প্রয়োজন আর বিলাসিতার পার্থক্য কবে বুঝব

প্যাডের ওপর ভ্যাট আরোপের ইউরোপে নারীরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে অথচ এ দেশে নারী সংগঠন আছে কিনা সেটাই সন্দেহ। কোন যুক্তিতে এবং কেন এই দ্রব্যটিকে বিলাসদ্রব্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হলো তা বোধগম্য নয়। দেশের উন্নয়নের জন্য, অবকাঠামোগত উন্নতির জন্য বাজেট বাস্তবায়নের জন্য 'ভ্যাট'। তবে সেটা 'প্যাডের জন্য প্রযোজ্য নয়।যারা বাজেট তৈরি করেন তাদের বিলাসদ্রব্য আর প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংজ্ঞাটা জানা জরুরি।

প্রকাশ | ১৭ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে আমরা উন্নত দেশের দ্বারপ্রান্তে। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা পৃথিবীর উন্নত দেশকেও পিছে ফেলে রকেটগতিতে এগিয়ে যাচ্ছি দ্রম্নত। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে একজন। নানা অর্জন আমাদের যখন পৌঁছে দিচ্ছে তরতর করে উন্নতির পথে, তখন স্যানিটারি প্যাড কী করে বিলাস দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত হলো সেটাই তো বুঝলাম না। এক সময় এ দেশে স্যানিটেশন ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিল। গ্রামে-গঞ্জে মানুষ খোলা মাঠে বনে-জঙ্গলে প্রাকৃতিক কাজ সম্পাদন করত, কলেরায় এ দেশে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হতো। পানিদূষণ এই কলেরার জন্য দায়ী ছিল। আমরা আমাদের প্রচার আর প্রচেষ্টায় কলেরার মহামারী থেকে মুক্তি পেয়েছি। পাকা পায়খানার আন্দোলন শতভাগ সফল হয়েছে আমাদের। এ ব্যাপারে আমরা ভারতের চেয়েও সফল। আজ বাংলাদেশের কোথাও খোলা মাঠে পায়খানা করার দৃশ্য চোখে পড়বে না। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এই তিনটি চাহিদার পরই আসে স্বাস্থ্যগত চাহিদার কথা। যে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, যে দেশের মানুষের পরার জন্য একখন্ড কাপড় নেই। যে দেশের মানুষের মাথাগোঁজার জন্য মাথার ওপর ছাদ বা চাল নেই সে দেশে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিলাসিতা। একদিকে আমরা উন্নত দেশে পদার্পণের স্বপ্ন দেখব আর অন্যদিকে প্যাডকে বিলাস দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত করব তা কী করে হয়? নিজের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উক্তি, চিন্তা এবং কর্ম প্রত্যাহার করা প্রয়োজন। গল্প শুনেছি, উত্তরবঙ্গে নারী-পুরুষ সবাই এক সময় ক্ষেতে যেত, পাশাপাশি বসে গল্প করতে করতে প্রাকৃতিক কাজ করত। তারা মনে করত এর ফলে ক্ষেতে সার দেয়া হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুগের প্রয়োজনে এ ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। এখন প্রতিটি গ্রামে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করা হয়। একদিনে বা একক প্রচেষ্টায় এ সাফল্য আসেনি। সরকারি, বেসরকারি, এনজিও সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ সাফল্য এসেছে। আজকের কিশোরী আগামীকালের মা। সুস্থ মা মানে সুস্থ সন্তান, আর সুস্থ সন্তান মানে, সুস্থ, সফল জাতি। নারীর পিরিয়ড একটা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বিষয়, যুগের প্রয়োজনেই কুসংস্কার, লজ্জা জয় করে এ ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা চলছে। নারীর চেয়ে পুরুষরাই যেন বেশি এ আলোচনায় অংশ নিচ্ছে। একটা জরিপে দেখা গেছে, ভারতে ১৮ শতাংশ নারী পিরিয়ডের সময় প্যাড ব্যবহার করে। ২০১৪ সালের বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন সার্ভে থেকে জানা যায়, শহরাঞ্চলে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ নারী প্যাড ব্যবহার করলেও উচ্চমূল্যের কারণে ১২ থেকে ১৫ ভাগ নারী সারা দেশে প্যাড ব্যবহার করতে পারে। একটি প্যাড ছয় ঘণ্টার বেশি ব্যবহার করলে ইনফেকশন হতে পারে, যা জরায়ু মুখের ক্যান্সারের