রাষ্ট্র উন্নয়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু দেশের সুরক্ষায় নয়, যুদ্ধপরবর্তী সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সময়ের পরিক্রমায় রাষ্ট্রের বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অবকাঠামো নির্মাণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। তাদের পরিকল্পনা, দক্ষতা এবং সময়মতো কাজ সম্পন্ন করার ক্ষমতা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে রাখছে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা।
প্রকাশ | ১১ মার্চ ২০২৫, ০০:০০
কর্নেল মোহাম্মদ মেহেদী হাসান
'সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে'- এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কেবল দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অবকাঠামো উন্নয়ন, দুর্যোগ মোকাবিলা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠায়ও উলেস্নখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বীরত্বগাথা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এই যুদ্ধে অনেক সেনাসদস্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তারা স্বাধীনতার জন্য শত্রম্নর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা, প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সমন্বয়ের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। মুক্তির সংগ্রামে শত্রম্নর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাংলাদেশের সেনা সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ কৌশল এবং অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। যুদ্ধের কৌশল হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে বিভিন্ন সামরিক কর্মকর্তাকে কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। পরবর্তী সময়ে মেজর জিয়া, মেজর খালেদ ও মেজর শফিউলস্নাহর নেতৃত্বে 'জেড ফোর্স', 'কে ফোর্স' ও 'এস ফোর্স' নামে তিনটি নিয়মিত ব্রিগেড গঠনের মাধ্যমে আক্রমণ আরো জোরালো হয়। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে গেরিলা যোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি এবং সরবরাহ লাইনগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে তাদের দুর্বল করে দেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সেনা কর্মকর্তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর অনেক ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়, আর আমরা স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে আত্মপ্রকাশ করি।
যুদ্ধপরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধকালীন ধ্বংসযজ্ঞে ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো এবং অর্থনীতি পুনর্গঠন ও সংস্কার করা ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শেষে একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে পুনর্গঠন করতে গেলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামো পুনর্গঠন, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি পেশাদার বাহিনী গড়ে তোলার জন্য সেনাবাহিনী অসাধারণ অবদান রাখে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাদের সমন্বয়ে নতুন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠন করা হয়। তাছাড়া, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে অনেক দক্ষ ও সাহসী যোদ্ধাকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে জনগণের পুনর্বাসনে শরণার্থী শিবির পরিচালনা এবং খাদ্য ও আশ্রয় নিশ্চিত করা ছিল একটি অতি জরুরি কাজ। যুদ্ধ শেষে শরণার্থীদের পুনর্বাসনে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ক্যাম্প তৈরি, খাদ্য সরবরাহ, চিকিৎসা প্রদানসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। যুদ্ধের সময় অনেক সেতু, রাস্তা, রেলপথ এবং অন্যান্য অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল; যেগুলো পুনঃনির্মাণে সেনাবাহিনী সহায়তা করে। তাছাড়া যুদ্ধের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল অস্থিতিশীল। ফলে, সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় কাজ করে এবং বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় দেশের শৃঙ্খলা বজায় রাখার উদ্যোগ নেয়। তারা দেশব্যাপী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, চোরাচালান প্রতিরোধ, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন অপারেশনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে দ্রম্নত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু দেশের সুরক্ষায় নয়, যুদ্ধপরবর্তী সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সময়ের পরিক্রমায় রাষ্ট্রের বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অবকাঠামো নির্মাণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। তাদের পরিকল্পনা, দক্ষতা এবং সময়মতো কাজ সম্পন্ন করার ক্ষমতা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে রাখছে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা। সড়ক, সেতু, সরকারি ভবন এবং বিভিন্ন বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে বেসামরিক প্রশাসনের সহযোগী হিসেবে কাজ করে থাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প এবং মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নে সরাসরি অংশগ্রহণ সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছে। দুর্গম এলাকায় সড়ক যোগাযোগ স্থাপন ও পাহাড়ি অঞ্চলে রাস্তা নির্মাণে তারা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করায় মানুষের জীবনযাত্রা হয়েছে সহজ ও উন্নত। ফলশ্রম্নতিতে সাজেক, নীলগিরির মতো এলাকা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন এলাকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। উন্নত হয়েছে এসব এলাকার জীবনমান, স্থানীয় অর্থনীতি পেয়েছে প্রাণের ছোঁয়া। একই সঙ্গে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্কুল, হাসপাতাল এবং সরকারি অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়নে সেনাবাহিনী