গ্রিনল্যান্ড, পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বীপ। গত কয়েক বছরে বৈশ্বিক কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। সুমেরু অঞ্চলের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এই শ্বেত-শুভ্র ভূমি খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও, তা একদিকে যেমন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে, অন্যদিকে চ্যালেঞ্জ এবং বিতর্কের কারণও হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ড কেনার আগ্রহ প্রকাশ এবং সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি এই দ্বীপকে শুধু অর্থনৈতিক সম্পদের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
গ্রিনল্যান্ড তার বিপুল খনিজ সম্পদ নিয়ে বিশ্বব্যাপী আগ্রহের কেন্দ্র। সোনা, তামা, নিকেল এবং বিরল মৃত্তিকা ধাতু- সবই এই দ্বীপের পাহাড়ি এলাকা ও উপত্যকায় ছড়িয়ে রয়েছে। বিরল মৃত্তিকা ধাতু, যা মোবাইল ফোন, ব্যাটারি এবং বৈদু্যতিক মোটর তৈরিতে অপরিহার্য, গ্রিনল্যান্ডকে প্রযুক্তি-নির্ভর বিশ্ব অর্থনীতির একটি সম্ভাব্য শক্ত ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। দক্ষিণ গ্রিনল্যান্ডের একটি সোনার খনিতে গিয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদক দেখেছেন, কীভাবে খনিজ অনুসন্ধান চলছে। আমারক মিনারেলস নামের কোম্পানি, যারা ২০১৫ সালে এই খনির মালিকানা নিয়েছে, তাদের কার্যক্রম এখন নতুন গতি পেয়েছে। কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী এলডুর ওলাফসনের মতে, গ্রিনল্যান্ডের খনিজ সম্পদ এতটাই বিশাল যে, এটি শুধু পশ্চিমা দেশগুলোর চাহিদাই মেটাতে পারবে না, বরং আগামী কয়েক দশকের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ উৎস হতে পারে। এমনকি এত বিশাল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও এই অঞ্চলের বেশিরভাগ খনিজ সম্পদ এখনো অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে। খনিজ উত্তোলনের কাজে বিশেষায়িত মাত্র দু'টি সক্রিয় খনি আছে দ্বীপজুড়ে। অর্থাৎ, যে পরিমাণ সম্পদ এখানে লুকিয়ে আছে, তার বড় অংশই এখনো উন্মোচিত হয়নি।
গ্রিনল্যান্ড শুধু তার খনিজ সম্পদের জন্য নয়, বরং তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেও অত্যন্ত কৌশলগত। সুমেরু অঞ্চলে এই দ্বীপের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সম্পদ হতে পারে। চীন, বিশ্বের বিরল মৃত্তিকা ধাতুর সবচেয়ে বড় উৎপাদক, ইতোমধ্যে এই খাতে প্রভাব বিস্তার করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো এখন বিকল্প সরবরাহ নিশ্চিত করতে চাইছে। এই পরিস্থিতিতে গ্রিনল্যান্ড তাদের জন্য এক চমৎকার সুযোগ তৈরি করেছে। সম্প্রতি একটি রিপোর্টে উলেস্নখ করা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার একটি খনি কোম্পানিকে যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিয়েছে যেন গ্রিনল্যান্ডের বিরল মৃত্তিকা ধাতু চীনের কাছে বিক্রি না করা হয়। এটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত প্রভাবের কথাও স্পষ্ট করে।
গ্রিনল্যান্ডের খনিজ সম্পদের ভান্ডার যতই সমৃদ্ধ হোক, কার্যকরভাবে তা উত্তোলন করা সহজ নয়। দ্বীপটির ৮০ শতাংশই বরফের চাদরে ঢাকা। দুর্গম পর্বতমালা এবং রাস্তার অভাব পরিবহন ও কার্যক্রম পরিচালনায় বড় বাধা তৈরি করেছে। শুধু ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতাই নয়, পরিবেশগত বিধিনিষেধ এবং খনি পরিচালনার খরচের তুলনায় বিশ্ববাজারে ধাতুর মূল্য কম হওয়াও এই খাতের উন্নয়নকে ধীর করেছে। অনেক বিনিয়োগকারী প্রাথমিক উৎসাহ দেখালেও পরবর্তীতে পিছু হটেছেন। এ ছাড়া, খনির কাজ শুরু করতে প্রয়োজনীয় অনুমোদন পেতে দীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অগ্রগতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এখানে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো পরিবেশ রক্ষা। গ্রিনল্যান্ড জলবায়ু পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এবং যে কোনো বড় ধরনের খনন প্রকল্প পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। স্থানীয় সরকার তাই পরিবেশ রক্ষায় কঠোর নীতিমালা অনুসরণ করছে, যা কার্যক্রমের গতি কমিয়ে দিয়েছে।
