পরিবেশগত অপরাধ কতটা প্রাধান্য পাচ্ছে?

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিবেশগত অপরাধের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অপরাধী চক্র যেন পার পেয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রেখে বিদ্যমান আইনকে যুগোপযোগী করে তোলা প্রয়োজন। এর জন্য সংশ্নিষ্ট অধিদপ্তর কিংবা সংস্থাগুলোকে স্বচ্ছ ও আরও কার্যকর হতে হবে।

প্রকাশ | ০১ মার্চ ২০২৫, ০০:০০

আসিফ আল মাহমুদ
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পরিবেশগত অপরাধ এখন গোটা বিশ্বে আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে! বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্তি, বনভূমি নিধন, মাটি-পানি-বায়ুদূষণ দিনকে দিন ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে- যার পেছনের গল্প মূলত পরিবেশ অপরাধ! এসব অপরাধ বস্তুত সামগ্রিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য অথবা প্রাকৃতিক সম্পদ-কেন্দ্রিক হতে পারে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন যেমন- জি-৮, ইন্টারপোল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘের পরিবেশ প্রোগ্রাম, জাতিসংঘের আন্তঃদেশীয় অপরাধ ও বিচার গবেষণা ইনস্টিটিউটগুলো পরিবেশ অপরাধকে বিভিন্নভাবে নির্ধারণ করেছে। বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদের বিপন্ন প্রজাতির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কিত কনভেনশনের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে বিভিন্ন জীবজন্তু পাচার কিংবা বাণিজ্য করা একটি গুরুতর অপরাধ! 'মন্ট্রিল প্রটোকল' উপেক্ষা করে ওজন স্তর ক্ষয়কারী পদার্থ পাচার কিংবা ১৯৮৮ সালের 'বাসেল কনভেনশন' অমান্য করে বিপজ্জনক বর্জ্য নিষ্কাশন অথবা পাচার উভয়ই পরিবেশগত অপরাধ। একইভাবে বন থেকে অবৈধ তরিকায় কাঠ সংগ্রহের মাধ্যমে বনভূমি ধ্বংস কিংবা জলাশয় থেকে অধিক মাছ আহরণ করে মাছের প্রজাতি বিপন্ন করে তোলা, সবকিছুই পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং পরিবেশগত অপরাধের আওতায় পড়ে! বিশ্বব্যাপী সংঘটিত অপরাধের প্রায় এক তৃতীয়াংশ হয়ে থাকে পরিবেশের বিরুদ্ধে এবং কথিত এসব অপরাধের পেছনে থাকে বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্র! পরিবেশ অপরাধের অধিকাংশই সংঘটিত হয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে! পরিবেশগত অপরাধ জাতীয়, আঞ্চলিক কিংবা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও ঘটতে পারে! আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্র বিভিন্ন বন্যপ্রাণী হত্যা, পাচার, বনের গাছ কেটে উজাড় করা, অবৈধভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণসহ বিবিধ অপরাধ কর্মে যুক্ত থাকে! ইন্টারপোল এবং জাতিসংঘের পরিবেশ সংরক্ষণ প্রোগ্রামের (ইউএনইপি)-এর তথ্যমতে, এসব অপরাধজনিত ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে এবং এর অর্ধেকটাই হচ্ছে অবৈধ কাঠ পাচার ও বৃক্ষ নিধনের কারণে! বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে প্রতিনিয়তই বাড়ছে পরিবেশ অপরাধ! তন্মধ্যে বনভূমি উজাড়, কৃষি জমির পরিবর্তন এবং জলাভূমির অবক্ষয় ও মৎস্যসম্পদের যথেচ্ছ আহরণ, বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন, সুরক্ষিত অঞ্চলগুলোর অবক্ষয়, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানি প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করা ইত্যাদি অন্যতম। সীমাবদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থা স্বাভাবিকভাবেই আশঙ্কাজনক! সারাদেশে মাটি, পানি, বাতাসের সীমাহীন দূষণের কারণে টেকসই উন্নয়ন এখন অনেকাংশেই চ্যালেঞ্জের সন্মুখীন! উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বিশ্বব্যাপী দ্রম্নতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে কলকারখানা ও যানবাহনের সংখ্যা, আর সেইসঙ্গে বাড়ছে বায়ুদূষণ! উন্নত রাষ্ট্রগুলো শিল্পকারখানা কিংবা যানবাহন থেকে নির্গমনের মান নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও, অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য- যা হয়তো আদৌ সম্ভব নয়! যেখানে দেশের সংবিধান নাগরিকের 'জীবনের অধিকার'কে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেখানে সুস্বাস্থ্যের জন্য নির্মল বায়ু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মাত্রা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সব সময়ই বেশি থাকে! পরিবেশগত অপরাধ এবং এর নেতিবাচক তথা ক্ষতিকর দিকগুলো ব্যাখ্যায় জটিলতার কারণে অনেক সময় বিচারিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। পরিবেশগত অপরাধ দমনে জাতীয়, আঞ্চলিক কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যথেষ্ট আইন-বিধি-নীতিমালা থাকলেও, এর যথাযথ প্রয়োগের অভাব রয়েছে! তাছাড়া, পরিবেশগত অপরাধের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করার বিষয়ে অনীহার কথাও বলছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও কর্মীরা! দিন দিন পরিবেশ অপরাধের পরিমাণ বাড়ছে, পাল্টাচ্ছে এর ধরন! বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য পরিবেশ সুরক্ষার কথা বলা হলেও, ক্রমবর্ধমান পরিবেশ অপরাধ এবং তা দমনে ঢিলেঢালা পদক্ষেপের দরুন টেকসই উন্নয়ন অধরাই থেকে যাচ্ছে! পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিবেশগত অপরাধের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অপরাধী চক্র যেন পার পেয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রেখে বিদ্যমান আইনকে যুগোপযোগী করে তোলা প্রয়োজন। এর জন্য সংশ্নিষ্ট অধিদপ্তর কিংবা সংস্থাগুলোকে স্বচ্ছ ও আরও কার্যকর হতে হবে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পরিবেশ আদালত থাকলেও, সেটি কতটা কার্যকর সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। পরিবেশ অপরাধ সম্পর্কে জনসাধারণকে পর্যাপ্ত ধারণা দেওয়া এবং তা প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা আবশ্যক। কেননা, পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিপর্যস্ত হলে বিপন্ন হবে জীবন! তাই পরিবেশের বিরুদ্ধে সংঘটিত সংঘবদ্ধ অপরাধ বন্ধে এখনই সোচ্চার হতে হবে! আসিফ আল মাহমুদ : ফ্রিল্যান্স রাইটার, নবীন কলাম লেখক ধংরভসধযসড়ড়ফ১৭১৮১৯@মসধরষ.পড়স