বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি খাতে বিপস্নব চলছে। মানুষের জীবনযাত্রার প্রতিটি স্তরে প্রযুক্তির ছোঁয়া পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশও এ দৌড়ে পিছিয়ে নেই। 'প্রযুক্তির বাংলাদেশ' গঠনের স্বপ্ন নিয়ে দ্রম্নত এগিয়ে চলেছে। তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক কাঠামোতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি রয়ে গেছে অনেক চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতের সম্ভাবনা
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক তরুণ। এরা প্রযুক্তির সঙ্গে দ্রম্নত মানিয়ে নিতে সক্ষম এবং উদ্ভাবনী শক্তিতে ভরপুর। তরুণদের এই শক্তি ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিং এবং সফটওয়্যার উন্নয়ন খাতে বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী তৃতীয় বৃহত্তম ফ্রিল্যান্সিং দেশ। দেশের প্রায় ৮ লাখের বেশি ফ্রিল্যান্সার আন্তর্জাতিক পস্ন্যাটফর্ম- যেমন ফাইভার, আপওয়ার্ক এবং টপটালে কাজ করছে। সময়ের পরিক্রমায় যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিং খাত থেকে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে।
ই-কমার্স বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতের অন্যতম বিকাশমান অংশ। দারাজ, চালডাল, আজকের ডিলের মতো পস্ন্যাটফর্মগুলো অনলাইনে কেনাকাটার জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে দেশের ই-কমার্স বাজারের মূল্য ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব পস্নাটফর্মে আরো উন্নতি সাধন সম্ভব।
অনান্য দেশের মতো স্টার্টআপ কালচারও দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। ফিনটেক, এডুটেক ও হেলথটেক খাতে নতুন উদ্যোগগুলো দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। উদাহরণস্বরূপ, পাঠাও ও শপআপ বাংলাদেশের প্রযুক্তিনির্ভর স্টার্টআপগুলোর সফল উদাহরণ। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে হাইটেক পার্ক তৈরি করা হচ্ছে। দেশের প্রায় ৯৭ শতাংশ এলাকায় ৪জি ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছেছে। সরকার ৫জি নেটওয়ার্ক চালু করার উদ্যোগও নিয়েছে।
এসব উন্নতির কারণে প্রযুক্তি খাতে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অ্যামাজন, গুগল ও হুয়াওয়ের মতো আন্তর্জাতিক কোম্পানি বাংলাদেশে কার্যক্রম বিস্তৃত করছে। এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পরিমাণও উলেস্নখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তবে প্রযুক্তি খাতের কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। তাই প্রযুক্তিগত উন্নয়ের মাধ্যমেই উন্নয়নের গতি বাড়ানো সম্ভব। সেজন্য প্রয়োজন বাধাসমূহ মোকাবিলা করা।
শিক্ষার ঘাটতি ও দক্ষতার অভাব : বাংলাদেশে প্রযুক্তিগত শিক্ষার পরিকাঠামো এখনো উন্নত নয়। প্রোগ্রামিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ও মেশিন লার্নিংয়ের মতো বিষয়ে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রয়োজন। প্রযুক্তি খাতে গবেষণা এবং উদ্ভাবনে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাব রয়েছে।
অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা : দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো ইন্টারনেট সংযোগ অপ্রতুল। ইন্টারনেটের উচ্চমূল্য অনেক মানুষের নাগালের বাইরে। শহর ও গ্রামের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারে বৈষম্য রয়েছে।
সাইবার নিরাপত্তার অভাব : সাইবার অপরাধ বাংলাদেশে ক্রমশ বাড়ছে। ব্যাঙ্কিং খাতে সাইবার আক্রমণ এবং তথ্য চুরির ঘটনা বাড়ছে। তাই সাইবার নিরাপত্তা নীতিমালার উন্নয়ন ও দক্ষকর্মী তৈরিতে আরও মনোযোগ প্রয়োজন।
বিদেশি বিনিয়োগে জটিলতা : বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সহজলভ্য পরিবেশ নিশ্চিত করা এখনো একটি চ্যালেঞ্জ। অনেক ক্ষেত্রেই বিনিয়োগকারীরা জটিল নীতিমালার মুখোমুখি হয়। এছাড়াও সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব লক্ষ্য করা যায়।
সুতরাং, প্রয়োজন টেকসই পদক্ষেপ। প্রযুক্তি বিষয়ক শিক্ষাকে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করা। প্রোগ্রামিং ও কোডিং কোর্স বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। গবেষণার জন্য বিশেষ তহবিল তৈরি করা। তরুণদের উদ্ভাবনী আইডিয়াগুলো বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা। এছাড়া একটি শক্তিশালী সাইবার নিরাপত্তা নীতি তৈরি করা এবং সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে দক্ষ কর্মী গঠন। প্রত্যন্ত এলাকায় উচ্চগতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করা এবং ইন্টারনেটের খরচ কমানো। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য কাগজপত্রের প্রক্রিয়া সরলীকরণ এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিও জরুরি।
বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাত অগ্রগতির পথে রয়েছে। তরুণ জনগোষ্ঠী, সরকারি উদ্যোগ ও স্টার্টআপ সংস্কৃতি এই অগ্রগতির প্রধান চালিকাশক্তি। তবে প্রযুক্তিগত শিক্ষার ঘাটতি, সাইবার নিরাপত্তার অভাব এবং অবকাঠামোর দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারলে বাংলাদেশ প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির শীর্ষে অবস্থান নিতে সক্ষম হবে। 'প্রযুক্তির বাংলাদেশ' শুধু একটি স্স্নোগান নয়; এটি একটি স্বপ্ন- যা পূরণে সরকার, বেসরকারি খাত এবং জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে। আজকের পদক্ষেপই নিশ্চিত করবে একটি প্রযুক্তিসমৃদ্ধ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।
রাকিব হাসান : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