গ্রিনল্যান্ডের খনিশিল্প স্থানীয় অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। খনিগুলোতে স্থানীয় জনগণের চাকরির সুযোগ তৈরি হয়েছে, পাশাপাশি বিদেশি কর্মীদের উপস্থিতি স্থানীয় ব্যবসার চাহিদা বাড়িয়েছে। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে একটি বড় অংশ মনে করে, খনিজ সম্পদ থেকে প্রাপ্ত লাভের সিংহভাগ বিদেশি কোম্পানিগুলোর পকেটেই চলে যায়। স্থানীয় শ্রমিক সংঘের প্রধান জেস বেরথেলসেনও এই বিষয়ে সতর্কতা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, খনি থেকে অর্জিত আয়ের খুব কমই স্থানীয় অর্থনীতিতে ফিরে আসে। যদিও তিনি চান এই খাত আরও প্রসারিত হোক, কারণ মাছ ধরা ছাড়াও অন্য কোনো উৎস থেকে আয়ের প্রয়োজন আছে। এদিকে, গ্রিনল্যান্ডের ব্যবসা ও কাঁচামাল বিষয়ক মন্ত্রী নাজা নাথানিয়েলসেন জানিয়েছেন, স্থানীয় জনগণ সাধারণত খনিশিল্পকে সমর্থন করে। তবে তিনি স্বীকার করেন, এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগ এখনো যথেষ্ট পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
গ্রিনল্যান্ডের রাজনীতিবিদদের জন্য খনিজ সম্পদ শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়, স্বাধীনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। দ্বীপটি বর্তমানে ডেনমার্ক সরকারের কাছ থেকে বার্ষিক ৬০ কোটি ডলার ভর্তুকি পায়, যা তাদের অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য। তবে গ্রিনল্যান্ডের বার্ষিক জিডিপি মাত্র ৩০০ কোটি ডলার। যদি খনিজ সম্পদ থেকে বড় আকারে রাজস্ব আয় করা যায়, তাহলে এই ভর্তুকির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে তারা স্বাধীনতার দিকে আরও একধাপ এগিয়ে যেতে পারবে। তবে এটি বাস্তবায়ন করতে হলে খনিজ শিল্পে দ্রম্নত অগ্রগতি এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন।
গ্রিনল্যান্ডের খনিজ সম্পদ নিয়ে বিশাল সম্ভাবনা থাকলেও তার পুরোপুরি বাস্তবায়ন সহজ নয়। মন্ত্রী নাজা নাথানিয়েলসেন আশা প্রকাশ করেছেন, আগামী দশকের মধ্যে আরও তিন থেকে পাঁচটি খনি চালু হবে। তবে খনিজ অনুসন্ধান এবং উত্তোলনে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, প্রশাসনিক জটিলতা, এবং পরিবেশগত প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হবে। পশ্চিমা দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান আগ্রহ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা গ্রিনল্যান্ডের খনিজ শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে। তবে চীনের প্রভাব এবং এই খাতে তাদের অংশগ্রহণ নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
গ্রিনল্যান্ড এক নতুন ভূরাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। এর খনিজ সম্পদের ভান্ডার শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই আনবে না, বরং এটি আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্য বদলে দিতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন টেকসই খনিজ শিল্প, যা স্থানীয় জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ রক্ষার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে। সঠিক কৌশল এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে গ্রিনল্যান্ড ভবিষ্যতে শুধু একটি অর্থনৈতিক শক্তি নয়, বরং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল : চিকিৎসক ও কলামিস্ট