বাঙালির ভাষাপ্রেম ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

ভাষা একটি জাতির নিজস্ব গৌরব। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভাষা সচেতনতার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। সমস্যা হচ্ছে, নতুন প্রজন্ম না বাংলা না ইংরেজি কোনো ভাষাই ভালোভাবে শিখছে না। তারা বাংলার সঙ্গে ইংরেজি-হিন্দি মিশিয়ে এক জগাখিচুড়ি ভাষার জন্ম দিচ্ছে। এতে ভাষার বিকৃতি ঘটছে চরমভাবে।

প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

বীরেন মুখার্জী
'মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা!/ তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!'- প্রখ্যাত গীতিকার ও সুরকার অতুলপ্রসাদ সেনের এই গানটি ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। গানের শব্দগুলোর মধ্যে বাংলা ভাষা নিয়ে বাঙালি জাতির আবেগ, ভালোবাসা, দেশপ্রেম, ভাষাপ্রেম সর্বোপরি প্রাণের স্ফূরণ লক্ষ্য করা যায়। ভাষার প্রতি এই 'প্রেম' বাঙালিকে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে টিকিয়ে রেখেছে। ফলে, ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বুকের তাজা রক্ত ঝরাতেও পিছপা হয়নি বাঙালি। বাঙালি জাতি ছাড়া বিশ্বের আর কোনো জাতিকে তার নিজের ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়নি, অকাতরে বিলিয়েও দিতে হয়নি জীবন। বস্তুত 'ভাষাপ্রেম' ও ভাষা-সংগ্রামের 'জয়টিকা' পরবর্তী সময়ে সংঘটিত নানা আন্দোলন-সংগ্রামে বাঙালিকে প্রেরণা জুগিয়েছে, শক্তি ও সাহসে বলীয়ান করেছে, করেছে আত্মবিশ্বাসী। ভাষা-আন্দোলনে বিজয়ের সূত্র ধরেই এ জাতি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সংঘটিত এক অসম যুদ্ধেও ছিনিয়ে আনে বিজয়। মহান এই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে ঠাঁই পায় নিজস্ব ভূ-খন্ড, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। যদিও স্বাধীনতার স্বাদ পেতে, সগৌরবে লাল-সবুজের পতাকা তুলে ধরতে বাঙালিকে অকাতরে জীবন দিতে হয়েছে। মূলত এ দুটি আন্দোলনের বিজয় পুরো জাতিকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে অনেক কিছু। এর একটি হলো, বাংলা অক্ষরের মহাসম্মিলন 'বইমেলা'। এ প্রসঙ্গে একটু পেছন ফিরে দেখা যেতে পারে। তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় সফরে এসে ঘোষণা করেন, 'একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।' সেদিন 'নো নো' ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করেছিল এ দেশের ছাত্র-যুবক। এরপর নানা সংগ্রাম-আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। একুশ বাঙালিকে এমনই সাহসী করে তোলে যে, এরপর বলা হতে থাকে- 'একুশ মানে মাথা নত না করা।' 'বাংলাভাষা' হাজার বছরের সমৃদ্ধ একটি ভাষা। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশের মতো লেখক সৃষ্টি হয়েছে এই ভাষায়ই। কিন্তু সেই বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় পরবর্তী সময়ে তেমন কোনো উদ্যোগ কি নেওয়া হয়েছে? এটা ঠিক যে, সময়ের অভিঘাতে পাল্টে যেতে চায় সবকিছু। বিদেশি ভাষার আগ্রাসন ও প্রযুক্তিনির্ভর এই সময়ে তরুণ প্রজন্মকেও দেখা যায় বাংলা ভাষার প্রতি চরম উদাসীন। যদিও অন্য ভাষা শেখায় কোনো দোষ নেই। রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় নিয়ে বলতে হয়- 'আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি পরে ইংরেজি শেখার পত্তন।' মাতৃভাষা ভালো করে না জানলে কোনো ভাষায়ই দক্ষতা অর্জন করা যায় না। ফলে, যে চেতনাকে ধারণ করে ভাষা আন্দোলন, তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে স্বাধীনতার এত বছরে, সঙ্গত কারণেই এ প্রশ্নও অমূলক নয়। ভাষা একটি জাতির নিজস্ব গৌরব। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভাষা সচেতনতার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। সমস্যা হচ্ছে নতুন প্রজন্ম না বাংলা না ইংরেজি কোনো ভাষাই ভালোভাবে শিখছে না। তারা বাংলার সঙ্গে ইংরেজি-হিন্দি মিশিয়ে এক জগাখিচুড়ি ভাষার জন্ম দিচ্ছে। এতে ভাষা বিকৃতি ঘটছে চরমভাবে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। ফেসবুক-ইন্টারনেটে যোগাযোগের ক্ষেত্রে জন্ম নিচ্ছে এক অদ্ভুত ভাষা। রোমান হরফে বাংলা লেখা হচ্ছে। সেই বাংলার ধরনও বিচিত্র। এটা ঠিক যে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, কিন্তু নিজস্ব সত্তা বিসর্জন দিয়ে স্রোতে গা ভাসালে তা হবে আত্মবিনাশের দিকে যাওয়া। ফলে, এই বিনাশের পথ থেকে সবাইকে ফিরে আসতে হবে। লেখায়, বলায়, পঠনে-পাঠনে সর্বত্র বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে মর্যাদার আসনে। মনে রাখা দরকার, মাতৃভাষা বোধের সঙ্গে বাঙালির চেতনা ও আবেগ জড়িত। বাঙালির যত আন্দোলন-সংগ্রাম, ইতিহাস-ঐতিহ্য সবই সৃষ্টি হয়েছে সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়ে। ফলে, ভাষা আন্দোলনের মর্যাদা রক্ষায় চেতনার জায়গাটিতে সবাইকে শাণিত থাকতে হবে। একুশ তখনই সার্থক হবে, যখন প্রতিটি জনগোষ্ঠী তার নিজের মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারবে। নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা লাভ করতে পারবে। শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবে। মনে রাখতে হবে, বাংলা ভাষা প্রচলনে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে যত বেশি দীর্ঘসূত্রতা হবে, ততই পিছিয়ে যাবে সর্বস্তরে বাংলাভাষার প্রয়োগ। এর ফলে, ব্যাহত হবে বাংলাদেশে টেকসই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন। ভাষা চেতনার মাসে এই বোধ সবার মধ্যে জেগে উঠুক এই প্রত্যাশা। বীরেন মুখার্জী : কবি, প্রাবন্ধিক ও সংবাদকর্মী