বৃক্ষের সঙ্গে নির্মম আচরণ, বিপদের মুখোমুখি প্রাণিকুল

প্রকাশ | ০৭ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
গ্রীষ্মকালে গরমের তীব্রতা এতই বেশি যে তা অসহনীয়, অসহ্যকর! ভেপসা গরমে সবার প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে। কৃত্রিম শীতলতার ওপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না তখন। তাতেও কাঙ্ক্ষিত স্বস্তি মেলানো ভার। শুধু গ্রীষ্মকালই নয়, বর্ষাকালের বৃষ্টিতেও আজকাল নেই প্রশান্তির লেশ, নেই বিন্দুমাত্র শীতলতার অনুভূতি। সপ্তাহজুড়ে কমবেশি বৃষ্টিপাত হলেও গরমের তীব্রতা যেন চরমে। বৃষ্টি নামার সঙ্গে সঙ্গে গরম আরও জাপটে ধরে। অথচ বৃষ্টি নামার পর প্রকৃতিতে শীতলতা বিরাজ করার কথা, কিন্তু গরমের রেষ যায়ই না যেন, মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এসবই গাছপালা কমে যাওয়ার একমাত্র ফলাফল। গাছপালা কমে যাওয়ার কারণে একদিকে প্রকৃতিতে ক্রমেই বৃষ্টিপাত কমছে, অন্যদিকে উষ্ণতর হচ্ছে পৃথিবীপৃষ্ঠ, দেখা যাচ্ছে জলবায়ুর অসম পরিবর্তন, ঋতু আবর্তনে গড়মিল হচ্ছে, বাড়ছে সূর্যরশ্মির তীব্রতা, গ্রিন হাউস ইফেক্ট বাড়ছে। এভাবেই পৃথিবীকে নানান আঙ্গিক থেকে বসবাসের অযোগ্য করে তোলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মনুষ্যকুল পরিবেশের সঙ্গে বৈরী ও অস্বাভাবিক আচরণে লিপ্ত। গাছপালার সঙ্গে চলছে সর্বদা নির্দয়, নির্মম ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ। আসন্ন প্রাণিকুলের বিপদকে সামাল দেবে কে? গাছপালার সে সক্ষমতা এখন পর্যন্ত রয়েছে কি? প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো- গাছ বা বৃক্ষ। পৃথিবীর আদিকাল থেকে বৃক্ষের বিচরণ যা প্রাণিকুলের কল্যাণেই ব্যবহার হয়ে আসছে। গাছের পরম উপকারিতার কথা কেউ কোনোক্রমেই অস্বীকার করতে পারবে না। এটাও অস্বীকার করতে পারবে না কেউ যে গাছের উপকারিতার প্রতিদান হিসেবে মনুষ্যকুল গাছপালাকেই কেটে ফেলছে, গাছের বংশবিস্তারে সাহায্য করছে না। বিবেক বোধসম্পন্ন মানুষের বিচার বুদ্ধিহীনতার কারণে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার গাছ অকারণে কাটা পড়ছে। গাছ যেন তাদের চক্ষুশূল। তাই মানুষের হাতে প্রতিনিয়ত বলির শিকার হতে হচ্ছে ছোট-বড় নানাজাতির গাছকে। প্রতিদিন কত পরিমাণ গাছ অকারণে, নির্বিচারে, অপ্রয়োজনে কাটা হচ্ছে, এ হিসাব হয়তো কারও কাছে নেই, হিসাব রাখার প্রয়োজনও মনে করছে না কেউ। শুধু দেশের করাতকলগুলোর দিকে নজর রাখলে দেখা মিলবে কীভাবে প্রাণের সঞ্চারকারী বৃক্ষকুল তার খন্ড-বিখন্ড দেহকে বিলিয়ে রেখেছে অকাতরে। জ্বালানির কাঠ হয়ে পুড়ছে গাছের অমূল্যবান শরীর। আসলে, গাছের প্রতি আমাদের নিদারুণ স্বেচ্ছাচারিতাই এর জন্য বহুলাংশে দায়ী? গাছের প্রতি মানুষের আক্রশ বড়ই তীব্রতর হয়ে উঠেছে বর্তমানে। এর জন্য পরিবেশ বিধ্বংস মনোভাব দায়ী। মানুষের বহুমাত্রিক কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে গাছপালা। আসবাবপত্র বানানো, জ্বালানি ও ঔষধি কাজে ব্যবহারসহ নানা কাজে গাছের রয়েছে অনবদ্য ও উৎকৃষ্ট