উৎসব এলেই ছদ্মবেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহন

ফিটনেসবিহীন যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা শুধু একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য করলেই চলবে না, বরং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হওয়া উচিত। জনগণের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং একটি সুষ্ঠু ও আধুনিক সড়ক পরিবহণব্যবস্থা গড়ে তুলতে এখনই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এতে শুধু উৎসবের সময় নয়, বরং সারাবছরজুড়ে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা নিরাপদ, কার্যকর ও জনবান্ধব হয়ে উঠবে।

প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০২৫, ০০:০০

সেলিম রানা
প্রতিটি উৎসবের মৌসুমে একই চিত্র বারবার ফুটে ওঠে। পুরনো, অনুপযুক্ত ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন মহাসড়কে নেমে আসে। মালিকপক্ষ যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে বাহ্যিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য রংচটা বাসগুলোকে নতুন রঙে রাঙিয়ে, আসনের কাপড় পরিবর্তন করে এবং বাহ্যিকভাবে সাজিয়ে তুললেও ভেতরে এগুলোর অবস্থার অবনতি ঘটে চলেছে। একটি উন্নত ও নিরাপদ পরিবহণব্যবস্থা যে কোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। বাংলাদেশ একটি জনবহুল ও ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশ। দিন দিন তার যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের চেষ্টা করা হলেও, এখনো অনেক ক্ষেত্রেই নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে উৎসবের সময়, যেমন রমজানের ঈদ, কোরবানির ঈদ, দুর্গাপূজা বা পহেলা বৈশাখের মতো বৃহৎ উৎসবগুলোর প্রাক্কালে দেশের সড়ক ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা চরম আকার ধারণ করে। এসব সময় বিপুল সংখ্যক মানুষ নিজ গ্রামের বাড়িতে ফেরার জন্য যাত্রীবাহী পরিবহণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বহু পরিবহণ মালিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ফিটনেসবিহীন, পুরনো ও অনুপযুক্ত যানবাহনকে পুনরায় রাস্তায় নামিয়ে দেন, যা পরবর্তীতে ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এসব যানবাহনের মধ্যে অধিকাংশই দীর্ঘদিন ধরে অচল অবস্থায় পড়ে থাকলেও ঈদ ও অন্যান্য উৎসব সামনে রেখে এগুলোকে সাময়িকভাবে সংস্কার করা হয়। বাহ্যিকভাবে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য গাড়ির বাইরের রঙ পরিবর্তন করা হয়, অভ্যন্তরীণ সিটকভার বদলে ফেলা হয় এবং কখনো কখনো আলোকসজ্জাও যোগ করা হয়। কিন্তু মূলত এইসব যানবাহনের ইঞ্জিন, ব্রেক, চাকা, চেসিস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ যান্ত্রিক অংশ অধিকাংশ সময় অনুপযুক্ত থাকে। ফলে চালু করার পরই এগুলো কালো ধোঁয়া নির্গমন করে, বিকট শব্দ তৈরি করে এবং মাঝপথেই বিকল হয়ে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, এসব যানবাহনের অধিকাংশ চালকই অনভিজ্ঞ বা অস্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত। ফলে তারা ট্রাফিক আইন সম্পর্কে যথাযথভাবে অবগত থাকেন না এবং সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ব্যর্থ হন। যাত্রীদের বড় একটি অংশ, বিশেষত গ্রামের সাধারণ মানুষ, যানবাহনের ফিটনেস সম্পর্কে সচেতন নন। তারা কম খরচে ও দ্রম্নত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর লোভে এসব ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনে উঠতে বাধ্য হন। এতে তারা নিজেদের জীবনকেই ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছেন। তাছাড়া, এসব ফিটনেসবিহীন যানবাহন যখন শহরে প্রবেশ করে, তখন শহরের ব্যস্ততম সড়কগুলোতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এসব যানবাহনের চালকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ট্রাফিক সংকেত মানতে ব্যর্থ হন, অনিয়ন্ত্রিতভাবে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করেন এবং উল্টোপথে চলাচল করে যানজটের সৃষ্টি করেন। বর্তমানে বাংলাদেশের বেশিরভাগ শহরের প্রধান মহাসড়কগুলোতেই অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে, যার ফলে যানজটের মাত্রা এমনিতেই বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে যদি উৎসবকেন্দ্রিক ফিটনেসবিহীন যানবাহনের চাপযুক্ত হয়, তাহলে যানজট ভয়াবহ রূপ নেয়। শহরের রাস্তাগুলোতে যখন এই পুরনো ও অনুপযুক্ত যানবাহন চলাচল করে, তখন তা শুধু যানজটই বাড়ায় না, বরং পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি করে। বিশেষত, এসব যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। যেসব মানুষ প্রতিদিন দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থাকেন, তারা শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হন। এমন পরিস্থিতিতে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল রোধ করা একান্ত প্রয়োজন। সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিআরটিএসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি চালাতে হবে এবং কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি, জনগণের