অংশগ্রহণ করেছে। তাছাড়া গৃহহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি উলেস্নখযোগ্য সাফল্য। রাজধানী ঢাকার হাতির ঝিল প্রকল্প, ফ্লাইওভার নির্মাণ এবং পূর্বাচল ৩০০ ফুট রাস্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পেও তাদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আর কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রেখে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে ব্যাপক সহায়তা করেছে। তারা দেশের একটি বৃহৎ শিল্প-প্রতিষ্ঠান বিএমটিএফ লি. এর দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানটিকে লোকসানের কবল থেকে মুক্ত করে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করে, ফলশ্রম্নতিতে অনেক লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। তাছাড়া সেনা কল্যাণ সংস্থার বহু প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের অনেক মানুষের কর্মসংস্থান করে বেকারত্ব ঘুচিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। সেনাবাহিনী পরিচালিত মিলিটারি ফার্মসমূহে সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্য গবাদিপশু, দুগ্ধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য উৎপন্ন করা হয়- যার মাধ্যমে সেনাবাহিনী নিজস্ব চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে। ফলে, প্রতিরক্ষা খাতের মূল্যবান বরাদ্দ সাশ্রয় ও যথোপযোগী ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে। এছাড়াও, প্রতিবছর সেনাবাহিনী পর্যায়ে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির মাধ্যমে অনাবাদি জমিতে বৃক্ষরোপণ ও আবাদিকরণ করা হয়- যা দেশের পরিবেশ রক্ষা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
দেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং দুর্যোগ-প্রবণতা বিবেচনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রায়শই বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধ্বস এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে জরুরি সাড়া দিতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সহায়তা এবং ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় সেনাবাহিনী বিশেষ দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে। দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দল রয়েছে- যারা ঘূর্ণিঝড়, ভবনধস, অগ্নি নির্বাপন, ভূমিকম্প এবং বন্যার সময় জরুরি পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য প্রস্তুত থাকে। দুর্যোগের সময় অত্যন্ত দ্রম্নত সাড়া দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধার, ত্রাণ বিতরণ, নিরাপত্তা এবং পুনর্বাসনের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে। বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের সময় স্পিডবোট, হেলিকপ্টার এবং অন্যান্য সরঞ্জামের সাহায্যে আটকে পড়া মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা করা হয়। এছাড়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধ সরবরাহে সেনাবাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে। প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকায় ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর অক্লান্ত প্রচেষ্টাকে জনগণ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালের সিডর, ঘূর্ণিঝড় আইলা এবং সাম্প্রতিক সিলেট, কুমিলস্না ও নোয়াখালী এলাকায় বন্যার সময় উদ্ধার কাজ ও ত্রাণ বিতরণে সেনাবাহিনীর সদস্যদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ অনেক প্রাণরক্ষা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে ব্যাপক সাহায্য করেছে। দুর্যোগে আহত ও অসুস্থ মানুষের জন্য অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করে সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিম বিভিন্ন এলাকায় চিকিৎসাসেবা প্রদান করে। কোভিড-১৯ মহামারি (২০২০-২১) পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে লকডাউন বাস্তবায়ন, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ত্রাণ বিতরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেনা সদস্যরা কোয়ারেন্টাইন সেন্টার এবং হাসপাতাল স্থাপনেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। তাছাড়া মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কক্সবাজারে ক্যাম্প স্থাপন এবং শরণার্থীদের খাদ্য ও আশ্রয় প্রদানে সেনাবাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানবিক সংকট মোকাবিলায় দেশের মানুষের ?আস্থার প্রতীক। তাদের দ্রম্নত পদক্ষেপ, দক্ষ উদ্ধার কার্যক্রম এবং দুর্যোগপরবর্তী পুনর্গঠনে সক্রিয় অংশগ্রহণ বাংলাদেশকে একটি টেকসই ও সুরক্ষিত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু সামরিক শিক্ষা ও সামরিক প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের শিক্ষা খাতেও উলেস্নখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। সেনাবাহিনী পরিচালিত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চ মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান করে থাকে- যা দেশের সামগ্রিক শিক্ষা-ব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তারা সরাসরি বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মেডিকেল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে থাকে যেখানে সমাজের সব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সুযোগ পায়, এমনকি অনেক শিক্ষার্থী বিনামূল্যে বা ন্যূনতম খরচে পড়ালেখা করে। বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ইঅওটঝঞ), মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (গওঝঞ) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (ইটচ) একটি স্বনামধন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান- যা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা প্রদান করে। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজসমূহে অনেক শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায় এবং প্রতি বছর ভালোমানের অনেক চিকি?