অগ্নিকান্ড ও সতর্কতা অবলম্বন

বৈদু্যতিক আগুনের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ওভারলোডিং! যখন একই আউটলেট থেকে একাধিক বৈদু্যতিক সরঞ্জাম পস্নাগ ইন করা হয় তখন ওভারলোড হয়ে সার্কিট অত্যধিক তাপ উৎপন্ন করে- যা দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। এক্সটেনশন কর্ড ব্যবহারের আগে আমাদের জানা উচিত এর অভ্যন্তরীণ ওভারলোড প্রটেকশন ব্যবস্থা আছে কী না? আমাদের জানা নেই বলে আমরা সচরাচর তা দেখি না।

প্রকাশ | ১২ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ
ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণগ্রহণ করলে তাদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণগ্রহণকারীকে বাংলাদেশে চালু যে কোনো নন-লাইফ বিমা কোম্পানি থেকে বিমা করা বাধ্যতামূলক কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ না নিয়ে থাকলে তার সম্পদের বিমা করা বাধ্যতামূলক নহে। তবে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান চাইলে তার সম্পদের বিমা করতে পারে। অগ্নিকান্ডে ক্ষতি বর্ণনাহীন। যা আগে থেকে ধারণা করা যায় না আবার আগুন লাগার পর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বুদ্ধি বিবেচনা প্রয়োগ করে কিছু করারও সুযোগ থাকে না। নিজে বাঁচার বা সবার সঙ্গে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টাই তখন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। নিয়তিই জানে কে বাঁচবে আর কে বাঁচবে না। এটাই অগ্নিকান্ডের বাস্তবতা। এই বাস্তবতায় দুর্ঘটনায় ব্যক্তি প্রাণে বাঁচবে না সম্পদের নিরাপত্তা দেবে তা ভাবার বিষয়। ব্যক্তির নিজের জীবনের বিষয় জড়িত না থাকলে অবশ্যই সম্পদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করতে হবে। বিমা দাবি পাওয়ার চেয়ে আগুনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে সম্পদ বাঁচানো যে কোনো ব্যক্তির প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত। তাতে সম্পদের ক্ষতি কম হয় এবং ব্যক্তি ব্যাপক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পায়। অগ্নি দুর্ঘটনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যক্তি নিজে ও তার পরিবার; কোনো প্রতিষ্ঠান থাকলে প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, ব্যাংক, বিমা কোম্পানিসমূহ, যারা সরাসরি অগ্নি বিমার সঙ্গে জড়িত। এই ধরনের দুই চারটা ঘটনা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ব্যাংক-বিমার দেউলিয়াত্বের জন্য যথেষ্ট। তাই সংশ্লিষ্ট সবার বিমাকৃত সম্পদের নিরাপত্তার জন্য যা যা করণীয় তা করতে হবে; এখানে অবহেলা বা গাফিলতির কোনো সুযোগ নেই। নন-লাইফ বিমা কোম্পানিগুলোকে শুধু শুধু বিমা করলেই চলবে না। বিমা করার আগে স্বচক্ষে প্রজেক্ট এবং তার আনুষঙ্গিক সব দিক দেখে বিমা করতে হবে। টঃসড়ংঃ এড়ড়ফ ঋধরঃয বিমার ভিত্তি হলেও আমাদের দেশে তা কতটুকু কার্যকর বিমা কোম্পানিগুলোকে তা ভেবে দেখতে হবে। বর্তমানে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বিমা করার ক্ষেত্রে বিমা কোম্পানি নিজেরা এবং প্রয়োজনে তৃতীয়পক্ষীয় সার্ভেয়ার দ্বারা প্রজেক্টটি চৎব-ওহংঢ়বপঃরড়হ করে তাদের মতামতের ভিত্তিতে বিমা করে থাকে। কিছুটা হলেও আমরা এখন সচেতন হয়েছি। কিন্তু এখনো পুরোপুরি সচেতন হতে পারিনি। অনেক সময়ই আমরা বিমা ব্যবসার স্বার্থে বিমা গ্রহীতাদের অনৈতিক সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েও বিমা করে থাকি যা অনেক সময় ক্ষতির কারণ হয় তা থেকে আমাদের পরিত্রাণের চেষ্টা করতে হবে। \হবিমা গ্রহীতারা কেবল চৎড়লবপঃ-এর মিল, মেশিনারি, আমদানিকৃত মালামাল বা স্টক ওয়ার্কিং প্রসেস, রপ্তানিযোগ্য মজুদমাল বা ফিনিস গুডস্‌ বয়লার, সাব-স্টেশন, জেনারেটর ইত্যাদির বিমা করতে আগ্রহী। এর বাইরে কখনো কখনো ফার্নিচার ফিক্সচার, বৈদু্যতিক অ্যাপলাইয়েন্স, মেশিনারি ব্রেকডাউন ইত্যাদির বিমা ব্যাংকের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির কথা চিন্তা করে ব্যাংক বিমা গ্রহীতাকে ফোর্স করলে তবেই তা করা সম্ভব হয়। অগ্নিকান্ডের সময় পলিসির সঙ্গে সংযুক্ত বিমাকৃত তালিকা হিসাব করে বিমা দাবি নিরূপণের সুযোগ নেই, কারণ আগুনে সব কিছুই ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। সে দিক বিবেচনা করে বিমা গ্রহীতাদের সম্পূর্ণ চৎড়লবপঃ টি বিমা করানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অগ্নিকান্ডের কারণে শুধু সম্পদ নয়, প্রতিষ্ঠানের প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়, শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে যায় এবং প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ থাকাতে মালিক ইঁংরহবংং ওহঃবৎৎঁঢ়ঃরড়হ-এর কারণে স্বাভাবিক মুনাফার পরিবর্তে লোকসানে ডুবে যান। এ সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন একমাত্র বিমা কোম্পানিই তার একমাত্র ভরসা। কিন্তু সঠিকভাবে পূর্ণাঙ্গ বিমা কভারেজ না থাকলে বিমা কোম্পানির কোনো কিছুই করণীয় থাকে না বরং বিমা দাবি না দেয়ার অপবাদ শুনতে হয়। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে বিমা গ্রহীতাদের আমাদের সচেতন করে তুলতে হবে। অগ্নি বিমায় বিমা গ্রহীতাদের নৈতিক ঝুঁকি বেশি দৃশ্যমান হয়। তাই বিমা করার ক্ষেত্রে নৈতিক ঝুঁকির দিকটি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিষ্ঠান বা বিমাকৃত বস্তুর বিষয়বস্তু ঠিক মতো ওয়াকেবহাল হয়ে ও দাহ্যবস্তুর প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ক্ষতি নিবারণের ব্যবস্থা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে সঠিক বিমা করা শুধুমাত্র নিজের আর্থিক নিরাপত্তা নয় বরং সমাজ এবং দেশের সম্পদের নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত করা যায় সে দিকে সবার দৃষ্টি রাখতে হবে। দেশে সংঘটিত অনেক অগ্নিকান্ডের মাঝে সম্প্রতি বনানী এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকান্ডের ফলে সার্বিক আর্থিক ক্ষতির অবস্থা এখনো পুরোপুরিভাবে ওয়াকেবহাল হওয়া যায়নি। এখনো জানি না কতটা প্রতিষ্ঠান কি পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বর্হিভূত ব্যক্তিদের বিনিয়োগই বা কত? অগ্নিকান্ডের প্রকৃত কারণ কি? প্রকৃত জানমালের ক্ষয়-ক্ষতি কি ইত্যাদি ইত্যাদি তথ্য আজো আমাদের অজানা। প্রতিটি অগ্নিকান্ডেই এমন বহুবিধ বিষয় অজানা থেকে যায়। এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকান্ড নিয়ে সবাই যখন আতঙ্কিত সেই সময় প্রথম আলোর ২০১৯-এর ২৭ এপ্রিল সংখ্যায় আফজাল আহ্‌মেদ প্রকৌশলী, বৈদু্যতিক পরামর্শক। বৈদু্যতিক কারণে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হলে কি করণীয় সে সম্পর্কে যে আলোকপাত করেছেন তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে বিমা শিল্পের জন্য সতর্কতামূলক কি ব্যবস্থাগ্রহণ করা দরকার, তা শিল্পে কর্মরত থাকায় তা নিয়ে আলোচনা করার তাগিদ অনুভব করছি :- ঢাকা মহানগর নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ অনুযায়ী যোগ্য ব্যক্তি দ্বারা নকশা প্রণয়ন, যোগ্যতাসম্পন্ন ঠিকাদার দ্বারা ভবন নির্মাণ, বৈদু্যতিক বিদ্যায় পারদর্শী পরামর্শক দ্বারা নিরবচ্ছিন্ন ও নিরাপদ বিদু্যৎ প্রবাহ নিশ্চিত করতে বৈদু্যতিক নকশা, মানসম্মত বৈদু্যতিক উপকরণ ব্যবহার ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ, কার্যকর ফায়ার ডিটেকশন ও প্রটেকশন ব্যবস্থা, হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে হাইড্রেন, স্পিংগলার সিস্টেম রাখা সর্বপোরি ফায়ার সার্ভিসের অবাধ যাতায়াতের জন্য প্রশস্ত রাস্তা রাখা ও প্রয়োজনে রিজার্ভ জলধারের ব্যবস্থা রাখা আবশ্যক। বিমা কেম্পানি হিসেবে আমাদের মনে রাখতে হবে সাধারণত বৈদু্যতিক কারণে আগুন লাগার জন্য দায়ী দুর্বল নকশা, ইনস্টলেশন, সঠিক মানের তার ও ফিটিংস ব্যবহার না করা অদক্ষ ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার/মিস্ত্রি দ্বারা কাজ করানো, লোড ক্যাপাসিটি সম্বন্ধে জ্ঞানের অভাব, একই পয়েন্টে একাধিক