ব্যবহার। তবে গাছের পরিণত বয়সে তা কাজে লাগানো যুক্তিযুক্ত। কিন্তু মানুষ কোনো বাছ-বিচার ছাড়াই গাছকে উচ্ছেদ করে চলেছে। মানছে না গাছের স্থায়িত্বকাল। বিপরীতে সে অনুপাতে গাছ লাগানো হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, বসতবাড়ি, দোকানপাট, রাস্তা নির্মাণের জন্য বাড়ন্ত গাছ কেটে উজাড় করা হচ্ছে। গাছের বাগানগুলো দখল করে নিচ্ছে মিল, কলকারখানা, ইটভাটা, পুকুর ও বসতভিটা। ফলদগাছ ছাড়া অন্যান্য গাছের প্রতি মানুষের নজর এখন খুবই কম। বাড়ির আঙিনার দিকে তাকালে এখন হাহাকারময় দৃশ্য দেখা যায়! অতীতের চিত্র থেকে বিপরীত এখন। বাড়ির আঙিনায় নেই শোভাবর্ধনকারী বৃক্ষ। অতীতে যেসব বাড়িতে নানা জাতের ঔষধি গাছ ছিল, সেসব বাড়ি এখন শূন্য। যথেষ্ট জায়গা থাকতেও গাছ লাগানোর মানসিকতা ও সময় কারও নেই। গাছের প্রতি কেউই আজকাল যত্নবান না। এভাবে গাছের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ বিলুপ্ত হতে থাকলে, পৃথিবী মরুকরণের দিকে ধাবিত হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। পৃথিবীর জনসংখ্যা ও আয়তনের তুলনায় গাছপালা যৎসামান্যই বলা চলে। একটি দেশের ভৌগোলিক পরিবেশ বিবেচনায় ২৫ শতাংশ গাছপালা থাকা আবশ্যক। কোনো দেশই নেই, যেটা কিনা গাছে স্বয়ংসম্পন্ন। বাংলাদেশে রয়েছে মাত্র ১৬ শতাংশ গাছপালা। সবখানে চলছে গাছের প্রতি বিরুদ্ধাচারণ। এটি কোনোভাবেই পৃথিবীর পরিবেশকে অনুকূলে রাখতে সচেষ্ট নয়। প্রতিদিন যে পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ করা হচ্ছে, তা বহন করা এই অল্পসংখ্যক গাছপালার জন্য দুর্বিষহময়, কষ্টকর। অন্যদিকে জীবের চাহিদা অনুপাতে অক্সিজেন সরবরাহ করা যেন আরেকটি দুর্বিষহময়, কষ্টকর প্রক্রিয়া। নানাবিধ কারণে কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় প্রকৃতি ক্রমেই উষ্ণতর হচ্ছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রক্রিয়া বেড়ে চলেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, মরুকরণ শুরু হয়েছে, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে, যা বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন। কার্বন ডাইঅক্সাইডের তীব্রতা হ্রাসে, কিংবা আনুপাতিক হার বজায় রাখতে বেশি বেশি গাছপালা লাগানো ছাড়া তেমন কোনো জোরালো উপায় চোখে পড়ছে না। প্রাকৃতিক অসুবিধাগুলো প্রাকৃতিকভাবে সমাধান করতে না পারলে সে সমাধান দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। পরিবেশ রক্ষার্থে গাছের বিকল্প অন্যকিছু ভাবার কোনো সুযোগ নেই। গাছপালা কমে যাওয়ার কারণে প্রকৃতি থেকে এখন আর শীতল বাতাস বয়ই না যেন- বাতাসের সঙ্গে আগুনের তীব্রতা মেশানো। প্রকৃতির বাতাস মানুষকে শান্ত করতে পারছে না বরং ক্লান্ত করে তুলছে। কোথাও দাঁড়িয়ে পথিক বিশ্রাম নেবে, তার কোনো সুযোগ নেই। এখন গাছের ছায়া মেলানো ভার! কোথাও কোথাও গাছ আছে, নেই পর্যাপ্ত ডালপালা। জ্বালানির জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। গাছের এই অপ্রতুলতা প্রাণিকুলের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। যেহেতু গাছের কোনো বিকল্প নেই, সেহেতু গাছের সংখ্যা বৃদ্ধির দিকে অবশ্যই বিশ্ববাসীকে নজর দিতে হবে। নচেৎ বর্তমান পৃথিবী যেভাবে বদলে যাচ্ছে, এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে প্রাণিকুলের বিপন্নতা কেউ রুখতে পারবে না। পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব ঠেকানোর লড়াই করা দুরূহ হয়ে যাবে। তাই সময় বিবেচনায় গাছপালার আধিক্যতার ব্যাপারে মনোযোগ বাড়াতে হবে। গাছপালা নিধনের বিপক্ষে কাজ করতে হবে। কেন বৃক্ষ নিধন, এ বোধোদয় জাগ্রত করতে হবে। প্রকৃতিতে কম খরা ও বৃষ্টিপাতের অন্যতম কারণ গাছপালার অপ্রতুলতা। একদিকে গাছপালা না থাকার কারণে বৃষ্টিপাত হচ্ছে না, অন্যদিকে বৃষ্টিপাত না থাকার কারণে গাছপালার জন্ম, বৃদ্ধি ও বিস্তারে চরম ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রকৃতির এই আপন গতিকে রুখে দিয়েছে মূলত মানুষজাতি। তাই এর দায়ভারও মানুষজাতিকে নিতে হবে এবং তাদের প্রয়োজনেই বৃক্ষের প্রতি দায়বদ্ধতার পরিচয় দিতে হবে। এজন্য মানুষকে বৃক্ষপ্রেমী না হলেও চলবে, তবে বৃক্ষের প্রতি নির্দয়তা, নির্মমতা ও স্বেচ্ছাচারিতা পরিহার করতে হবে। পাশাপাশি সবাইকে কৃত্রিম বন নির্মাণের দিকে গুরুত্বারোপ করতে হবে। ফলদগাছের পাশাপাশি ঔষধি, বৃক্ষজাতীয়, শোভাবর্ধনকারী গাছের আধিক্যতা আনতে হবে। পরিবেশের জন্য লাভজনক গাছ লাগানোর সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সবার আগে অকারণে গাছপালা কেটে ফেলার অপকারিতা সম্পর্কে জনগণকে অবগত করতে হবে। গাছের যে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, আঙিনায় গাছ থাকলে কোনো ক্ষতি নেই, রাস্তার ধারে, নদীর পাড়ে, জমির আইলে গাছ থাকলে তা লাভজনক, এসব বোধোদয় সবার মনমগজে বদ্ধমূল করতে হবে। কিন্তু এ দায়ভার বা দায়িত্ব কে নেবে? অবশ্যই মানুষের কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই নিতে হবে। বর্ষাকাল হলো গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময়। এ সময় মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ রস বা পানি থাকে। ফলে গাছের চারা দ্রম্নত বৃদ্ধি হওয়ার সুযোগ পায়। বৃষ্টিপাতের কারণে বাড়তি যত্ন না নিলেও চলে। বর্ষাকালকে গাছের চারা লাগানোর গুরুত্বপূর্ণ সময় বিবেচনায়, এই সময়ে 'বৃক্ষরোপণ আন্দোলন' জোরদার করতে হবে। সবাই যদি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিকে 'গণআন্দোলন' ও বৃক্ষকর্তনকে 'গণঅপরাধ'-এর সঙ্গে তুলনা করে, তাহলে সীমিত সময়ের মধ্যে বদলে যাবে পৃথিবীর রূপবৈচিত্র্য, সবুজে ভরে উঠবে প্রতিটি দেশ, এটা শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যায়। সবুজ অভয়ারণ্যের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পাবে, প্রকৃতি-পরিবেশ ততই জীবকুলের অনুকূলে চলে আসবে। গাছের বিকল্প কিছুই হতে পারে না ভেবে আসুন আমরা গাছ লাগাই, প্রতিদিন গাছের পরিচর্যা করি এবং প্রাণিকুলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। মোহাম্মদ অংকন ঢাকা