আমাদের স্বৈরাচারী মনোভাবের নেপথ্যে
প্রকাশ | ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
মো. আতিক শাহরিয়ার সিয়াম
স্বৈরাচার হটানোর চার মাস অতিবাহিত হচ্ছে তবে স্বৈরাচারী মনোভাব আমরা হটাতে পারি নাই। অবশ্য এত দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে ওঠা মনোভাব চার মাসে হটানো সম্ভব না। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের এ নিয়ে গোস্বা করতে দেখা গেলেও কেউই এই মনোভাবের পেছনের কারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে না। সর্ষের মধ্যে ভূতের ন্যায় এই প্রজন্মের বেড়ে ওঠার মধ্যেই যে স্বৈরাচারের বীজ লুকায়িত এটা কেউ চিহ্নিত করছে না। এই বীজ শৈশবে অঙ্কুরিত হয়ে কৈশোর ও যৌবনে ডালপালা মেলে বিরাট জংলি বৃক্ষে পরিণত হয়। এই বেড়ে ওঠার সময়টাতে কেউই ভ্রম্নক্ষেপ করে না। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যখনই বৃক্ষ চারপাশের অন্য বৃক্ষের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, অন্য বৃক্ষকে পর্যাপ্ত পুষ্টি পেতে বাধা দেয় তখনই তা অন্যদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তখন এই গাছটিকে সমূলে উৎপাটন করা না ছাড়া উপায় থাকে না। ফ্যাসিস্ট ক্যারেক্টার অনেকটা ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা এই জংলি গাছটার মতো যা অতি সন্তর্পণে চারপাশে নিজের মূল ছড়িয়ে দেয়। উৎখাতের সময়ও একে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় উৎখাত সম্ভব হয় না। একটা ঝড়ের প্রয়োজন হয়। যে ঝড় বয়ে গেছে পুরো জুলাই-আগস্টজুড়ে।
চলুন দেখি কিভাবে একটা জাতির মননে মগজে স্বৈরাচারী মনোভাব বাসা বাঁধে-
পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বস্তু ছোট্ট মাথায় নিয়ে জন্ম নেই আমরা। যে বস্তু চমৎকার রিসিভার এবং আশপাশের পরিবেশ, লোকজনকে পড়ে ফেলতে পারে সহজাতভাবেই। বুঝতে শেখার পর থেকেই এই সহজ সরল অবলা ব্রেনে ভুল ইনফরমেশন ঢুকতে থাকে এই বঙ্গদেশে। আমার বাবা সবার সেরা, অমুকের ছেলের থেকে আমার ছেলের বুদ্ধি বেশি, আমার বাবু তো আড়াই বছর বয়স থেকেই কথা বলে, বাবু আন্টিকে একটা কবিতা শুনিয়ে দাও তো। অমুকের মেয়েটা তো কালো, আবার নাক বোচা, এসব সফট বর্ণবাদী কথাবার্তা আমাদের ব্রেনে ইনপুট হতে থাকে। ছোটবেলা থেকে বড় বেলা পর্যন্ত বারংবার এসব বর্ণবাদী বার্তা আমাদের ব্রেনে, অবচেতন মনে রেসিজম ও ফ্যাসিজমের প্রোগ্রামিং করতে থাকে। এরপর শিশু ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করে। ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে উঁকি দেওয়া প্রশ্ন স্যারকে জিজ্ঞেস করলে মাঝেমধ্যে এমন উত্তর আসে যার মানে দাঁড়ায় যাহা বলিব তাহাই সঠিক, বেশি পাকনামি করিও না বৎস। সরল মন আবার ধাক্কা খায়। অতঃপর একদিন রেজাল্ট বের হয়। দেখা যায় সোনামণি দশম হয়েছে। অন্য সব বিষয়ে ফুল মার্কস পেলেও ইংরেজি আর গণিতে ৫ মার্ক করে কম পেয়েছে। পাশের বাসার ভাবীর মেয়ে প্রথম হয়েছে। সোনামণির জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। পাশের বাসার মেয়ে কী খায়, কী পড়ে, তোকে কী তার থেকে কিছু কম দেওয়া হয়েছে? আজ থেকে তোর বিকালে খেলাধুলা বন্ধ। রেজাল্ট ভালো কর তারপর যা