মধ্যেও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার চালানো জরুরি। কম খরচ ও দ্রম্নত যাতায়াতের আশায় কেউ যাতে ফিটনেসবিহীন যানবাহনে উঠতে বাধ্য না হন, সেজন্য নিরাপদ ও বিকল্প পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো প্রয়োজন। ফিটনেসবিহীন যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা শুধু একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য করলেই চলবে না, বরং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হওয়া উচিত। জনগণের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং একটি সুষ্ঠু ও আধুনিক সড়ক পরিবহণব্যবস্থা গড়ে তুলতে এখনই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এতে শুধু উৎসবের সময় নয়, বরং সারাবছরজুড়ে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা নিরাপদ, কার্যকর ও জনবান্ধব হয়ে উঠবে। পরিবহণ খাতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা, মালিকপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট অন্যরা প্রায়শই অতিরিক্ত মুনাফার কথা চিন্তা করে উৎসবের সময় অনুপযুক্ত ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন রাস্তায় নামিয়ে দেয়। এতে সাময়িক লাভ হলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি ভয়াবহ সামাজিক ও মানবিক সংকট সৃষ্টি করে। একটি দুর্ঘটনার কারণে শুধু নির্দিষ্ট একটি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, বরং সমগ্র সমাজের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যে পরিবার দুর্ঘটনায় একজন প্রিয়জনকে হারায়, তারা সারাজীবন সেই ক্ষতি বহন করে যেতে বাধ্য হয়। বিশেষত, পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যদি দুর্ঘটনায় মারা যান বা পঙ্গু হয়ে যান, তাহলে সেই পরিবারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। একদিকে অর্থনৈতিক সংকট, অন্যদিকে মানসিক ও সামাজিক অবস্থা একেবারে দুর্বল হয়ে যায়। অনেক সময় এমন দুর্ঘটনার শিকার পরিবারের শিশুদের শিক্ষা বন্ধ হয়ে যায়, তাদের জীবনযাত্রার মান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অবস্থায় পরিবহণ মালিক ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে মানবিক চিন্তা করতে হবে। শুধু অর্থনৈতিক লাভ নয়, বরং যাত্রীদের নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু পরিবহণব্যবস্থার উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। যথাযথভাবে যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা, দক্ষ চালক নিয়োগ, ট্রাফিক আইন মেনে চলা এবং নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই হবে একটি সুসংগঠিত ও উন্নত পরিবহণব্যবস্থার মূল চাবিকাঠি। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পরিবহণ সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি, সাধারণ জনগণেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন, যাতে তারা ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনে যাতায়াত না করেন এবং নিরাপদ পরিবহণব্যবস্থার দাবিতে সোচ্চার হন। উন্নত, নিরাপদ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সবারই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন, বিশেষ করে সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনোভাবেই মানবিক দৃষ্টি বা অনৈতিক লাভের আশায় ফিটনেসবিহীন যানবাহনকে মহাসড়কে চলাচলের অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। কারণ এ ধরনের ছাড় বা গাফিলতি শুধু সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে না, বরং এটি ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যা অসংখ্য প্রাণহানির পাশাপাশি পরিবার ও সমাজের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিটি দপ্তর যেমন বিআরটিএ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, পরিবহণ মালিক সমিতি ও শ্রমিক সংগঠনগুলোরও সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। শুধু নিয়মিত চেকিং বা জরিমানা আদায় করলেই চলবে না, বরং ফিটনেসবিহীন যানবাহন চিহ্নিত করে সেগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ ও অনুপযুক্ত যানবাহনের স্থায়ীভাবে ধ্বংস বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য কোনো বিকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার, যাতে সেগুলো কোনোভাবেই সড়কে ফিরে না আসে। সরকারকে অবশ্যই একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের চলাচল রোধে শক্তিশালী আইনি কাঠামো নিশ্চিত করা হবে। একইসঙ্গে যাত্রীসাধারণকেও সচেতন হতে হবে, যাতে তারা ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনে যাতায়াত না করেন এবং ফিটনেসবিহীন পরিবহণব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে এ বিষয়ে কোনো আপস করা চলবে না। সরকারের কঠোর মনোভাব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঠিক প্রয়োগ, পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকদের দায়িত্বশীলতা এবং সাধারণ জনগণের সচেতনতা এসবের সম্মিলিত প্রয়াসেই সম্ভব একটি সুষ্ঠু ও নিরাপদ সড়ক পরিবহণব্যবস্থা গড়ে তোলা। সেলিম রানা : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট