অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় হলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি ইতিহাসবেত্তা ও সমাজকর্মী। মানবিক জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়, বিশেষ করে ইতিহাস, সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি, চিত্রকলা এবং প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে তার উলেস্নখযোগ্য অবদান রয়েছে। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ১৮৬১ সালের ১ মার্চ কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পড়াশোনায় হাতেখড়ি ঘটে হরিনাথ মজুমদারের কাছে। দশ বছর বয়সে মৈত্রেয় রাজশাহীতে তার বাবার কাছে চলে যান। মৈত্রেয় রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থকে ১৮৭৮ সালে এনট্রান্স পাস করেন এবং ১৮৮০ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে এফএ পাস করেন। ১৮৮৩ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ এবং ১৮৮৬ সালে আবার রাজশাহী কলেজ থেকে বিএল পাস করেন। একই বছর তিনি রাজশাহীতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। অক্ষয়কুমার ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করতেন। বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্যে তিনি পন্ডিত ছিলেন। উভয় সাহিত্য নিয়েই তিনি অনেক সুলিখিত প্রবন্ধ রচনা করেন। তবে অক্ষয়কুমারের মূল আগ্রহের বিষয় ছিল ইতিহাস। নিজ দেশের ইতিহাস রচনার গুরুত্ব তিনি প্রথম উপলব্ধি করেন এফএ শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন সময়ে। তিনি ধারাবাহিকভাবে ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ লেখার সিদ্ধান্ত নেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি দীর্ঘকাল ধরে সাহিত্য ও প্রত্নতত্ত্ব- এ দুই উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস, শিল্পকলা ও পটশিল্প সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন। ১৮৯৯ সালে সিরাজউদ্দৌলা, মীর কাসিম, রানী ভবানী, সীতারাম, ফিরিঙ্গি বণিক প্রমুখ ব্যক্তিকে নিয়ে ইতিহাস বিষয়ক প্রথম বাংলা ত্রৈমাসিক পত্রিকা ঐতিহাসিক চিত্র প্রকাশ করেন। এছাড়া, তিনি বঙ্গদর্শন, সাহিত্য, প্রবাসী বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। তিনি বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ঐতিহাসিক গুরুত্বযুক্ত স্থান, শিল্পকলা ও পটশিল্প সম্পর্কে তথ্যবহুল নিবন্ধ প্রকাশ করেন। ১৯১২ সালে প্রকাশিত গৌড়লেখমালা নামের বইতে তিনি পাল রাজবংশের তাম্রশাসন ও শিলালিপি বাংলায় অনুবাদ ও সম্পাদনা করে প্রাচীন ব্রহ্মদেশের অজানা ইতিহাস তুলে ধরেন এবং এভাবে বাংলা ভাষায় ঐতিহাসিক গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচন করেন। তিনি ১৯০৪ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি এবং ১৯১১ সালে বিশিষ্ট সদস্য নির্বাচিত হন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে আধুনিক বাংলা লেখকদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় গণ্য করতেন। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুসন্ধানের জন্য সফরে যান। যেখানে তিনি বহু প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণ, কাহিনী ও লোককথা সংগ্রহ করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে দিঘাপতিয়া রাজ পরিবারের কুমার শরৎকুমার রায়, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও জনৈক স্কুল শিক্ষক রমাপ্রসাদ চন্দ গবেষণা ও প্রাচীন নিদর্শনাদি সম্বন্ধে অভিন্ন আগ্রহের কারণে মিলিত হন। বাংলার এবং বরেন্দ্র অঞ্চলের গৌরবময় অতীত সম্পর্কে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণাকে উৎসাহিত করার জন্য তারা বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। রাজশাহীর সন্নিহিত এলাকায় সফরকালে উদ্ধার করা প্রত্ননিদর্শন সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের লক্ষ্যে তারা ১৯১০ সালের এপ্রিলে রাজশাহী জাদুঘর (বর্তমান বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর) প্রতিষ্ঠা করেন। অক্ষয়কুমার ১৮৯৭ সালে রাজশাহী রেশম-শিল্প বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ১৯৩০ সালের ১০ ফেব্রম্নয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।