ইচ্ছা করিস। এই যা ইচ্ছা করিস পরবর্তীতে কাল হয়ে দাঁড়ায়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে এই মনোভাব তাকে স্বৈরাচারী হওয়ার ট্রেনিং দিতে থাকে। এই ট্রেনিং পূর্ণতা পায় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। মফস্বলের বা শহরের বাবা মায়ের শাসনে বেড়ে ওঠা আনকোরা বালকের বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়াটা হয়ে ওঠে শ্বাসকষ্টের রোগীর প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার মতো ব্যাপার। বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠে পা পড়েই তার পরিচয় ঘটে অসীম ক্ষমতাধর সিনিয়র ভাইয়ের সঙ্গে। দেখা যায়, ভাই অমুক ছাত্র উইংয়ের নেতা। যার অঙ্গুলিহেলনে মাননীয় উপাচার্য আর মাননীয় থাকেন না, হেলে পড়ে যান। হেলে পড়ে ক্যাম্পাসের সকল বৃক্ষরাজি, বসে পড়ে ক্যাম্পাসের মোস্ট সিনিয়র কুকুর, শুয়ে পড়ে স্বর্গ থেকে নেমে আসা নূপুর (কাল্পনিক চরিত্র)। এসব দেখে আপস্নুত হয় বালকটি। ক্যাম্পাসের ভাইকে বাবা আর সেন্ট্রালের ভাইকে দাদা ভাবতে থাকে। যাদের পা থেকে মাথা, ক্ষেত্রবিশেষে রতিবলও চেটে দেওয়া চরম সৌভাগ্যের। যাদের গালিকে মনে হয় অমিয় বাণী, আর দুয়েকটা চর-থাপ্পড়কে বাকরখানি। প্রায় প্রতি রাতেই ভাইয়ের টাক পড়া ছবি শেয়ার দিয়ে ক্যাপশন দেয় আজীবন আপনার স্নেহের ছায়াতলে রাখবেন ভাই। এই গবেটের এতসবের পিছনের কারণ কিন্তু পাওয়ার প্র্যাকটিসের মানব মনের লুকোনো এক সুতীব্র বাসনা। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সে একজন দানব হয়ে ওঠে। রাজনীতি না করা ছাত্রটিও এই পরিবেশে থেকে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠে। আর এরা নার্সিসিস্ট পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভুগতে থাকে। অন্যের মতামত, অন্যের কথাবার্তা এদের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়ে। ছাত্র থেকে শিক্ষক, কামলা থেকে আমলা, নেতা থেকে কর্মী, বিধর্মী থেকে ধর্মী সবার মাঝে এটা ছড়িয়ে পড়ে। আর এটা নেভার এন্ডিং লুপের ন্যায় চলতে থাকে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ-২০১৮-১৯-এর তথ্যে দেখা যায়, ৭ থেকে ১৭ বছর বয়সি ১৪ শতাংশ শিশু মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশই কোনো ধরনের পরামর্শ বা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। এ থেকে পরিত্রাণের সংক্ষিপ্ত কোনো রাস্তা নাই। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া অতীব জরুরি।
পরিবার ও সমাজে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা মুখ্য হওয়া উচিত। দেশের এনজিওগুলো ট্র্যাম্পকার্ড হয়ে উঠতে পারে। স্কুল-কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং-এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও কাউন্সিলিং জরুরি। প্রতিটা অনুষদের অধীনে মনোচিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া জরুরি। একটা সচেতন প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারলে পরবর্তীতে এরাই আলোর দিশারী হয়ে জাতিকে ঘোর অমানিশায় পথ দেখাবে।
মো. আতিক শাহরিয়ার সিয়াম
শিক্ষার্থী
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়