শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা

জগন্নাথদেব সূর্য-সপ্তাশ্ব বাহিত রথে আকাশলোক পরিক্রমণ করেন। তারপর রথে অরোহণ করে গুন্ডিচা যাত্রা করেন। অয়নপথে সূর্যের দক্ষিণ দিকে যাত্রা ও উত্তরে প্রত্যাবর্তন জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিবৃত্ত। বলরাম ও সুভদ্রা জগন্নাথদেবের সঙ্গী। স্কন্দপুরাণ মতে, "জগন্নাথদেবের সঙ্গী বলরাম বিষ্ণুর অনন্ত শয্যার অংশীদার।"

প্রকাশ | ০৪ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

তারাপদ আচার্য্য
শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা আজ। শঙ্খ বাজছে। উলুধ্বনি দিচ্ছে। চারপাশে হৈ হুলেস্নাড়। রথযাত্রাকে ঘিরে উৎসবে মাতোয়ারা সবাই। ভক্তরা ফুল, বেলপাতা, বাতাসা, নকুলদানা ও কাঁদি কাঁদি কলা নিয়ে সকাল থেকে উপস্থিত রথযাত্রায় অংশ নিতে। হাজার হাজার ভক্ত রথের রশি টেনে নিয়ে যাবেন। রথটানা শুরুর আগেই আকাশে ঘন কালো মেঘ জমে। রথটানা শুরু মাত্রই আশ্চর্যভাবে অনেকটা ভারাক্রান্ত ও বেদনাচ্ছন্ন হয়ে এসব ঘন মেঘ দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে মাটির পৃথিবীতে ঝরে পড়ে। সেই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে নেচে-গেয়ে মাতোয়ারা হন সবাই। সেই সঙ্গে সমানতালে বাজতে থাকে ঘণ্টাবাদ্যি। একদিকে পুরুষরা শঙ্খ, ঘণ্টা, কাঁসা, ঢাক, ঢোল বাজিয়ে পরিবেশ মুখর করে তোলেন অন্যদিকে নারীরা উলুধ্বনি ও মঙ্গলধ্বনির মাধ্যমে রথটানায় আনন্দচিত্তে শামিল হন। রথ থেকে রাস্তায় দাঁড়ানো দর্শনার্থীদের দিকে ছুড়ে দেয়া হয় কলা আর ধানের খৈ। শাস্ত্রে রয়েছে, 'রথে চ বামনং দষ্টবা পুনর্জন্ম ন বিদ্যাতে' অর্থাৎ, রথে চড়ে বামন জগন্নাথকে দেখতে পেলে জীবের আর পুনর্জন্ম হয় না। এ বিশ্বাস বুকে ধারণ করেই আজ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এ মহা উৎসবের আয়োজন। ভারতবর্ষে শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। এই রথযাত্রা কবে কখন শুরু হয়েছিল তা নিয়ে নানা মতবিরোধ রয়েছে। সত্যযুগে রাজা ইন্দ্রদু্যম্ন সাক্ষাৎ ভগবান নীলমাধবকে খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থমনোরথ হয়ে নিজের রাজ্যে ফিরে আসেন। তখন রাজা নীলমাধবের দেখা না পেয়ে বেদনায় কাতর হয়ে অনশনে জীবন ত্যাগ করতে প্রস্তুত হলে নীলমাধব দৈববাণীতে রাজাকে জানান, "হে মহারাজ, তুমি আমার কথা শোন, তুমি নীলমাধব স্বরূপ আমার দর্শন কখনো পাবে না। নীলাচল পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে দারুব্রহ্মরূপে তুমি আমার দর্শন পাবে।" বর্তমানে পুরীর যে স্থানে জগন্নাথদেবের মন্দির রয়েছে তা রাজা ইন্দ্রদু্যম্ন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। ১১১৯ খ্রিস্টাব্দে গঙ্গাবংশের রাজা ভীমদেব কর্তৃক শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের মন্দির নির্মিত হয় এবং পুষ্যানক্ষত্রযুক্ত বৈশাখ মাসে