শুকনো মৌসুমে তিস্তার বালুচরে পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি

বাংলাদেশ এবং ভারত দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। ভারতের এক তরফা মনোভাবের কারণে এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। অথচ সময় যত যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূ-রাজনৈতিক নানা সমস্যা বাড়ছে। বাংলাদেশের দুঃখ তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যা সমাধানে যত দেরি হবে, পরিস্থিতি তত জটিল হবে, ভূ-রাজনীতির হিসাব তত বাড়তে থাকবে।

প্রকাশ | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

শাহীন রাজা
ভরা বর্ষায় নদীর গর্জনে আতঙ্কে তিস্তা পাড়ের মানুষের ঘুম ভেঙে যেতো। মনে হতো নদীর গহিন জলে দানবেরা খেলা করছে। শুকনো মৌসুমেও ছিল, জল ভরা নদী। আজ সেই নদীর বুকে, শুধুই ধু-ধু বালুচর। নদীর বুকে পায়ে হেঁটে হয় পারাপার! পার হয় গাড়ি!! বর্ষা শেষে ধানের জমিতে জমা হতো পলি। ধানে, ধানে ধন্য ছিল তিস্তা পাড়ের মানুষ। পানি নেমে গেলে শুধু মাছ আর মাছ। আজ সবকিছুই অতীত কল্পকাহিনী। সুখস্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দ সবই নদীর মতোই শুকিয়ে ধু-ধু বালুর চর ! হিমালয়ের সাড়ে সাত হাজার ফুট উঁচুতে হিমবাহ থেকে নেমে আসে তিস্তার জল। উৎস থেকে ৩০০ কিলোমিটার এঁকেবেঁকে ঢুকেছিল বাংলাদেশে। দীর্ঘ তিস্তা, সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসে বাংলাদেশে। অতীতে তিস্তা নদীর তিনটি ধারা ছিল। এগুলো হচ্ছে- করতোয়া, আত্রেয়ী ও পুনর্ভবা। এই তিন ধারার মিলিত নাম ত্রিস্রোতা। এর অপভ্রংশ হচ্ছে- বর্তমান তিস্তা। হিমালয় থেকে বাংলাদেশে আসার পথে সিকিমে পানি আটকে জলবিদু্যৎ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে পানি আটকে কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও তিস্তার পানি উত্তোলন করে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যার ফলে, শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশে পানি আসে খুবই সামান্য। বাংলাদেশের সাত লাখ হেক্টর আবাদি জমি তিস্তার জলকণা থেকে প্রতি বছর বঞ্চিত হচ্ছে। আবার বর্ষা মৌসুমে প্রচুর বৃষ্টিপাতে হিমালয় থেকে পানির ঢল নামে। ভারত এই পানি আর ধরে রাখতে পারে না। ধরে রাখতে গেলে কয়েকটি রাজ্য তিস্তার পানিতে পস্নাবিত হয়ে যায়। এ সময় ব্যারেজের সবকয়টা গেট খুলে দেয়া হয় এবং বাংলাদেশের বিশাল অঞ্চল পস্নাবিত হয়ে যায়। তিস্তা এখন বাংলাদেশের জন্য দুঃখ হয়ে দেখা দিয়েছে! বাংলাদেশ এবং ভারত দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। ভারতের এক তরফা মনোভাবের কারণে এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। অথচ সময় যত যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূ-রাজনৈতিক নানা সমস্যা বাড়ছে। বাংলাদেশের দুঃখ তিস্তার পানিবন্টন সমস্যা সমাধানে যত দেরি হবে, পরিস্থিতি তত জটিল হবে, ভূ-রাজনীতির হিসাব তত বাড়তে থাকবে। এই সমস্যা সমাধানে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) গঠন করে। সেচ, বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পানিসম্পদ ভাগাভাগির মতো বিষয়গুলো নিয়ে কারিগরি পর্যায়ে আলোচনাই ছিল এটির মূল উদ্দেশ্য। ১৯৭২ সালের মার্চে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী, সহযোগিতা এবং শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে গঠিত হয় জেআরসি। জেআরসির কার্যপদ্ধতি (রুলস অব প্রসিডিউর) অনুসারে, বছরে চারটি সভা করার কথা এই সংস্থাটির। অর্থাৎ গত ৫২ বছরে ২০৮টি জেআরসির বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে দু'দেশের কারিগরি এই কমিশনের সর্বোচ্চ ৩৮টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবেশি দেশ ভারত তিস্তা নদী পানির হিস্যা নিয়ে কখনোই আন্তরিক নয়। অথচ দুই বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইউরোপে প্রবাহমান দানিয়ুব নদীর পানি নিয়ে আন্তঃদেশীয় দেশগুলোর মধ্যে কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। এক মিনিটের জন্যও পানি প্রবাহে উজানের দেশ প্রতিশোধপরায়ণ হয়নি। এমনকি ইরান এবং ইরাকের মধ্যে আট বছর যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু একদিনের জন্যও দজলা-ফোরাতের পানি প্রবাহ বন্ধ হয়নি। অথচ ভারত বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও বিষয়টি সম্পর্কে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়নি। বরঞ্চ তিস্তা এবং গঙ্গার পানি ভারত সব সময় রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। দুই দেশের মধ্যে প্রবাহিত নদীর পানি সমস্যা সমাধানে কখনোই আন্তরিক নয়। ভারত হয়তো জানে না এই বিষয়গুলো বাংলাদেশের মানুষকে বিক্ষুব্ধ করছে এবং ভারতবিরোধী হয়ে উঠছে! শাহীন রাজা :হেড অব এডিটোরিয়াল, মোহনা টেলিভিশন