পাঠক মত

'প্রভাবহীন ও মূল্যহীন যে মৃতু্য'

প্রকাশ | ০৯ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

নাজমুল হক শিক্ষক ও সাংবাদিক
যদিও সব মৃতু্যর যন্ত্রণা একই ধরনের তবে সব মৃতু্যর প্রভাব একই ধরনের না, বিভিন্ন মৃতু্যর রাষ্ট্রীয় প্রভাব বিভিন্ন ধরনের। একবার কল্পনা করুন চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে টানা ৪ মাস প্রতিদিন ১৩/১৪ জন লোক ডেঙ্গু/চিকুনগুনিয়া অথবা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যবরণ করে তবে রাষ্ট্র, মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। সিটি করপোরেশন বা স্থানীয় প্রশাসন রাত-দিন মশা নির্মূল কর্মসূচি পালন করবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২৪ ঘণ্টার হট লাইন চালু করবে। গণমাধ্যমে একটু পর পর সচেতনতামূলক বিভিন্ন বিজ্ঞাপন প্রচার করবে। স্থানীয় প্রশাসন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ডাক্তারদের সব ধরনের ছুটি বাতিল করা হবে। মহামান্য আদালত স্ব-প্রণোদিত রুল জারি করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরামর্শ টিম প্রেরণ এবং সর্বাঙ্গীন সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসবে। তাছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে মশারি/কয়েল/ স্প্রেসহ মশা মারার সব উপাদান প্রতিটি ঘরে সয়লাব হয়ে যাবে। এবার কল্পনা করুন চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে টানা ৪ মাস প্রতিদিন ১৩-১৪ জন লোক জঙ্গি হামলায় নিহত হয় তবে দেশের সার্বিক অবস্থাটা একটু চিন্তা করুন। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশের তলস্নাশি চৌকি বসে যাবে, গোয়েন্দা সংস্থার হাজার হাজার লোক মাঠে নেমে যাবে, পাড়া-মহলস্নার প্রতিটি বাড়িতে বা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিজিবি বা অন্যান্য প্রতিরক্ষা বাহিনী দিন-রাত নজরদারি করবে। গণমাধ্যমে একটু পর পর সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী বিজ্ঞাপন প্রচার হবে। পাড়া-মহলস্নার প্রত্যেক ব্যক্তি গোয়েন্দা নজরদারি এবং প্রত্যেকে তথ্য ফরম পূরণ করে (ব্যক্তিগত তথ্য) সংশ্লিষ্ট থানায় অবহিত করতে হবে। সর্বোপরি ইউরোপ, আমেরিকা ও জাতিসংঘ যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসবে। এবার ধরুন চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে টানা ৪ মাস প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩-১৪ জন লোক নিহত হয় তবে রাষ্ট্র কি ব্যবস্থা নেবে? অন্য দুটি ঘটনার মত রাষ্ট্র কি এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে? সড়ক-পরিবহন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি ২৪ ঘণ্টার হট লাইন চালু করবে? গণমাধ্যম কি বারবার সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করবে? মহামান্য আদালত কি স্ব-প্রণোদিত কোনো রুল জারি করবে? আইন-শৃঙ্খলা বা প্রতিরক্ষা বাহিনী কি সর্বোচ্চ তৎপরতা দেখাবে? ব্যক্তিগতভাবে আমরা কি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করব? অথচ ১২ মে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষায় জাতীয় কমিটি তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে টানা ৪ মাসে ১৪৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫৫২ জনের প্রাণহানী হয়েছে অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ১৩-১৪ জনের মৃতু্য হচ্ছে অর্থাৎ প্রথম দুটি ঘটনা কাল্পনিক শেষেরটি বাস্তবিক কিন্তু কি ব্যবস্থা গ্রহণ করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আমাদের দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনায় এখন চরম বিশৃঙ্খলতা বিরাজ করছে। বাংলাদেশের ৭০% সড়ক ব্যবহার করছে মাত্র ৫% গাড়ি মালিকদের ব্যক্তিগত গাড়ি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডঐঙ) তথ্যমতে প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ২১ হাজার লোক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়, এসব মৃতু্যর ৩২% নিরীহ পথচারী অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পথচারী মৃতু্যহার মাত্র ৯% এবং ভুটানে মাত্র ৩%। সড়ক দুর্ঘটনায় যাত্রী মৃতু্যহার ৪১% এবং চালক মৃতু্যর হার ২৭% এবং বাকি ৩২% পথচারী। বৈশ্বিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর ৯০% হয় অনুন্নত দেশে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৬৫% লোকই পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যারা জীবিকার জন্য রাস্তায় বের হয়, যার দরুণ তার মৃতু্যতে সম্পূর্ণ পারিবারটি পথে বসে যায় (সূত্র: ঞযব উধরষু ঝঃধৎ)। উন্নত দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বা আহত ব্যক্তির প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি/পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের সড়ক ও পরিবহনব্যবস্থা এখন একটি ভয়ঙ্কর মৃতু্যর ফাঁদ। প্রতিদিনই এই ফাঁদে পড়ে নিরীহ মানুষের পাশাপাশি মৃতু্যবরণ করছে বিশিষ্ট শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষক, রাজনিতীবিদ, সাংবাদিক, জজ, ব্যারিস্টার এমনকি রাষ্ট্রদূতও অর্থাৎ প্রায় সব পেশার মানুষই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর মিছিলে সামিল হয়েছে। এত লাশ, এত মৃতু্যর পরও ভয়ঙ্কর এই মৃতু্য ফাঁদটি সংস্কার না হয়ে বরং আরও ভয়ঙ্কর হচ্ছে। আর কত বড় মাপের মানুষ বা আর কত লাখ নিরীহ মানুষের লাশ পড়লে আমরা এর থেকে উত্তরণের পথ পাব জানি না।