পাঠক মত

সিলেট, মৌলভীবাজারের এই দশা কেন?

প্রকাশ | ১৭ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

জীম হামযাহ মৌলভীবাজার
শাহবাজপুরে ব্রিজ ভাঙনের ফলে সড়কপথে অচলাবস্থা আর দুর্ভোগ যখন বিরাজমান এমন অবস্থায় মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় যে মর্মান্তিক রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে তা অত্র অঞ্চলে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় এবং ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা। এ দুর্ঘটনা এমন এক সময়ে হয়েছে, যখন শাহবাজপুরে একটি ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার ফলে ঢাকার সঙ্গে সিলেটের সড়ক যোগাযোগ ছিল কার্যত বিচ্ছিন্ন। এ বিচ্ছিন্নতার ফলে মানুষের যে দুর্ভোগ তা অবর্ণনীয়। কয়েকদিন থেকে সিলেটের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষের জন্য বিকল্প রাস্তা ছিল রেলপথ। ব্রিজ ভেঙে রেল দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে রেল যোগাযোগও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল। সাধারণত মানুষ মনে করত সড়কের চেয়ে রেলপথ এখনো অনেক নিরাপদ। কিন্তু এই ঘটনা শুধু অনিরাপত্তার শঙ্কা জাগিয়ে তুললো না, গাফিলতি আর অবহেলায় ব্রিটিশদের নির্মিত রেলপথের নিরাপত্তা দিনে দিনে কতটুকু ক্ষয়ে এসেছে সেটাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাল। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় যে ব্রিজটি ভেঙেছে সেটা ভাঙার প্রক্রিয়া মূলত শুরু হয়েছে কয়েক বছর আগে থেকেই। ঘটনার দিন কেবল তার চূড়ান্ত পরিণতির দিকে উপনীত হয়েছিল। আর আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের কোনো সমস্যা প্রমাণ করতে হয় আমাদের জীবন দিয়ে। তার আগ পর্যন্ত যত অনুনয় আর নিবেদন করো কারো টনক নড়বে না। শাহবাজপুরে ব্রিজ ও মৌলভীবাজারে ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার মাধ্যমে মোটা দাগে দেখিয়ে দিয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও এখানকার মানুষ কত অবহেলিত আর দুর্ভোগের শিকার। দেশের রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগের মূল সড়কের অবস্থা যদি হয় নাজুক তাহলে জেলা ও মফস্বলের রাস্তাগুলোর অবস্থা কী তা বলা বাহুল্য। সিলেটের লাগোয়া অঞ্চল মৌলভীবাজার। প্রবাসী অধু্যষিত সিলেট ও মৌলভীবাজার নানা কারণে দেশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। বলতে গেলে মৌলভীবাজার আজ একটা অবহেলিত জনপদের নাম। একটা সময় এ অঞ্চলের মানুষ ছিল প্রবাসমুখী। প্রবাসের আয়ে এ অঞ্চল সমৃদ্ধ ছিল বলা যায়। কিন্তু বর্তমানে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ভিসা বন্ধ, ভিসা জটিলতায় সে পথ অনেকটা বন্ধ প্রায়। তা ছাড়া জীবনযাত্রার ব্যয়ভার বৃদ্ধি, প্রবাসের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো না হওয়ায় এখানকার প্রবাসী পরিবারগুলোও আর আগের মতো ভালো অবস্থায় নেই। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো মৌলভীবাজারে শিল্প-কারখানার মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠায় এখানে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই বলে বেকারত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৌলভীবাজারের রাস্তা-ঘাটে যে বেহাল দশা তা আজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হয়তো। জেলা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত রাস্তার অবস্থা এতই নাজুক যে জরুরি কোনো রোগী নিয়ে জেলার একমাত্র সরকারি সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে স্বজনদের মনে ভীতির সৃষ্টি হয়। বছরের পর বছর এ দুর্ভোগ চলে এলেও রাস্তা সংস্কারে দেখা যাচ্ছে না কোনো উদ্যোগ। যেখানে জেলা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত রাস্তা-ঘাট, কালভার্টের করুণ দশা সেখানে মফস্বলের রাস্তা-ঘাটের অবস্থা কত যে নাজুক থেকে নাজুকতর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গত বছরে মৌলভীবাজারে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার তান্ডব পেছনে রেখে গিয়েছিল ধ্বংসস্তূপ। বন্যায় প্রায় পুরো মৌলভীবাজার আক্রান্ত হয়ে ফসলি জমি, রাস্তা, কালভার্ট, ঘরবাড়ি স্থাপনাসহ জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বন্যাক্রান্ত মানুষের চোখে-মুখে এখনো রয়ে গেছে আতঙ্কের ছাপ। ধ্বংসস্তূপ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি এ অবস্থায় আবারও নদীভাঙনের চরম ঝুঁকিতে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে অত্র অঞ্চলের বাসিন্দারা। গত বন্যায় দুই-তিন দিক থেকে ভাঙনের মুখে পড়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শরীফপুর, হাজিপুরসহ আশপাশের এলাকাগুলো। অনেক জায়গায় রাস্তা-ঘাট উপড়ে নিয়ে গেলেও গত এক বছরে সংস্কারের উদ্যোগ দেখা যায়নি। সীমান্তবর্তী শরিফপুরের চাতলা স্থলবন্দর দেশের আমদানি-রপ্তানির অন্যতম একটি দ্বার। এমনকি চাতলা চেকপোস্ট রোড হয়ে ভিসাযোগে দুই দেশের মানুষ আসা-যাওয়া করে। এই এলাকার বন্যা বিধ্বস্ত রাস্তাগুলো আজও মেরামত করা হয়নি। যার ফলে দুর্দশা চরমে। তিনদিকে ভারত পরিবেষ্টিত শরীফপুর, নমৌজা এলাকার মানুষজনের এপারের সঙ্গে একমাত্র সংযোগ ব্রিজ হচ্ছে মনুনদীর ওপর নির্মিত চাতলা সেতু। ভাঙনের কবলে পড়ে এ ব্রিজটি আজ চরম ঝুঁকিতে। নদী আর কয়েক হাত সামনে এসে ধাক্কা দিলে ব্রিজটি মূল সড়ক থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তখন এই এলাকার মানুষের বের হওয়ার মতোও পথ থাকে না। গত বন্যার পর ব্রিজ লাগোয়া বেড়িবাঁধের ভাঙন একরকম মেরামত করে রাখা হলেও গত এক বছরেও কার্যকর প্রদক্ষেপ নেয়া হয়নি। আজ যখন নদী ফুলে-ফেঁপে বেড়িবাঁধে এসে ধাক্কাচ্ছে তখন নদীতে বালুর বস্তা ঢালা হচ্ছে! শোনা যাচ্ছে নদীভাঙন রোধে বড় অঙ্গের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে কিন্তু মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে রেখেও সে প্রকল্প বাস্তবায়নে এত ধীরগতি কেন, এর জবাব কে দেবে? সিলেট, মৌলভীবাজারের বেদনার বিষাদ সিন্ধু বর্ণনা করলেও যেন আজ শেষ হয় না। আর এমন চিত্র একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দিনে দিনে অব্যাহত অবহেলায় এই পরিণতির দিকে এগিয়েছে। অথচ এমন বেহাল অবস্থা তো আগে ছিল না। আজ কেন এই দশা, কেন এই অবনতি? যারা এখান থেকে জনপ্রতিনিধি হয়ে সংসদে যান তাদের কাজটা কী? সরকারের কাছ থেকে জনগণের অনেক অধিকার যদি আদায় করে নিতে হয়, তারা কি আদৌ এ অঞ্চলের জনগণের জন্য কিছু আদায় করতে পারছেন? আর চারদিকে যদি এত এত উন্নয়ন হয়ে থাকে তাহলে সিলেট, মৌলভীবাজার কেন বা বঞ্চিত থাকবে?