ইউক্যালিপটাস ও পরিবেশ সুরক্ষা

ইউক্যালিপটাস গাছের ফুল ও ফল ঝরে পড়লে সেখান থেকেও পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেয় বলে কিছু কিছু পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। যেসব এলাকায় ইউক্যালিপটাস গাছ বেশি সেসব এলাকার মানুষের শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বেশি বলে জানা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ গাছের ফুল এবং এর পাপড়িগুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে মানুষের শ্বাসনালিতে গিয়ে ঢুকে এবং দীর্ঘদিন এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে শ্বাসকষ্ট এবং হার্টের অসুখও দেখা দেয়।

প্রকাশ | ১১ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

ড. মো. হুমায়ুন কবীর
ইউক্যালিপটাস একটি বিদেশি গাছ। এ গাছটির আট শতাধিক প্রজাতি রয়েছে। এটি অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে সবচেয়ে বেশি জন্মে থাকে। তবে তার আশপাশে নিউজিল্যান্ড, নিউগিনি, ইন্দোনেশিয়া, এমনকি এশিয়ার ফিলিপাইনেও কিছু জন্মে থাকে। এর বৈজ্ঞানিক নাম ঊঁপধষুঢ়ঃঁং ড়নষরয়ঁধ. স্বাধীনতার পর সীমিত আকারে এটি বাংলাদেশেও বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে। সারা দেশেই এখন ইউক্যালিপটাস গাছটি রোপণ করা হচ্ছে। তা অনেকদূর এগিয়েও গেছে। তবে মাটির গুণাগুণের কারণে এটি বর্তমানে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বেশি রোপণ করতে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া এসব অঞ্চলে ব্যাপক আকারে এ গাছ লাগানো হচ্ছে। শুধু যে বসতবাড়ি কিংবা পতিত জায়গাতেই তা লাগানো হচ্ছে তাই নয় বিভিন্ন ফসলী জমিতে কিংবা তার পাশের রাস্তার আইলও বাদ যাচ্ছে না। আমরা জানি গাছ মানেই পরিবেশ। অধিক গাছ অধিক পরিবেশ রক্ষা। কিন্তু ইউক্যালিপটাস গাছের ক্ষেত্রে এ সত্যটি একেবারেই ফিকে হয়ে যেতে বসেছে। এর অনেক বৈজ্ঞানিক কারণ ও ব্যাখ্যা রয়েছে। ইউক্যালিপটাস গাছটি অনেক লম্বা হয়। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে ১০-১২ তলা দালানের সমান লম্বা হয়ে যায় গাছটি। কিন্তু এ গাছে তেমন কোনো ডাল-পালা থাকে না। তা ছাড়া পাতাও হয় খুব কম পরিমাণে। আর যেগুলো পাতা থাকে সেগুলো খুবই চিকন ধরনের যা রোদে ছায়া সৃষ্টি করতে পারে না। কারণ আমরা সাধারণভাবে জানি যেখানে গাছ থাকবে সেখানে গাছের নিচে ছায়া সৃষ্টি হবে এবং সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ঠান্ডা ও আরামদায়ক হবে। কিন্তু ইউক্যালিপটাস গাছের ক্ষেত্রে পুরো বিষয়টিই যেন উল্টো। গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে ইউক্যালিপটাস গাছ যতটুকু উঁচু হয় তার শিকড়গুলো মাটিতে ততদূরে চতুর্দিকে ছড়িয়ে যায়। আর শিকড়ের গভীরতা যায় অনেক নিচ পর্যন্ত। সেজন্য যতদূর শিকড় যায় সেসব স্থান থেকে পানি ও পুষ্টি শোষণ করে নেয়। সেজন্য যেসব স্থানে ইউক্যালিপটাস গাছ থাকে সেসব স্থানে কিংবা তার আশপাশে কোনো ফসল ভালো হয় না। কারণ ফসল ফলানোর যা পুষ্টি সারের মাধ্যমে দেয়া হয় তার পুরোটাই এ গাছ নিয়ে নেয়। তা ছাড়া ওই গাছের শিকড় থেকে পরিবেশ বিপর্যয়কারী মিথেন গ্যাসসহ অন্যান্য আরও কিছু ক্ষতিকর রাসায়নিক বিমুক্ত হয়। পুকুরের ধারে হলে সেখানে মাছেরও ক্ষতি হয়। ইউক্যালিপটাস গাছের ফুল ও ফল ঝরে পড়লে সেখান থেকেও পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেয় বলে কিছু কিছু পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। যেসব এলাকায় ইউক্যালিপটাস গাছ বেশি সেসব এলাকার মানুষের শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বেশি বলে জানা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ গাছের ফুল এবং এর পাপড়িগুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে মানুষের শ্বাসনালিতে গিয়ে ঢুকে এবং দীর্ঘদিন এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে শ্বাসকষ্ট এবং হার্টের অসুখও দেখা দেয়। তাহলে ইউক্যালিপটাস গাছ নিয়ে এখন কী করা যায়- এ প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট সবার। যেহেতু এ গাছটি বিদেশি এবং এখনো রোপণ করা হচ্ছে। আর যেহেতু উদ্ভিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এসব গাছকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কাজেই এ গাছের বিস্তার রোধ করা প্রয়োজন। তাই নতুনভাবে যাতে আর এ গাছ সৃজন না হয় তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। লাগানো গাছগুলোকে প্রতিস্থাপন করে দেশি জাতের পরিবেশবান্ধব গাছ লাগানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেজন্য ইউক্যালিপটাস গাছের চারা উৎপাদনের নার্সারি বন্ধ করতে হবে। তা ছাড়া নার্সারিতে যাতে এ গাছের চারা উৎপাদন না করে তার ব্যবস্থা করতে হবে। আর যদি ইউক্যালিপটাস গাছ লাগাতেই হয় তবে বিরান বনভূমিকে বেছে নিতে হবে। বাংলাদেশে অনেক বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত রয়েছে যেখানে লোকালয় নেই, ফসলী জমি নেই। সরকারি বনবিভাগও ইচ্ছা করলে তাদের এস্টেটে এ গাছ লাগাতে পারে, তাতে মানুষের কিংবা ফসলের কোনো ক্ষতি হবে না। এ গাছটির একটি সুবিধা রয়েছে যেজন্য মানুষ তা রোপণ করতে আগ্রহী হয়। আর সেটি হলো এর দ্রম্নত বর্ধনশীলতা। তা ছাড়া খুব তাড়াতাড়ি গাছটি সারি (ম্যাচুর) গাছে পরিণত হয় যা দিয়ে সহজেই অর্থকরী কাজে লাগানো যায়। কিন্তু আমাদের দেশেই এখন অনেক দ্রম্নতবর্ধনশীল ও দ্রম্নত কাষ্ঠল গুণাগুণসম্পন্ন হয়ে ওঠে এমন অনেক জাতের গাছ রয়েছে। কাজেই সেসব গাছ দিয়েই ইউক্যালিপটাসকে প্রতিস্থাপন করতে হবে। তাতে পরিবেশও রক্ষা পাবে এবং কৃষকও লাভবান হবেন। ড. মো. হুমায়ুন কবীর: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় শনফযঁসধুঁহ০৮@মসধরষ.পড়স