বড় কারণ। ড. দেবি শেঠিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের হার্ট অ্যাটাক বেশি কেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, 'কারণ ৪৫ বছর পর্যন্ত প্রকৃতি নিজেই মেয়েদের সুরক্ষা দেয়'। পিরিয়ড মেয়েদের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। এই স্বাভাবিক ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবে শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতও নিতে পারেনি। বরং ভারতের চিত্র আরও ভয়াবহ। বিবিসি থেকে পাওয়া সূত্র : 'কিছু এলাকা আছে সেখানে গ্রামের পর গ্রাম খুঁজে একজনও নারী পাবেন না, যার জরায়ু আছে। বয়স ২০ থেকে ২২, দুই বা তিন সন্তানের মা। সবাই নিম্ন আয়ের শ্রমিক। পিরিয়ড হলে মালিকের নানা গঞ্জনা শুনতে হয়, বেতন কাটা যায়। জরিমানা হয়, তাই পেটের তাগিদে, অভাবের তাড়নায় অপারেশন করে, জরায়ু ফেলে দেন এই নারীশ্রমিকরা।' মহারাষ্ট্রের কিছু এলাকায় গত তিন বছর ধরে এই অমানবিক কাজ চলছে। বাংলাদেশে জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, জীবনের প্রয়োজনেই এখন আর নারীরা ঘরে বসে থাকে না। জীবিকার প্রয়োজনে অথবা অন্যান্য প্রয়োজনে প্রতিদিনই নারীকে সংগ্রাম করতে হয়। ঘরের বাইরে পা রাখতে হয়। যাতায়াত করতে হয়। মাসের অস্বস্তিকর দিনগুলোর সুরক্ষার জন্য, নারীর সুস্বাস্থ্যের জন্য, নানা ধরনের গাইনি সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য পুরনো কাপড় ব্যবহারের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজনে। এক সময় এ দেশের মানুষ তিনবেলা খেতে পারত না, তখন প্যাড ছিল বিলাসিতা। কিন্তু এতদিনে আমরা এগিয়েছি অনেক দূর, পদ্মা সেতুর মতো সেতু তৈরি করছি নিজ অর্থায়নে, এখন প্যাড শুধু প্রয়োজনীয়ই নয় অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত। প্যাডে ভর্তুকি দিয়ে এ দেশের দরিদ্র নারীর ক্রয়ক্ষতার মধ্যে নামমাত্র মূল্য নিয়ে আসা উচিত এই দ্রব্যটি। গার্মেন্টে, কলকারখানায় ফ্রি নারীশ্রমিকের মধ্যে প্যাড বিতরণ করা মালিকদের জন্য বাধ্যতামূলক করা উচিত। স্কুলগুলোতে সরকারিভাবে ছাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে প্যাড বিতরণের সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে ছাত্রীদের সচেতন করে গড়ে তোলা উচিত। ভয় বা লজ্জা নয়, স্বাস্থ্যগত সুরক্ষার জন্য। আগামী দিনের সুস্থ মায়ের জন্য একটি সুস্থ জাতির জন্য নারীর পিরিয়ডজনিত সমস্যাকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে, এই দিনগুলোর নানা জটিলতা থেকে মুক্তি দিতে প্যাড এবং এর কাঁচামালের ভ্যাট প্রত্যাহার আবশ্যক। সেই সঙ্গে ভর্তুকি দিয়ে দরিদ্র শ্রেণির জন্য সহজলভ্য করে যে ৮৫ ভাগ নারী প্যাড এখনো ব্যবহার করে না তাদের জন্য এর ব্যবহার সহজ করে দেয়া প্রয়োজন। পরিবারের কর্তা তার বিড়ি, সিগারেটের জন্য পানের জন্য প্রতিদিনই অর্থ ব্যয় করেন। কিন্তু মাসের ৫-৭ দিনের এই বিশেষ সময়ে প্যাড কিনে টাকা খরচ করতে অনেকেই রাজি নয়। প্যাড ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অথবা এর ব্যবহার না করলে কী কী ভয়ংকর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি রয়েছে তা না জানাও অনেকাংশ এই অনীহার জন্য দায়ী। প্যাডের ওপর ভ্যাট আরোপের ইউরোপে নারীরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে অথচ এ দেশে নারী সংগঠন আছে কিনা সেটাই সন্দেহ। কোন যুক্তিতে এবং কেন এই দ্রব্যটিকে বিলাসদ্রব্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হলো তা বোধগম্য নয়। দেশের উন্নয়নের জন্য, অবকাঠামোগত উন্নতির জন্য বাজেট বাস্তবায়নের জন্য 'ভ্যাট'। তবে সেটা 'প্যাডের জন্য প্রযোজ্য নয়।যারা বাজেট তৈরি করেন তাদের বিলাসদ্রব্য আর প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংজ্ঞাটা জানা জরুরি। শাকিলা নাছরিন পাপিয়া: কবি, কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক ও শিক্ষক