বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের রাজনীতি

গণমানুষের রাজনীতিই হোক সব রাজনৈতিক দলগুলোর একমাত্র প্রতিশ্রম্নতি। সবার মূল লক্ষ্য হবে গত সতের বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ জুলাই-আগস্ট গণ-অভু্যত্থানের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন।

প্রকাশ | ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস
জুলাই-আগস্ট গণ-অভু্যত্থানের পর থেকে মানুষ নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। দেশ, মানুষ, মাটি আর মানচিত্র নিয়ে মানুষের চোখেমুখে নতুন দিনের স্বপ্ন। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকেই সৃষ্টি হয়ে জুলাই-আগস্ট গণ-অভু্যত্থান। গণ-অভু্যত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রত্যাশা সবার। আগামী দিনের বাংলাদেশ হবে সব মানুষের বাংলাদেশ। গণতন্ত্র আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে সবার জন্য। যে বাংলাদেশের জন্য ১/১১ পরবর্তী দীর্ঘ প্রায় দুই দশক যাবত মানুষ গুম খুনের শিকার হয়েছে। ফ্যাসিস্ট জামানায় হামলা-মামলা নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে, সেই ফ্যাসিস্ট আওয়ামী জামানা বাংলাদেশে মানুষ আর চায় না। মানুষের প্রত্যাশা জুলাই-আগস্ট গণ-অভু্যত্থানের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে রাজনৈতিক দলগুলোতেও। মানুষের চিন্তাভাবনা এবং বিশ্বাসের দরজায় কড়া নাড়ছে ন্যায়ভিত্তিক, বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনের রাজনীতি। একই স্পিরিট ছিল মুক্তিযুদ্ধ, ৭ নভেম্বর, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক. জাতীয় ষড়যন্ত্র ও ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। এই দুই চক্রান্তের ফলে বাংলাদেশ বারবার তার পথ হারিয়েছে। কিন্তু জুলাই-আগস্টের গণ-অভু্যত্থান নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। জাতিকে এই সুযোগের সদব্যহার করতে হবে। দুই. দক্ষিণ এশিয়ায় জোর জুলুম করে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে আধিপত্যবাদী ভারত প্রায় এক ঘরে হয়ে যাচ্ছে। নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানকে ভারতের রাডারের অধীনস্থ করার অসৎ উদ্দেশ্যে মাত্রাতিরিক্ত জোর জবরদস্তি করায় দেশগুলো প্রচন্ড ভারতবিরোধী হয়ে উঠেছে। এখন বাংলাদেশেও তাই হচ্ছে। বাংলাদেশকে দিলিস্নর রাডারের নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়ান এস্টাবলিস্টমেন্ট ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেন ঘটায়। '৭-এর ১/১১ থেকে ৫ আগস্ট '২৪ পর্যন্ত ভারতের দোসর আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে বর্বর এক দুঃশাসন চালায়। বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, ভোটাধিকার, আইনের শাসন ও মানবাধিকার নির্বাসনে পাঠায়। দিলিস্নর কর্তৃত্বাধীনে বাংলাদেশকে বন্দি রাখতে ইন্ডিয়ান এস্টাবলিসমেন্ট ঘৃণ্য এক সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালায়। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীন জীবন ও নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটায়। রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে ভারত গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা ও গ্রম্নপিংয়ে মদত দেয়। জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটিয়ে হতাশা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতীতে এমন জটিল পরিস্থিতি কখনো দেখা দেয়নি। ভারত ও তার দোসররা বাংলাদেশে নৈতিক মূল্যবোধ, রাষ্ট্রীয় চেইন অব কমান্ড এবং মৌলিক বিশ্বাসের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস পায়। লোকচক্ষুর অন্তরালে ওদের ষড়যন্ত্র চলেছে যুগের পরে যুগ। কিন্তু গণ-অভু্যত্থান সময় পাল্টে দিয়েছে। তিন. গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের শাসন, নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা ও নিরপেক্ষ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণ রাজনৈতিক দলে নেতৃত্বের উৎকর্ষতা পরিমাপ করে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘদিন আইনের শাসন, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, নিরপেক্ষ ভোটাধিকার, পারস্পরিক সুসম্পর্ক, সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে, সমাজ ও রাষ্ট্রে সততা, ন্যায়নীতি এবং নৈতিক মূল্যবোধ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ার ফলে রাজনীতিতে এখন বিভিন্ন ফ্যান্টাসি, ঝাড়ফুঁক এবং পেশিশক্তির উন্মত্ততা বেড়েছে। নৈতিকতার সংকটে রাজনৈতিক দলের শৃঙ্খলা দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং রাজনীতিতে জনগণের আস্থা কমছে। রাজনৈতিক কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, মূল্যবোধ, চরিত্র