ৎসক মানুষের সেবার জন্য নিজেদের নিয়োজিত করে। সেনাবাহিনী পরিচালিত ক্যাডেট কলেজগুলো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখান থেকে অনেক মেধাবী মুখ নিজেদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আদর্শ নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এই উদ্যোগ দেশকে সামগ্রিকভাবে উন্নত ও স্বনির্ভর জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের উন্নয়নে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের অভাব পরিলক্ষিত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের উন্নয়নকল্পে ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়ে আসছে বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'প্রয়াস'। কোমলমতি অটিজম, সেরিব্রাল পালসি, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, শ্রবণ প্রতিবন্ধী এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা, মানসিক বিকাশ এবং শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশের ১১টি সেনানিবাসের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ১৯৮৮ সালে প্রথমবার জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দিয়ে বর্তমানে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৪০টি দেশে ৬৩টি শান্তিরক্ষা মিশন সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করে বর্তমানে বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে তারা একটি বিশ্বস্ত ও দক্ষ বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। জাতিসংঘ মিশনে তাদের ভূমিকা শুধু শান্তি রক্ষা নয়, বরং যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের পুনর্গঠন, মানবিক সহায়তা এবং টেকসই উন্নয়নে সাহায্য করার মধ্য দিয়ে বিস্তীর্ণ হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা আফ্রিকা এবং অন্যান্য সংঘাতপূর্ণ এলাকায় যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ, দ্বন্দ্ব নিরসনে আলোচনা ও মধ্যস্থতা করে শান্তি প্রতিষ্ঠা, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ও দেশ পুনর্গঠনে কাজ করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হওয়ায়, যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় স্থানীয় জনগণের আস্থা অর্জন করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যক্রম পরিচালনা সহজতর হচ্ছে। পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের শান্তিরক্ষী মিশনে অন্তর্ভুক্তি আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এক বিশেষ মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। নারী সেনা সদস্যরা যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় বিশেষভাবে মানবিক সহায়তা, চিকিৎসা এবং স্থানীয় নারীদের ক্ষমতায়নে ভূমিকা পালন করে বহির্বিশ্বে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। ২০১৯ সালের জানুয়ারি হতে প্রতিটি ব্যাটালিয়ন এ 'মহিলা এনগেজমেন্ট টিম' অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে- যা শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নারী সেনাসদস্যদের কার্যক্রমকে আরো বেগবান করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে তাদের পেশাদারিত্ব ও সাফল্যের জন্য সবার নিকট প্রশংসিত। শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি সম্মানজনক অবস্থায় অধিষ্ঠিত এবং সেনাবাহিনীর এই অবদান বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে একটি উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী 'ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার'-এর আওতায় বেসামরিক প্রশাসনকে বিভিন্ন জাতীয় সংকটকালীন সহায়তা করার জন্য কাজ করে থাকে। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনগুলোতে সেনাবাহিনী সব সময়ই আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ১৯৭৩ সাল থেকে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মোতায়েন থাকে। তাছাড়া বিশেষ রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে সেনাবাহিনী শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে। দেশের জাতীয় নিরাপত্তার পাশাপাশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহের (কেপিআই) নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করে আসছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎ কেন্দ্র, যমুনা সেতু, পদ্মা সেতু, বিদু্যৎ কেন্দ্রসমূহ এবং গুরুত্বপূর্ণ কারখানার নিরাপত্তার স্বার্থে সেনা সদস্যরা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছে। সেনাবাহিনী পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখা, উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দুর্গম পার্বত্য এলাকায় অবকাঠামো নির্মাণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, কৃষি উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার প্রসার এবং দুর্যোগ মোকাবিলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর অবদান প্রশংসনীয়। সেনাবাহিনীর উপস্থিতি পার্বত্য অঞ্চলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, শান্তি এবং উন্নয়ন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের সংস্কৃতি, ভাষা ও রীতি-নীতির প্রতি শ্রম্নদ্ধাশীল থেকে তাদের অধিকার রক্ষা করছে। সেনাবাহিনী স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে এবং তাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে সমর্থ হয়েছে। সর্বোপরি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধুমাত্র একটি প্রতিরক্ষা বাহিনী নয়, বরং এটি দেশের উন্নয়নে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নে তাদের এই অবদান বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ, নিরাপদ এবং স্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে সহায়ক হয়েছে। ভবিষ্যতেও সেনাবাহিনী দেশের স্বার্থে নিয়োজিত থেকে সার্বভৌমত্ব রক্ষা থেকে শুরু করে সার্বিক উন্নয়নে জনগণের ভরসাস্থল হিসেবে পাশে থাকবে।
কর্নেল মোহাম্মদ মেহেদী হাসান : সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা