দেশের উন্নয়ন ও মানবাধিকার

বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ নতুন কিছু নয়। সঙ্গত কারণেই আইনের শাসন ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।

প্রকাশ | ২৫ জুন ২০১৯, ০০:০০

মাহমুদুল হক আনসারী
বাংলাদেশ যে উন্নয়নের অগ্রগতিতে এগিয়ে চলছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। উন্নয়নের সঙ্গে মানবিক উন্নয়ন রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড, গুম, অপহরণ, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেপরোয়া মনোভাব মত প্রকাশ ও রাজনৈতিক সভা সমাবেশের ওপর প্রতিবন্ধকতা ক্রমাবনতি অব্যাহত আছে। বিভিন্ন সময়ে দেশ-বিদেশের ব্যক্তি সংগঠন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন "হিউমেন রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি"-২০১৮ এর এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ নতুন কিছু নয়। সঙ্গত কারণেই আইনের শাসন ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। একজন নাগরিক রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টর থেকে যেভাবে সাহায্য ও আনুকূল্য পাওয়ার কথা ছিল তা কিন্তু মোটেও পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের প্রশাসনের সবগুলো সেক্টর দুর্নীতিতে ভরপুর। জনগণ ঘুষ ও উৎকোচ ছাড়া প্রশাসনের কোনো সেবা পায় না। প্রশাসন বাস্তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মেনে চলে কিনা সেখানে জনগণের প্রশ্নের শেষ নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনিয়মের কোনো শেষ নেই। গত ঈদুল ফিতরের ছুটিতে জনগণের রাস্তায় চাঁদাবাজি আর দুর্ভোগের কথা বলে লিখে শেষ করা যাবে না। পরিবহন শ্রমিক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌথভাবে চাঁদাবাজি করে জনগণকে চরমভাবে ভোগান্তিতে ফেলেছে। কোনো কোনো এলাকায় যাত্রীবাহী পরিবহন ১০০ টাকার ভাড়ায় ৩০০ টাকা নেয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে। সিটি গেট এলাকার দূর পালস্নার পরিবহন কাউন্টার ৫০০ টাকার ভাড়ায় ১২০০-১৪০০ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয়ার সংবাদ মাধ্যমে পাওয়া যায়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী আনোয়ারা চন্দনাইশ কক্সবাজার রুটে যাত্রী হয়রানির সীমা ছিল না। স্পেশাল সার্ভিস থেকে সিএনজি পর্যন্ত সবগুলো গণপরিবহনে ডাবল রিডাবলভাবে জোর জবরদস্তি এবং জিম্মি করে ভাড়া আদায় করা হয়। জনগণের আয়ের প্রতি কোনো তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করা হয়েছে এসব রুটে। উত্তর চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, নাজিরহাট রুটের পরিবহনও যাত্রীদের এভাবে অমানবিক হয়রানি করার সংবাদ আছে। নগরীতে ঈদের আগে এবং পরে সিটি সার্ভিসের সবগুলো পরিবহনে ইচ্ছেমতো ডাবল রিডাবল ভাড়া আদায় করা হয়। এসব সেক্টর যেন বেপরোয়া এবং সঠিকভাবে পরিচালনা করার যেন কেউ নেই। দেশের সবগুলো সেক্টর বলতে গেলে অনিয়ন্ত্রিত ও বেপরোয়া। সবখানেই জনভোগান্তি আর হয়রানি। উত্তরবঙ্গের একটি গণপরিবহনে যাত্রীর সঙ্গে ভাড়া নিয়ে বাড়াবাড়ির একপর্যায়ে যাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যা করা হয়েছে মাত্র কয়েকঘণ্টা আগে। পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে যৌক্তিক কোনো কথায় যাত্রীরা বলতে পারছে না। তারা বেপরোয়া তাদের শেল্টারে আছে মালিক-শ্রমিক আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্তি। তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় গিয়ে আইনের শাসন আর ভোগান্তির নিস্তার খুঁজবে? না কোথাও গিয়ে বিচার পাওয়ার মতো ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছি না। অনিয়ম দুর্নীতির জনভোগান্তির অনেক কথা বহু লেখকের মাধ্যমে পত্রিকায় প্রচার পেয়েছে। বাস্তবে যেখান থেকে এসব বিষয়ের তদারকি এবং আইনানুক বিচার বিশ্লেষণ হওয়ার কথা সেখান থেকে কিছুই হচ্ছে না। তাহলে একটা দেশের জনগণ আর মানচিত্র, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব কিসের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। সেখানেই অনেক কথা বলার থাকে নির্যাতিত মানুষের। কথা হচ্ছিল, মানবাধিকার নিয়ে, গোটা দুনিয়ায় মজলুম মানুষের মানবাধিকার নেই বললেই বেশি বলা হবে না। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগণের ওপর অব্যাহতভাবে নির্যাতনে মুখ খুলতে পারছে না ওই অঞ্চলের মানুষগুলো। কেউ পালিয়ে কেউ নীরবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। পৃথিবীর মানবাধিকার ও শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ তাদের পাশে যেভাবে থাকার কথা ছিল সেভাবে এগিয়ে আসছে না। পার্শ্ববর্তী দেশে একধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে আর বাংলাদেশে ভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক, সামাজিক ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র জনগণ দেখছে। একদিকে উন্নয়ন অগ্রগতি লাখ লাখ কিলোমিটার রাস্তাঘাটের উন্নয়ন আর ডেভেলপ হচ্ছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের শেষ নেই। শিক্ষা, সংস্কৃতিতে প্রতিনিয়ত অগ্রগতির কর্মসূচি দেখা যাচ্ছে। বিজ্ঞান তথ্যপ্রযুক্তির অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জাতিকে। কিন্তু এসব উন্নয়নের সঙ্গে জনগণের মানবিক নাগরিক ও মানবাধিকারের গুণাবলির অগ্রগতি হচ্ছে না। ব্যক্তি পরিবার সমাজ রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিকের শৃঙ্খলা অশান্তি বেড়েই চলছে। মানসিক শান্তি আর শৃঙ্খলা জনগণ খুঁজে পাচ্ছে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কোনো পদক্ষেপও জনগণ দেখছে না। বছরের পর বছর এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর বিশুধগার ও হয়রানি করে যাচ্ছে। আইন ও বিচারের সঠিক ধারাবাহিকতা রক্ষা হচ্ছে না। বিচার ও আইনকে রাজনৈতিক চত্রছায়ায় ব্যবহার করা হচ্ছে। পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা একেবারেই নেমে এসেছে। অন্য দল ও ব্যক্তিকে ঘায়েল করতে যা যা দরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে সে শক্তি ব্যবহার করে গণতান্ত্রিক সব রীতিনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বলা যায়, গণতন্ত্রহীন একটি রাষ্ট্রে জনগণ বসবাস করছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল বহুদলীয় গণতন্ত্র আর জনগণের সুখ দুঃখের মতামত তুলে ধরার জন্য। মানুষ যে কোনো পরিস্থিতিতে সে তার মতামত তুলে ধরবে এবং তার সুরক্ষা সহায়তা পাবে সেটাই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার পেছনের উদ্দেশ্য ও আকাঙ্খা। আজকে সেসব উদ্দেশ্য ও অধিকার থেকে জনগণ বঞ্চিত। ব্যক্তি ও দলকেন্দ্রিক একদলীয় শাসনের বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে। গণতান্ত্রিক নিয়ম রীতিনীতি বাকস্বাধীনতা ক্রমেই দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার, জনগণের অধিকার স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। এ বিষয়গুলো দেশের জনগণ যেভাবে অনুধাবন করছে এবং অনুতপ্ত হচ্ছে একইভাবে বহির্বিশ্বের নানাদেশ ও সংস্থা বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে। এতে বিচলিত হওয়ার কারো কিছু নেই। মাহমুদুল হক আনসারী: গবেষক, প্রাবন্ধিক