেষ্টাকে সমর্থন জানাচ্ছে'। চুক্তির অন্যতম পক্ষ রাশিয়া এই ক্ষেত্রে আমেরিকার বিপক্ষে অবস্থান করছে, ১৫ মে মস্কোতে এক আলোচনা সভায় রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভস্নাদিমির পুতিন বলেন, দুঃখজনকভাবে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সম্পর্কে সবগুলো চুক্তি লঙ্ঘন করা হয়েছে। মস্কো ইরানের পাশে থাকার বার্তা দিচ্ছে, তা ছাড়া চুক্তির অন্য দেশগুলোকে সমাধানের পথে হাঁটতে আর্জি জানিয়ে ওয়াশিংটনকে বোঝানোর কথা বলেছে মস্কো। এদিকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার শর্ত না লঙ্ঘন করে অন্য দেশের সঙ্গে যাতে ইরান ব্যবসায়িক সম্পর্ক রাখতে পারে, সে চেষ্টা প্রথমে করেছিল ইউরোপের চুক্তিতে থাকা বাকি তিন দেশ (ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি)। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে যে বিবৃতি দেয়া হয়েছে, তাতে ইরানের ওপরে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে তারা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই চুক্তি এখনো কার্যকর করতে চাই। জাতিসংঘের সঙ্গে এ ব্যাপারে ইইউ পরামর্শও করছে। লেনদেনে মার্কিন ডলারের বিকল্প, এমনকি বিনিময় প্রথার মাধ্যমে ব্যবসা করার কথাও ভাবা হচ্ছে বলে জানা গেছে। প্রত্যাশিতভাবেই ইরানের প্রতিবেশী দেশগুলো স্বার্থের দ্বন্দ্বে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়েছে, মার্কিন হস্তক্ষেপে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি নষ্ট করছে জানিয়ে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেবলুত কাভুসগলু বলেন, 'প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমরা কীভাবে সম্পর্ক স্থাপন করব, সে বিষয়ে একতরফা নিষেধাজ্ঞা ও অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ আমরা সহ্য করব না'। আরেক প্রতিবেশী এই অঞ্চলের আমেরিকার কৌশলগত অংশীদার সৌদি আরব, আমেরিকার তোষণ নীতি অবলম্বন করছে। ১৩ মে সোমবার, আমির শাহীর ফুজাইরা শহরের কাছে পারস্য উপসাগরের সৌদি আরবের দু'টি জাহাজে এবং গত মঙ্গলবার লোহিত সাগর সংলগ্ন সৌদির তেলসমৃদ্ধ পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের দু'টি তেল পাম্পিং স্টেশনে ড্রোন হামলা চালায় হুতি বিদ্রোহীরা। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার পারদ যখন মধ্যে গগনে, ১৭ মে রিয়াদ থেকে প্রকাশিত সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় দৈনিক আরব নিউজের সম্পাদকীয় মতামতে ইরানকে শাস্তির হাত থেকে কোনোভাবেই রেহাই না দিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে। \হহামলার কৌশল হিসেবে পত্রিকাটি ইরানে 'সার্জিক্যাল স্ট্রাইক'বা গুপ্ত হামলা চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তিতে বলা হয়েছে, ইরান, সৌদি ও এই অঞ্চলের জন্য অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করেছে, তাই ইরানের বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সর্বোচ্চ শাস্তি আসা করে সৌদি আরব। এই আগুনে নিয়মিত উস্কানির ঘি ঢেলে দিচ্ছে ওয়াশিংটনের সব ঋতুর বন্ধু তেলে আবিব। এই প্রণোদনা ট্রাম্পকে স্বাভাবিকভাবেই উত্তেজিত করেব, ইয়েমেনের হুতি, লেবাননের হিজবুলস্না বা ইরাকের আমেরিকার বিদ্রোহীগোষ্ঠীকে অর্থায়ন করে ইরান, এই অঞ্চলে সৌদিবিরোধী একটি মুসলিম নেতৃত্ব হয়ে উঠতে পারে ইরান। যা এই অঞ্চলে আমেরিকার পরোক্ষ, এবং সৌদি আরব ও ইসরাইলের জন্য প্রত্যক্ষ চলমান হুমকি। উত্তেজনার চরম মুহূর্তে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি ট্রাম্প ও তার যুদ্ধবাণিজ্যের সহযোগীদের জানিয়ে দিয়েছেন কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের। এখন পর্যন্ত ইরান কারো উস্কানি কানে না নিয়ে ধৈর্য ধারণ করে প্রশংসনীয় অবস্থানে আছে। ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণ বুশকে সেবার নির্বাচনী যুদ্ধে সাহায্য করেছিল। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে একের পর এক বিতর্কিত কাজ ও মন্ত্যবের জের ধরে যখন ইমেজ সংকটে ট্রাম্প, তখন দখলদার মিত্র ইসরাইলের পরামর্শে ইরান হামলার মধ্যে দিয়ে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা হয়তো পূর্বসূরির কাছ থেকেই সেখা। দেখার বিষয় ট্রাম কোন পথে হাঁটে! মেহেদী হাসান: শিক্ষক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সবযবফরযধংধহ@শঁ.ধপ.নফ