কানেকশন দেয়া, ত্রম্নটিপূর্ণ বৈদু্যতিক মালামাল ব্যবহার, অনুপযুক্ত ওভারলোড ও শর্টসার্কিট প্রটেকশন ইত্যাদি ইত্যাদি। বিমাকারী হিসেবে আমাদের মনে রাখতে হবে বিমাগ্রহীতাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে আমরাই পারি প্রাথমিকভাবে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এমনকি দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ রক্ষায় সহায়তা করতে। তাই বিমা পলিসি ইসু্যর আগে আমাদের করণীয়:- ১। যথাযথ কর্তৃপক্ষ দ্বারা অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী সব ব্যবস্থা মেনে বিল্ডিং তৈরি হয়েছে কি না? ২। বিল্ডিং কোড অনুযায়ী বিল্ডিংয়ের সব নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে কি না? ৩। অগ্নিকান্ডের জন্য বৈদু্যতিক ব্যবস্থা একটি গুরুর্ত্বপূর্ণ বিষয়, তা যথাযথ লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে কি না? ৪। বৈদু্যতিক সরঞ্জামাদি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষাণ্মাসিক ও বাৎসরিক রক্ষণাবেক্ষণ প্রতিবেদন পরীক্ষা করে দেখা? ৫। লোড ক্যালকুলেশন করে ওভার লোডের সম্ভাবনা থাকলে কিভাবে বাইপাস করে লোড সঠিক রাখা যায় তা নিয়মিত পরীক্ষা করা হয় কি না ? ৬। বৈদু্যতিক তার ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র ও ফিটিংস সঠিক মানের কি না? ৭। ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর ফায়ার ডিকেশন ও প্রোটেকশন ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করা। ৮। আগুন লাগার পর নিরাপদে নির্গমণের জন্য ফায়ার স্টেয়ার, ফায়ার এক্সিট লাইট, ফায়ার এক্সিট সাইনসও প্রেশায়ইজেশন সিস্টেম ভবনে বিদ্যমান আছে কি না তা দেখা। বৈদু্যতিক আগুনের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ওভারলোডিং! যখন একই আউটলেট থেকে একাধিক বৈদু্যতিক সরঞ্জাম পস্নাগ ইন করা হয় তখন ওভারলোড হয়ে সার্কিট অত্যধিক তাপ উৎপন্ন করে- যা দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। এক্সটেনশন কর্ড ব্যবহারের আগে আমাদের জানা উচিত এর অভ্যন্তরীণ ওভারলোড প্রটেকশন ব্যবস্থা আছে কী না? আমাদের জানা নেই বলে আমরা সচরাচর তা দেখি না। লাইট ফিকচারের অনুমোদিত ওয়েটের অধিক ওয়াটের বাল্ব লাগানো হয়েছে কি না যা আগুন লাগার আরো একটি কারণ। বহুদিন যাবত ব্যবহৃত বৈদু্যতিক তারও ওয়ারিং আগুন লাগার আরো একটি কারণ কিন্তু আমরা তা ভ্রূক্ষেপ করি না। ঘন ঘন লোডশেডিং ও অগ্নিকান্ডের অন্যতম কারণ। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের ফলে দুর্বল বৈদু্যতিক সরঞ্জামাদিতে প্রেসার পড়ে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়। এখন সময় এসেছে এই সব সাধারণ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ভাবার ও বিমার আগে তা খুঁটিয়ে দেখে বিমা গ্রহীতাকে কার্যকর পরামর্শ দিয়ে ক্ষতি কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নেয়া। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ নতুন প্রজেক্টর অগ্নিকান্ডের সম্ভাবনা কম থাকার কারণে ৫ বা ১০ বৎসরের জন্য বৈদু্যতিক সরঞ্জামাদির ওপর ২০% বা ৩০% প্রিমিয়াম রেয়াত দেয়ার ঘোষণা দিলে এবং ৫ বা ১০ বৎসরের পুরাতন বৈদু্যতিক সরঞ্জামাদি ব্যবহারের জন্য ৫০% হারে প্রিমিয়াম লোডিং ব্যবস্থা চালু ও মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষাণ্মাসিক, বাৎসরিক বৈদু্যতিক সরঞ্জামাদি পরীক্ষা ও নতুন সরঞ্জামাদি সংযোজনের প্রতিবেদন প্রজেক্টে রাখা- যা যে কেউ প্রয়োজনে দেখতে পারে এবং সে ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে বিমাকৃত প্রজেক্টের মালিকও বিমা কোম্পানি সবাই উপকৃত হবে এবং অগ্নি দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম হবে। তাই আমাদের বিমা গ্রহীতাকে সচেতন করতে হবে ও আমাদের অগ্নিবিমা করার আগে সর্তক হতে হবে। মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ: ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্সু্যরেন্স কোম্পানি লিমিটেড