শুক্লাষ্টমী তিথিতে বৃহস্পতিবারে দেবতা প্রতিষ্ঠা করা হয়। আবার অন্য মত থেকে জানা যায়, পশ্চিম বাংলার হুগলী জেলাতে শ্রীরামপুর মাহেশে সবচেয়ে প্রাচীনতম, আকর্ষণীয় ও উলেস্নখযোগ্য রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এটি ৬১২ বছরের পুরনো উৎসবানুষ্ঠান বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। গুপ্তিপাড়ায় ৪০২ বছরে প্রাচীন দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রারও প্রাচীনতা রয়েছে। বারুইপুরের রায়চৌধুরী পরিবারের ৩০১ বছরের অধিক সময় ধরে রথযাত্রা উৎসব পালন করে আসছে- যা প্রাচীনত্যর সাক্ষ্য বহন করে। বাংলাদেশও প্রায় সবকটি জেলায় রথ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। তবে এর মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ রথযাত্রার উৎসব অনুষ্ঠিত হয় মানিকগঞ্জের ধামরাইতে। কোনো কোনো সূত্র থেকে জানা যায়, প্রায় ৪০০ বছর ধরে চলে আসছে ধামরাইয়ের রথযাত্রার অনুষ্ঠান। কিংবদন্তি আছে, পালবংশের শেষ রাজা যশোবন্ত পাল একদিন গজে আরোহণ করে ধামরাইয়ের শিমুলিয়ায় বেড়াতে যান। পথে শিমুলিয়ার উপকণ্ঠে একটি লাল মাটির ঢিবির কাছে এসে রাজার হাতি থেমে যায়। পরে রাজার আদেশে ওই মাটির ঢিবি খনন করে একটি মন্দিরের সন্ধান পাওয়া যায়। ওই মন্দিরটিতে মাধব বিগ্রহসহ আরো কিছু বিগ্রহ পাওয়া যায়। রাজা যশোবন্ত পাল বিগ্রহগুলো সংগ্রহ করে শিমুলিয়ার বিভিন্ন জায়গায় পূজার জন্য স্থাপন করেন। রাজা মূল বিগ্রহটিকে ধামরাইয়ে প্রতিষ্ঠা করার জন্য একজন ব্রাহ্মণকে দায়িত্ব দেন। এরই ধারাবাহিকতায় রাজার নাম সংযুক্ত করে মন্দিরের নাম হয় যশোমাধব মন্দির। এখানেই মাধব বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় স্থানটির নাম হয়েছে মাধববাড়ী। জনশ্রম্নতি আছে যে, দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রায় ২৫০ জন দক্ষ কাষ্ঠশিল্পীর অক্লান্ত পরিশ্রমে ধামরাইয়ের প্রথম কাঠের রথ তৈরি হয়েছিল। এই কাঠের রথে নানা কারুকার্যখচিত মহাভারতের কাহিনী ও কলিকালচিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। ৩২ চাকার উপর প্রতিষ্ঠিত রথের উচ্চতা ছিল ৮০ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ছিল যথাক্রমে ৪০ ফুট ও ৪৫ ফুট। তিনতলা বিশিষ্ট রথে নয়টি কক্ষ থাকায় তাকে নবরত্ন রথ বলা হতো। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় হানাদার বাহিনীর দোসরদের কালোছোবলে ঐতিহ্যবাহী ধামরাইয়ের রথটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকার সূত্রাপুরে রামসীতা মন্দির কমিটির আয়োজনে ৫০০ বছরের পুরানো রথযাত্রার অনুষ্ঠান চলে আসছে। পুরনো ঢাকায় শ্রীশ্রী রাধামাধব জিও দেববিগ্রহ মন্দির, ঠাটারীবাজার শিবমন্দির ও রাধাগোবিন্দ জিও ঠাকুর মন্দিরেও রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকায় সবচেয়ে বড় রথযাত্রার উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ইসকন মন্দিরে। শ্রীশ্রী জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর বিগ্রহ সুসজ্জিত রথ বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে ইসকন্‌? মন্দির হতে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয় আবার অষ্টম দিবসে উল্টো রথযাত্রা হিসেবে রথ তিনটিকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া দেশের নারায়ণগঞ্জ, বেনিয়াজুড়ি, পুরনো ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, যশোহরের কেশবপুর, নড়াইলের লোহাগড়া, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর, হবিগঞ্জ এবং সিলেট অঞ্চলে উৎসবের উচ্ছ্বাসটা অন্য এলাকার চেয়ে একটু বেশিই। বাংলাদেশ-ভারত দুটি ভিন্ন দেশ হলেও রথ উদযাপনের চিত্রের কোনো ভিন্নতা নেই। এসব এলাকার অধিকাংশ স্থানেই মাইলের পর মাইল জায়গাজুড়ে মেলা বসে। আমরা যে রথযাত্রা উৎসব পালন করে থাকি তা জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা এবং রথযাত্রা সূর্যের অয়নপথ পরিক্রমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সূর্যের দক্ষিণায়ন যাত্রার সঙ্গে বর্ষাগমনের সম্পর্ক স্বতঃসিদ্ধ। আর বর্ষা শুরুর উৎসব জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা। জগন্নাথদেব সূর্য-সপ্তাশ্ব বাহিত রথে আকাশলোক পরিক্রমণ করেন। তারপর রথে অরোহণ করে গুন্ডিচা যাত্রা করেন। অয়নপথে সূর্যের দক্ষিণ দিকে যাত্রা ও উত্তরে প্রত্যাবর্তন জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিবৃত্ত। বলরাম ও সুভদ্রা জগন্নাথদেবের সঙ্গী। স্কন্দপুরাণ মতে, "জগন্নাথদেবের সঙ্গী বলরাম বিষ্ণুর অনন্ত শয্যার অংশীদার।" উৎকলখন্ডের বর্ণনা অনুসারে জগন্নাথদেব শঙ্খচক্রধারী, সুতরাং দ্বিভুজ। কিন্তু প্রচলিত কিংবদন্তী অনুসারে বিশ্বকর্মা জগন্নাথদেবের মূর্তি তৈরি করার সময় কারো প্রবেশ ছিল নিষেধ, এমনকি রাজা ইন্দ্রদু্যম্নেরও না। বিশ্বকর্মা মূর্তি তৈরি করার আগেই রাজা ইন্দ্রদু্যম্ন অধৈর্য হয়ে বন্ধ দরজা খোলার জন্য মূর্তি অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায়। অনেকে মনে করেন যে, জগন্নাথদেবের মূর্তি বুদ্ধদেবেরই রূপান্তর। আবার অনেকে মনে করেন যে, জগন্নাথদেব কোনো অনার্য জাতির দেবতা। বিবর্তনের ধারায় হিন্দুদেবতা বিষ্ণু এবং সব শেষে জগন্নাথদেব হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এর পেছনে যুক্তিও আছে- স্কন্দপুরাণে উৎকলখন্ডে এবং পুরষোত্তমখন্ডে শবরপতি বিশ্বাসুর ছিলেন নীলগিরি পর্বতে নীলমাধবের পূজারী এবং উপাসক। পরে নীলমাধব এখান থেকে অন্তর্হিত হয়ে কাঠদ্বারা নির্মিত জগন্নাথদেবের মূর্তিরূপে আর্বিভূত হয়েছিলেন। শবরপতি বিশ্বাসুর অনার্য জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বলেই জগন্নাথদেবকে অনার্যদের দেবতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। আবার কেউ কেউ, বৌদ্ধ ত্রিরত্নের মধ্যে সংঘ নারীরূপে বুদ্ধের ও ধর্মের মাঝখানে অবস্থান করায় জগন্নাথদেবের মূর্তি ত্রিরত্নের রূপান্তর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। উড়িষ্যার অনেক বৈষ্ণব ভক্তকবি জগন্নাথদেবকে বুদ্ধের মূর্তি বা অবতার বলে উলেস্নখ করেছেন। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস- শ্রীকৃষ্ণই বুদ্ধরূপে জগন্নাথ নামে অধিষ্ঠিত। জগন্নাথ দাসের 'দারুব্রহ্ম' ও অচু্যতানন্দ দাসের রূপান্তর 'শূন্য সংহিতা'-য় এই তত্ত্ব স্থান পেয়েছে। শুধু তাই নয়, ঈশ্বর দাস ও অচু্যতানন্দ জগন্নাথদেবকে বুদ্ধের এবং শ্রীচৈতন্যদেবকেও বুদ্ধ বলে বর্ণনা করেছেন। স্বামী অভেদানন্দ তিব্বতের লাদাখ অঞ্চল ভ্রমণকালে 'বৌধ্‌খুর্ব' গ্রামে ত্রিরত্নের যে মূর্তি দেখেছিলেন, সেই মূর্তিগুলোকে তিনি জগন্নাথদেবের মূর্তির প্রতিরূপ বলে গণ্য করেছেন। স্বামীজীর বর্ণনা অনুসারে- "লামাদের একটি ত্রিরত্ন বা 'পরমেশ্বরা' রহিয়াছে। আমাদের দেশের ইট দিয়া গাঁথা তুলসী মন্দিরের মতো ইহারা তিনটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিরেট মন্দির নির্মাণ করিয়া প্রথমটিতে কালো, দ্বিতীয়টিতে হলদে ও তৃতীয়টিতে সাদা রঙ লাগাইয়া বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের প্রতীক নির্মাণ করিয়া তাহাদের পূজারতি করেন। ইঁহারা এইগুলিকে 'পরমেশ্বরা' বলেন। 'পরমেশ্বরা' শব্দ পরমেশ্বর শব্দের অপভ্রংশ। এইগুলিতে চোখ আঁকিয়া দিলে প্রথম কালোটিকে হস্তপদহীন জগন্নাথ, দ্বিতীয় হলদেটিকে সুভদ্রা ও তৃতীয় সাদাটিকে বলরাম মনে হয়।" জগন্নাথদেব আদিম অবস্থায় বৌদ্ধ দেবতা ছিলেন অথবা অনার্য দেবতা ছিলেন অথবা শাক্ত দেবতা ভৈরব ছিলেন, সে তত্ত্ব নিছক অনুমানের ব্যাপার। জগন্নাথদেবের মূর্তি বৌদ্ধ দেবতা হলে তিনটি মূর্তির স্বরূপ কী? তিনটি মূর্তি ত্রিরত্ন হলে এদের মধ্যে নারীমূর্তি সুভদ্রা এলেন কীভাবে? বুদ্ধদেবের অস্থি বা অন্যকোনো স্মৃতিচিহ্ন জগন্নাথদেবের মূর্তির মধ্যে লুকায়িত আছে কিনা তাও নির্ণয় করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবে এ কথা সত্য যে, সূর্য, বিষ্ণুর প্রভাব জগন্নাথদেবের ওপর আছে। এই যে বিশ্বরূপ পুরুষোত্তম ভগবানের রূপ প্রকাশ তা তো বিশ্বময়তায় একাকার। তাকে কোনো রূপের সীমায় আবদ্ধ করা যায় না। তাই জগন্নাথদেবের এই অদ্ভূত দারুব্রহ্মময় মূর্তি ভগবানের অনন্ত লীলাপ্রকটনের এক অসীম প্রকাশ। সেই পুরুষোত্তম সত্যসুন্দর নিরঞ্জন ভগবান জগন্নাথদেব নানা দিব্যালঙ্কারে বিভূষিত হয়ে তার অসম্পূর্ণ হস্তপদ, বড় বড় দুটি গোলাকার উদ্গত চক্ষু নিয়ে যেন জগৎ কল্যাণে পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। এটিই তার স্বরূপ-মাধুর্য। তাকে স্মরণ করেই ভক্তরা চায় পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পরিত্রাণ। আর তার জন্য আজকের এই রথযাত্রা উৎসব। তারাপদ আচার্য্য: সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