মানব মর্যাদার মূলভিত্তি মানবাধিকার

মানবাধিকার রক্ষায় সরকারকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এমন আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি- যা মানবাধিকারের সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রকাশ | ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

রাকিব হাসান
মানবাধিকার এমন এক সার্বজনীন নীতি- যা প্রতিটি মানুষের জন্য তার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা, বা আর্থ-সামাজিক অবস্থার ভিত্তিতে কোনো প্রকার বৈষম্য এই অধিকারকে সীমিত করতে পারে না। ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদে এই ধারণাগুলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়, যেখানে ৩০টি ধারা প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। মানবাধিকার হচ্ছে কতগুলো সংবিধিবদ্ধ আইন বা নিয়মের সমষ্টি। বিশ্ব মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর পালিত হয় মানবাধিকার দিবস।? মানবাধিকার মানুষের সম্মান, স্বাধীনতা ও জীবনের ভিত্তি। এর মধ্যে জীবনের অধিকার, বাকস্বাধীনতা, ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা, শিক্ষার সুযোগ এবং ন্যায়বিচারের অধিকার অন্তর্ভুক্ত। মানবাধিকার শুধু ব্যক্তি নয়, বরং একটি সমাজ ও রাষ্ট্রেরও প্রগতির মাপকাঠি। যখন সমাজে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, তখন সামাজিক বৈষম্য, সহিংসতা এবং সংকট বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে, এই অধিকার নিশ্চিত করা হলে শান্তি, ন্যায়বিচার ও সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, এর চর্চা এবং বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সিরিয়া, ইয়েমেন ও সুদানের মতো দেশগুলোতে চলমান যুদ্ধ এবং সংঘাত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ উদাহরণ। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নারী, শিশু ও নিরপরাধ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়। ফিলিস্তিনে প্রতিনিয়ত ক্ষুণ্ন্ন হচ্ছে মানবাধিকার তবুও মানবিক বিশ্ব নীরব ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধ, দারিদ্র্য এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে লাখ লাখ মানুষ ঘরহারা, খাদ্যের অভাব, বস্ত্র ও চিকিৎসাহীন হচ্ছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মানবাধিকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা সংকট চরম আকার ধারণ করছে। রোহিঙ্গাদের সাহায্য করা হলেও হুমকির মুখে তাদের মানবাধিকার। ফলে, বিশ্ববাসীর জন্য রোহিঙ্গা সংকট একটি বিবেচনার বিষয়। অনেক দেশে গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। বিরোধী মত দমন করতে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটে। এছাড়াও দারিদ্র্যের কারণে লাখো মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্যের মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশ্বের অনান্য দেশের মতো বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রগতির পাশাপাশি চ্যালেঞ্জের মুখে। নারী নির্যাতন, যৌতুক ও শিশুশ্রম এখনো একটি বড় সমস্যা। প্রতিদিন গৃহসহিংসতা ও বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে অনেকে ছেলেমেয়ে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত হওয়ার অভিযোগ বারবার উঠে আসছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। যদিও অভু্যত্থান পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল আইন নিয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত জানায় অন্তবর্তীকালীন সরকার। গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকারের সুরক্ষায় উন্নতি হলেও, এখনো নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা যায়নি। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে সব থেকে বেশি কাজ করে নারী শ্রমিক। নারীদের অধিকার সুরক্ষায়ও এগিয়ে আসতে হবে। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, ন্যায্যমজুরি প্রদানসহ ইত্যাদি অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।? মানবাধিকার রক্ষায় সরকারকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এমন আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি- যা মানবাধিকারের সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে। মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে গণমাধ্যম এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে অধিকার সম্পর্কে শিক্ষার প্রসার ঘটানো উচিত। নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা বন্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং পুনর্বাসন কার্যক্রম চালাতে হবে। যুদ্ধ, শরণার্থী সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলোর সমাধানে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কার্যকর ভূমিকা অপরিহার্য। গণমাধ্যম ও নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সমাজের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব নেতারা মানবিকতার জন্য আহ্বান জানালেও বিশ্বে চলমান অনেক যুদ্ধ ও মানবতার ভূলুণ্ঠিত অবস্থা বিশ্ববাসীর জন্য দুঃস্বপ্নের কারণ। তাই অনতিবিলম্বে বিশ্ব মানবাধিকার নিয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের দেশসমূহের নেতা ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে একত্রে কাজ করতে হবে। মানব মর্যাদার রক্ষাকবচ মানবাধিকার। তাই মানব মর্যাদাকে অক্ষুণ্ন রাখতে মানবাধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রের নয়; প্রতিটি নাগরিক, সমাজ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা রয়েছে। মানবাধিকার কেবল একটি আইনগত বিষয় নয়, এটি মানবতার মূল ভিত্তি। এটির লঙ্ঘন বন্ধ করা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা একটি ন্যায্য, সমৃদ্ধ এবং মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে প্রতিটি মানুষ তার অধিকারের মর্যাদা পাবে। রাকিব হাসান : নবীন কলাম লেখক