গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা জরুরি

প্রতিহিংসার রাজনীতির সবচেয়ে বড় শিকার হয় দেশের সাধারণ মানুষ। প্রতিদ্বন্দ্বিতার নামে দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ, কর্মবিরতি এবং হিংসাত্মক কর্মকান্ডের ফলে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো আটকে যায়, শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হয় এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে মানুষের মধ্যে ভীতি এবং আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়। রাজনীতির প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যায়- যা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি।

প্রকাশ | ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

হুমায়ুন আহমেদ নাইম
রাজনীতি একটি জাতির উন্নয়ন, শান্তি এবং গণতান্ত্রিক অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এর লক্ষ্য হওয়া উচিত সমাজের কল্যাণ ও মানুষের জীবনমান উন্নত করা। কিন্তু যখন রাজনীতি প্রতিহিংসার হাতিয়ারে পরিণত হয়, তখন এটি কেবল রাষ্ট্রের অগ্রগতিকেই ব্যাহত করে না বরং জনমানুষের মধ্যে বিভাজন এবং হতাশার জন্ম দেয়। প্রতিহিংসার রাজনীতি আমাদের সমাজে কোনো নতুন ঘটনা নয়। এটি এমন একটি প্রবণতা, যেখানে রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিবিশেষ ক্ষমতা লাভ ও ধরে রাখার জন্য অন্য পক্ষকে দমন করার কৌশল অবলম্বন করে। এ ধরনের রাজনীতির ফলে সাধারণ জনগণ দুর্ভোগের শিকার হয়। ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে, আবার বিরোধী দলও ক্ষমতায় এসে একই আচরণ প্রতিফলিত করে। এই চক্র ক্রমিক প্রতিহিংসার ধারা আমাদের গণতন্ত্রের শেকড়কে দুর্বল করে তুলছে। ১৯৭১- বর্তমান মাত্র ৫৪ বছরে সংবিধান ১৮ বার সংশোধন করা হয়েছে। যে সরকারই ক্ষমতায় আসে প্রথমেই সংবিধানকে সংশোধন করে নিজেদের আওতায় নিয়ে যেতে চায়। যা অস্বচ্ছ রাজনীতির প্রতিচ্ছবি। এ ধরনের চেতনা থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে প্রতিহিংসামূলক রাজনীতির প্রত্যাশা আষাঢ়ে গল্পের মতোই। প্রতিহিংসার রাজনীতির সবচেয়ে বড় শিকার হয় দেশের সাধারণ মানুষ। প্রতিদ্বন্দ্বিতার নামে দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ, কর্মবিরতি এবং হিংসাত্মক কর্মকান্ডের ফলে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো আটকে যায়, শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হয় এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে মানুষের মধ্যে ভীতি এবং আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়। রাজনীতির প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যায়- যা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি। এই ধরনের রাজনৈতিক চর্চার ফলে একদল অন্যদলের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ফলে, দেশে গৃহযুদ্ধের মতো অবস্থা বিরাজ করে। সমাজকে করে তোলে অস্থিতিশীল, জীবনকে করে অনিশ্চিত। সার্বিয়ান প্রবাদ, 'যুদ্ধ শুরু হলে রাজনীতিবিদরা অস্ত্র দেয়, ধনীরা রুটি দেয় আর গরিবরা তাদের ছেলেদের দেয়। যুদ্ধ শেষ হলে রাজনীতিবিদরা হাত মেলায়, ধনীরা রুটির দাম বাড়ায় আর গরিবরা তাদের ছেলেদের কবর খুঁজে বেড়ায়।' ফলে তৃণমূল থেকে যে ছেলেটা শহরে এসে পড়াশোনা করে পিতামাতার স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছিল সে হয়ে পড়ে প্রতিহিংসা মূলক রাজনীতির বলির পাঁঠা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার উদাহরণ রয়েছে। তবে সেসব দেশে সুশাসন, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই সমস্যা অনেকাংশে নিরসন করা গেছে। আমাদের দেশেও এই চক্র ভাঙার সময় এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহনশীলতার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বুঝতে হবে, প্রতিহিংসা নয়, বরং সহযোগিতা এবং জনগণের কল্যাণে কাজ করাই প্রকৃত রাজনীতির লক্ষ্য। জুলাই বিপস্নবের স্পিরিট নিয়ে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সব মতভেদ ভুলে একযোগে সরকারকে সহযোগিতা করে, তাহলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা খুব বেশি কঠিন হবে না। কিন্তু এর জন্য প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলকে নিজেদের মধ্যে জুলাই বিপস্নবের স্পিরিটকে ধারণ করে নিজেদের দলীয় আদর্শকে মাঠ পর্যায়ে কাজে লাগাতে হবে। যেখানে কোনো ধরনের বৈষম্য, লুটতরাজ, চাকরি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি এসব থাকবে না। শুধু সংবিধানে নয়, বাস্তব ক্ষেত্রেও বিচার বিভাগ রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে বিচার করে জনগণের মৌলিক অধিকার আদায়ে তৎপর হবে। একটা গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে নতুন বাংলাদেশের অভু্যদয় হবে। প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি নৈতিক মানদন্ড নির্ধারণ করতে হবে। আইন এবং বিচারব্যবস্থা যেন নিরপেক্ষভাবে কাজ করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে, যাতে জনগণ সঠিক নেতৃত্ব বেছে নিতে পারে এবং প্রতিহিংসার রাজনীতির বিরুদ্ধে সচেতন থাকে। গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। দলমতনির্বিশেষে সবার মতামত শুনতে হবে এবং উপযুক্ত সময়ে ব্যক্তি ও দলগত স্বার্থ ত্যাগ করে জনগণের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবাইকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করতে দিতে হবে। কোনো ধরনের ফ্যাসিজম সৃষ্টি করা উচিত হবে না। তাছাড়া, নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রধান বাহন। তাই নির্বাচন হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। সাংবিধানিকভাবে সব ভোটার ভোট দেবেন এবং একজনের ভোট অন্যজন দেবে না। স্বচ্ছ নির্বাচন সঠিক সরকার গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তাই নির্বাচন হওয়া উচিত সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক। সমাজে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য রাজনীতিকে জনকল্যাণমুখী হতে হবে। ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে জনগণের জন্য কাজ করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা মতের ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু তা যেন কখনোই প্রতিহিংসার রূপ না নেয়। আমাদের প্রত্যাশা, রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতিহিংসার পথ পরিহার করবেন ও একটি শান্তিপূর্ণ, উন্নত, গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে কাজ করবেন। প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করার মধ্য দিয়েই সম্ভব আমাদের দেশকে একটি সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। হুমায়ুন আহমেদ নাইম : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়