গণপরিবহনে বিদ্যমান নৈরাজ্য এবং আমার ভাবনা

প্রকাশ | ০৭ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
গণপরিবহনে নৈরাজ্য, দৈনন্দিন সড়ক দুর্ঘটনা দেশে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি বেড়েছে বাসের সংখ্যা, বাস-মালিকের সঙ্গে চালকদের মনোমালিন্য, দূরত্ব। যেহেতু গণপরিবহনের সঙ্গে দেশের একটা বিশালসংখ্যক মানুষের জীবিকা জড়িত রয়েছে পাশাপাশি দেশের শতকরা ৯০ শতাংশ মানুষ যাতায়াতের জন্য গণপরিবহন তথা পাবলিক বাসের ওপর নির্ভরশীল সেহেতু একজন সাধারণ শিক্ষার্থী এবং সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার অনেকদিনের ভাবনা থেকে কিছু পরিকল্পনার কথা ভেবেছি। আমার বিশ্বাস এগুলো প্রণয়ন করে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন এবং পরে পর্যবেক্ষণ করলে গণপরিবহনব্যবস্থায় অনেকটা পরিবর্তন সাধন হবে। ১। আমাদের মূল শহরগুলোতে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে একজন বাসচালক সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাস চালায়। মধ্যে থাকে গোসল, খাওয়া-দাওয়ার বিরতি। বেশির ভাগই সপ্তাহে সাতদিনই গাড়ি চালিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হচ্ছে তাদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে তাদের যাদের পরিবার আছে তাদের সঙ্গে হয়তো কিছুটা সময় দিতে পারবে কিংবা একটানা গাড়ি চালানোর ফলে মানসিক ও শারীরিক যে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে সেটা থেকে তারা রেহাই পাবে। ২। যদি ঢাকা শহরকেই উদাহরণ হিসেবে টানি তবে বলা যাবে ঢাকায় পর্যাপ্ত বাস রয়েছে? কিন্তু বেশির ভাগ বাসেরই ফিটনেসের অবস্থা বাজে। এর পেছনে যে কারণটি সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য সেটা হচ্ছে চালকদের বেখেয়ালি গাড়ি চালনা, প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব, গাড়ির একটু রং উঠলে বা একটা লুকিং গস্নাস ভেঙে গেলে কিচ্ছু হবে না এই ধরনের মানসিকতা ইত্যাদি। বেশির ভাগ সময় মালিকপক্ষ মেরামতের ব্যবস্থা করে দেয়? কিন্তু এই বিষয়টি অনেকাংশে কমে যাবে যদি চালক ও চালকের সহযোগীর মানসিকতায় পরিবর্তন আসে। সে ক্ষেত্রে চাইলেই আমরা তাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে পারব না। তাই সে ক্ষেত্রে আমার একটা পরামর্শ রয়েছে। তা হচ্ছে প্রতিটা বাস কোম্পানির মালিক যদি তাদের সব বাস নতুন করে সাজিয়ে, প্রতিটা বাস একজন চালক ও একজন সহযোগীর দায়িত্বে দিয়ে এটা ঘোষণা দিয়ে দেয় যে, প্রতি এক মাস পর পর শ্রেষ্ঠ চালক ও সহযোগীকে পুরস্কৃত করা হবে এবং তা নির্ধারিত হবে কার বাস কতটুকু সুন্দর, পরিচ্ছন্ন আছে সেটার ওপর। এতে অনেক দিকে বিরাট পরিবর্তন আসবে। যেমন- যাত্রীদের ভ্রমণ আরও সুন্দর হবে, বাসচালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব কমে আসবে, বাস পরিচ্ছন্ন থাকার কারণে সর্বোপরি বাসচালক ও যাত্রীদের মানসিক উন্নতি সাধন হবে। ৩। অনেক সময় দেখা যায় কোনো একটি বাস দুর্ঘটনার স্বীকার হলে চালক-সহযোগী উভয়ই পালিয়ে যায়? সে ক্ষেত্রে তাদের আইনের আওতায় আনতেও অনেক সময় কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে প্রতিটা বাসচালক ও সহযোগীর সুনির্দিষ্ট তথ্য বাস মালিকের কাছে থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে? পাশাপাশি প্রতিটা বাসের ভেতর তাদের ছবি, মোবাইল নং এবং লাইসেন্স নং সংবলিত একটা কাগজ ঝুলানো থাকবে (যা ইতোমধ্যে যাত্রাবাড়ী-মিরপুর রুটের ট্রান্স সিলভা বাসে করা হয়েছে)। ৪। প্রতিটা বাসের ভেতর বাসের নাম্বার সংবলিত স্টিকার/কাগজ লাগিয়ে দিতে হবে, যাতে বাসের ভেতর কেউ হয়রানির স্বীকার হলে ভেতরে থাকা অবস্থায়ই সাহায্যের জন্য কাউকে বাসের বর্ণনাসহ জানাতে পারে। ৫। বাস-মালিকদের মধ্যে অন্তত মাসে একটা মিটিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তাদের সম্পর্কের অনেক উন্নতি সাধন হবে। ৬। সম্প্রতি হাইকোর্ট কর্তৃক রায় দেয়া হয়েছে যাতে লাইসেন্স দেয়ার আগে চালকের মাদক পরীক্ষা করা হয়। সে ক্ষেত্রে যারা ইতোমধ্যে লাইসেন্স পেয়ে গেছে তারা এই পরীক্ষা থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে। তাই প্রতিটা বাস টার্মিনালে, বাস স্টেশনে পুলিশের সহায়তায় মাদক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পাশাপাশি দরিদ্র বাসচালক সহযোগীদের জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্য সহায়তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ৭। বাসচালক ও তার সহযোগীর জন্য মাসে একটা করে কাউন্সিলিং অনুষ্ঠান করা যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে তারা অংশ নিতে কতটুকু ইচ্ছুক হবে সেটা বড় একটা বিষয়। তাই সরকারের সহায়তায় এই কাজটি করতে হবে যাতে কাউন্সিলিংয়ে অংশ নিলে তাদের জন্য খাবার এবং একটা নির্দিষ্ট ভাতার ব্যবস্থা করা যায়। এ ক্ষেত্রে সমাজের বিত্তশালীরা অনুদান দিয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ৮। প্রতিটা বাসচালক ও সহযোগীর জন্য একটা নির্দিষ্ট ড্রেস কোড করা যেতে পারে। আর সেটা করা যেতে পারে অনেকটা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় রিকশাচালকদের যেমন অ্যাপ্রনের ব্যবস্থা করা হয়েছে তেমনটা, এতে তাদের মধ্যে একটা শৃঙ্খলা আসবে, তারা যে একটা মহৎ পেশার সঙ্গে যুক্ত সেটা কিছুটা উপলব্ধি হবে। ৯। শহরের অনেক স্থানে বেশ কয়েক মাস ধরে দেখা যাচ্ছে বাস থামানোর জন্য নির্দিষ্ট স্থান চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে। তবে দুঃখের বিষয় সেটা কেউ মানছে না। যার কারণে যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানোর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে অসহনীয় যানজট। তাই এ ব্যাপারে আইন প্রয়োগ করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ১০। সবচেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। কারণ সঠিক ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না পাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম একটা কারণ। তাই চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো কিছুতেই পরিবর্তন আনা একদিনে সম্ভব নয়, একটা নির্দিষ্ট সময় অনুশীলন, পরিচর্যা, পর্যবেক্ষণ এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার সমন্বয়ে সমাজের বা রাষ্ট্রের যে কোনো অসঙ্গতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তাই আমার বিশ্বাস গণপরিবহনে দৈনন্দিন ঢাকাবাসী যে ভোগান্তি পোহাচ্ছে উপরে আমার ক্ষুদ্র পরামর্শগুলো তা কিছুটা হলেও কমিয়ে আনতে পারবে। মো. মনির হোসেন শিক্ষার্থী সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়