গঠন, দক্ষতা অর্জন, পরিশ্রম করে জনপ্রিয়তা অর্জন ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান অপরিহার্য। কিন্তু ফ্যাসিস্ট জামানায় এসবের পরিবর্তে দু'দশক লোভ, ভোগ, লাঠিপেটা, মামলা-হামলা আর জালিয়াতির রাজনীতি চলেছে। '৭-এর ১/১১ থেকে '২৪-এর ৫ আগস্ট একটানা প্রায় দুই দশকের আওয়ামী দুঃশাসন বাংলাদেশের রাজনীতিকে কঠিন সংকটে ফেলে গেছে- যা দেশের ভবিষ্যতকেও বিপদসংকুল করে তুলেছে। এই ভয়াবহ ভোগবাদী রাজনীতি থেকে বের হয়ে সুষ্ঠু ধারার রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা এখন অপরিহার্য এবং গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের নিঃশর্ত কমিটমেন্ট খুব বেশি প্রাসঙ্গিক। চার. সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে সব ধরনের অনাচার, অবিচার, শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানুষ ঐক্যবদ্ধ। ভাগ্যহত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সব ধরনের বৈষম্য থেকে দেশ ও জাতি মুক্তি চায়। ন্যায়বিচার ও সামাজিক কল্যাণের প্রত্যয় নিয়ে জীবনবাজি রেখে অগণিত মানুষ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করছে। দেশপ্রেমিক তরুণরা কিশোর বয়সের ভাবাবেগ পেরিয়ে যৌবন ও পরিণত বয়সে পৌঁছে আজও তারা নায্যতা, সাম্য এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এই পথ অনুসরণ করার কারণে তাদের সীমাহীন নির্যাতন ভোগ করতে হয়। এরপরও তারা পিছপা হয় না, লোভ ও প্রলোভনে না জড়িয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে পদদলিত করে তারা সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুধা, দারিদ্র্যতা নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দেশপ্রেমিক নেতাকর্মীরা আদর্শের পথ ত্যাগ করেনি। তারা পদে পদে বাধা, অপমান ও ব্যর্থতার অভিযোগ বরণ করে নিচ্ছে। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়তে তারা এতটুকু দমে যাচ্ছে না। সব বাধার প্রাচীর অতিক্রম করে অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছুতে তারা এখন অবিচল। গত সতের বছরের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ জুলাই-আগস্ট অভু্যত্থানে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করল বাংলাদেশের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার জীবনদানের অকুতোভয় দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের ছাত্র-শ্রমিক মেহনতি মানুষ জীবনের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনল বিজয়। অর্জিত সুফল এখন দেশের সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার পালা। দেশের সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির পথে এখনো প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অধিপত্যবাদী ভারত ও শেখ হাসিনার দোসররা। ভারত আর তার দোসররা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এখনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে ভারত ও আওয়ামী লীগ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ভয়াবহ গিরিখাদ তৈরি করে রেখেছে। এত ভয় ভীতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষ আধিপত্যবাদ ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে নতুনভাবে বিজয়ী ইতিহাস রচনায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনের রাজনীতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার এখনই সময়। পাঁচ. গণ-অভু্যত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন এখন সবার চোখেমুখে। নতুন বাংলাদেশ গঠনের জন্য সবাই এখন প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ। জুলাই-আগস্ট গণ-অভু্যত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য এমন রাজনীতি প্রয়োজন যে, রাজনীতি শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে মুক্তির কথা বলবে। প্রয়োজন সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি। আরও প্রয়োজন জুলাই-আগস্ট গণ-অভু্যত্থানের স্পিরিট ধারণ করে সম্মুখ পানে এগিয়ে যাওয়ার শপথ। বাংলাদেশের তরুণদের স্বপ্ন আকাশছোঁয়া। জীবন দিয়ে তারা প্রমাণ করেছে এই প্রজন্ম শুধু স্বপ্নই দেখে না, বাস্তবায়নও করে। আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে মানুষ অকাতরে জীবন উৎসর্গ করেছে। নতুন বাংলাদেশ গড়তে ফ্যাসিস্টদের ঘৃণিত পথে কেউ আর ফিরে যেতে চাইবে না। গণমানুষের রাজনীতিই হোক সব রাজনৈতিক দলগুলোর একমাত্র প্রতিশ্রম্নতি। সবার মূল লক্ষ্য হবে গত সতের বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ জুলাই-আগস্ট গণ-অভু্যত্থানের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন। অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস : বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী