গণতন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে আধুনিক বিশ্বের অন্যতম আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। জনগণের ক্ষমতায়ন, বাকস্বাধীনতা, সুশাসনের প্রতীক হিসেবে গণতন্ত্র বিশ্বব্যাপী প্রসারিত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এটি নানা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উত্থান, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন ও রাজনৈতিক দুর্নীতির বিস্তার গণতন্ত্রের স্থায়িত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তবুও, গণতন্ত্র রক্ষার জন্য নানাবিধ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে- যা এই সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
গণতন্ত্রের বর্তমান পরিস্থিতি: বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অনেক দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফ্রিডম হাউস এবং ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাম্প্রতিক দশকে অনেক দেশে গণতান্ত্রিক সূচক নিম্নমুখী। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রাজিল, তুরস্ক, হাঙ্গেরি এবং ফিলিপাইনের মতো দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নত বিশ্বেও গণতন্ত্রের অবক্ষয় লক্ষণীয়। পশ্চিমা বিশ্বে চরমপন্থি জাতীয়তাবাদ, বিভেদমূলক রাজনীতি এবং তথ্য বিকৃতির ফলে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক দেশেই বিরোধী দল ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে- যা গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিকে দুর্বল করছে।
গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি:গণতন্ত্রের জন্য প্রধান হুমকিগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বেশ কিছু বিষয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তিকে নড়বড়ে করে তুলছে।
১. স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের উত্থান: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক দেশে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পুনরুত্থান ঘটছে। বিশেষ করে রাশিয়া, চীন, তুরস্ক, হাঙ্গেরি, এবং ভেনেজুয়েলার মতো দেশগুলোতে একনায়কতন্ত্র শক্তিশালী হচ্ছে। এসব দেশে বিরোধী মত দমন করা হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত করা হচ্ছে। নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করা হচ্ছে।
২. রাজনৈতিক দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার: দুর্নীতি গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান শত্রম্ন। অনেক দেশে রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করছেন। তারা দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করছেন, বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছেন এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ঘটাচ্ছেন। এই ধরনের দুর্নীতি গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে।
৩. মিডিয়ার স্বাধীনতা সংকোচন: মুক্ত গণমাধ্যম গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ। কিন্তু অনেক দেশে সরকার ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন, সংবাদপত্র বন্ধ করা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেন্সরশিপ আরোপের ফলে জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকার খর্ব হচ্ছে।
৪. ভুয়া তথ্য ও ভুল প্রচারণা: ডিজিটাল যুগে ভুয়া তথ্য এবং ভুল প্রচারণা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে- যা জনমতকে প্রভাবিত করছে। রাজনৈতিক দল ও স্বার্থান্বেষীগোষ্ঠী মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
৫. নির্বাচনী অনিয়ম: অনেক দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হচ্ছে না। ভোট কারচুপি, বিরোধী প্রার্থীদের দমন এবং ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন গণতন্ত্রকে দুর্বল করে তুলছে। বিশেষ করে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এই অনিয়ম বেশি পরিলক্ষিত হয়।
গণতন্ত্র রক্ষার উপায়: গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জনগণের অংশগ্রহণ, আইনগত সংস্কার এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
১. স্বচ্ছ ও স্বাধীন নির্বাচন নিশ্চিত করা: অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। এজন্য স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, শক্তিশালী আইন এবং জনগণের সচেতনতা জরুরি। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা হলে নির্বাচনী অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হবে।
২. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা: গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে সাংবাদিকদের সুরক্ষা দিতে হবে। সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ কমাতে হবে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুল তথ্য প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ: রাজনৈতিক দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে কার্যকর আইনি কাঠামো দরকার। স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হলে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাগুলোর স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে।
৪. নাগরিক সমাজ ও যুবসমাজের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি: গণতন্ত্র রক্ষায় নাগরিক সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতি ও সামাজিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে হবে। তারা যাতে সঠিক তথ্য পায় এবং দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে, সেজন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক চেতনা বৃদ্ধি করা জরুরি।
৫. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি: বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক সংস্থা যেন স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
৬. মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা: মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি। বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, নাগরিক অধিকার রক্ষা করা এবং সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়া হলে গণতন্ত্র আরও সুসংহত হবে।
গণতন্ত্র শুধু একটি শাসনব্যবস্থা নয়, এটি একটি জীবনধারা। এটি জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রতীক। তবে, বর্তমান সময়ে গণতন্ত্র নানা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে- যা বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই হুমকিগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি। সুষ্ঠু নির্বাচন, স্বচ্ছ সরকার, মুক্ত গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য নাগরিক সচেতনতা এবং বৈশ্বিক সংহতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নুরুলস্নাহ আলম নুর :শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়