ডেঙ্গু ও বন্যা মোকাবিলা

ডেঙ্গু ও বন্যা মোকাবিলায় সরকার সবসময় সতর্ক রয়েছে। বন্যা মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে স্থায়ী পরিকল্পনার দিকে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কীভাবে কমানো যায় সে বিষয়েও নিতে হবে যথাযথ উদ্যোগ এবং এর কোনো বিকল্প নেই।

প্রকাশ | ৩১ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
দেশ ডেঙ্গু ও বন্যা দুটোতেই আক্রান্ত। বন্যার ধকল কিছুটা কমে এলেও যতই দিন যাচ্ছে রাজধানীতে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ডেঙ্গু ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকভাবে। দেশের ৫০ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে সারাদেশের মানুষ এক মহাআতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। কখন কে আক্রান্ত হয় সে ভয়ে রয়েছে। সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যারা তারা এটাকে মহামারি বলছেন। এবার বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই ডেঙ্গুর আগ্রাসন দেখা দিয়েছে। সরকারি হিসাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ হাজারেরও বেশি। এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অন্তত ২৫ জনের বেশি মানুষের মৃতু্যর খবর গণমাধ্যমে এলেও সরকারি হিসাবে এখনও মৃতের সংখ্যা ১২ জন। এ বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এত রোগী ভর্তি হয়েছে- যা অকল্পনীয়। হাসপাতালে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। হাসপাতালের মেঝেতেও জায়গা নেই। এক হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে রোগীর স্বজনরা দিশেহারা হয়ে ছুটছে অন্য হাসপাতালে। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গুর ধরন পাল্টে গেছে। আগে যেমন তীব্র জ্বরের সঙ্গে গায়ে রেশ ওঠা, ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যেত, এবার সে সব লক্ষণ ছাড়াও অনেক রোগীই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে জ্বর হলে ঘরে বসে চিকিৎসা না নিয়ে যত দ্রম্নত সম্ভব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কিংবা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, ডেঙ্গু মোকাবিলায় এরই মধ্যে ৬৭টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। ৪৭৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যুক্ত করা হয়েছে। এরা ডেঙ্গুর বিষয়ে নাগরিকদের সচেতন করে তুলছে। মশার বংশ বাড়তে না দেয়ার জন্য সিটি করপোরেশনেরও বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের জন্য মশা নিধনের ব্যর্থতাকে দায়ী করা হচ্ছে। দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মশা নিধনের ওষুধ ছিটানো হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। অভিযোগ উঠেছে ভেজাল ওষুধের ব্যাপারেও। এ ব্যাপারে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। তারপরেও কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, এডিস মশা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়ে ভয়ের বা আতঙ্কের কোনো কারণ নেই। উলেস্নখ্য, এডিস মশা শুধু আমাদের দেশেই নয়- ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশেই এ সময় প্রার্দুভাব দেখা যায়। সাধারণত জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত এর প্রার্দুভাব বেশি দেখা যায়। সেপ্টেম্বর মাস থেকে এমনিতেই কমে আসবে ধারণা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বাইরে থাকলেও তিনি প্রতিমুহূর্তের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। তার নির্দেশ অনুযায়ী সবাই কাজ করছেন। এর অংশ হিসেবে গত ২৫ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত ঢাকাসহ সারাদেশে একযোগে মশক নিধন সপ্তাহ পালন করা হয়েছে। এডিস মশার প্রাদুর্ভাব যাতে বৃদ্ধি না পায় সে জন্য ক্রাশ প্রোগ্রাম নেয়া হয়েছে। যা দুই সিটি করপোরেশনে আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। এ ছাড়া এডিস মশা প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে শিক্ষক, ছাত্র, মসজিদের ইমামদের নিজ নিজ এলাকায় জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করতে বলা হয়েছে। এটা সত্য, শুধু রাজধানী নয়, বাইরেও ডেঙ্গুর থাবা বিস্তৃত হওয়ায় বাড়তি উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব রোধে মশা নিধনের বাড়তি ব্যবস্থা নেয়া হবে। গড়ে তোলা হবে নাগরিক সচেতনতা; জন মনে আতঙ্কের মধ্যেও এই প্রত্যাশা করা অমূলক নয়। এটা সবাই জানে, ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা। বর্ষা মৌসুমে ছাদে বা ফুলের টবে পানি জমে থাকলে তা এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এডিস মশা দিনের বেলায় কামড়ায়। ফলে দিনের বেলায় যাদের ঘুমানোর অভ্যাস তাদের এডিস মশার শিকার হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। পরিকল্পিত কার্যকর উদ্যোগ এবং নাগরিক সচেতনতাই কেবল পারে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে। দুই. তুলনামূলকভাবে পানির উচ্চতা প্রবাহ, যা নদীর তীর অতিক্রম করে ধাবিত হয়, তীর ছাড়িয়ে পানি আশপাশের সমভূমিকে পস্নাবিত করে এবং ক্ষেতের ফসল, বৃক্ষ, গবাদিপশু ও ঘরবাড়িসহ মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে সর্বগ্রাসী বন্যা। ভারী বৃষ্টিপাত, হিমালয়ে তুষার গলন এবং হিমবাগুর স্থানান্তর সংঘটনের কারণে বন্যা দেখা দেয়। ১৯৮৮ সালে পানি ১১২ সেন্টিমিটার এবং ১৯৯৮ সালে বিপদসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দেশে বন্যার সৃষ্টি করেছিল। এবার যমুনা নদীর পানি বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপদসীমার ১৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এবং অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। অতীতে বাংলাদেশে বন্যা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে ১৯৬৬, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৮ ও ২০১৭ সালে। প্রতিবছর বাংলাদেশে ২৬ হাজার বর্গমিটার এলাকা বন্যায় পস্নাবিত হয়। এবার বন্যায় দেশের ২৮ জেলায় ৬০ লাখ ৭৪ হাজার ৪১৫ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আর বন্যাকবলিত চৌদ্দ জেলায় বিভিন্ন কারণে ৭৫ জনের মৃতু্য হয়েছে, যার মধ্যে অধিকাংশই শিশু। বন্যা মোকাবিলায় সরকার সতর্ক আছে এবং প্রত্যেক জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুত রয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। ৭৫ জনের মধ্যে পানিতে ডুবে ৬৭ জন এবং নৌকা ডুবে ৮ জনের মৃতু্য হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ছয় লাখ ৩০ হাজার ৩৮৩ জন বন্যায় সর্বস্ব হারিয়েছেন, ৫৪ লাখ ৪০ হাজার ৩২ জন হয়েছেন আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশের ২২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। ওই ২২ শতাংশ ত্রাণ পেতে পারে। কোথায় ত্রাণ পাচ্ছে না- তা সুনির্দিষ্টভাবে বললে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ছাড়া এক কোটি ১৭ লাখ টাকা গৃহ মঞ্জুরি, এক লাখ ১৩ হাজার কার্টন শুকনো ও অন্যান্য খাবার, শিশু খাদ্য কেনার জন্য ১৮ লাখ টাকা, গোখাদ্যের জন্য ২৪ লাখ টাকা এবং আট হাজার ৫০০ তাঁবু বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। \হসরকারি এ হিসাবে বলা হয়েছে, বন্যায় ২৮ জেলার ১৬৩ উপজেলা, ৪৯ পৌরসভা, ৯৬১ ইউনিয়ন এবং ৬ হাজার ৫৩টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাঁচ লাখ ৬৬ হাজার ৩৭৮ ঘরবাড়ি, এক লাখ ৫৩ হাজার ৭৩৩ একর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত বন্যায়; মারা গেছে ৪৫টি গবাদিপশু, ২২ হাজার ৩৩৯ হাঁস-মুরগি। এ ছাড়া ৪ হাজার ৯৩৯টি শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ৭ হাজার ২৭ কিলোমিটার সড়ক, ২৯৭টি ব্রিজ বা কালভার্ট, ৪৫৯ কিলোমিটার বাঁধ, ৬০ হাজার ২৮৯টি টিউবয়েল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে আশার কথা, বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতির দিকে। দেশের প্রধান নদনদীগুলোর পানি শনিবার থেকে হ্রাস পাওয়া শুরু করেছে। দেশে এবং উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা একেবারেই কম এবং আগামী সপ্তাহেও ভারী বৃষ্টিপাতের লক্ষণ কম। নদনদীর পানি এখন হ্রাস পাচ্ছে, আগামী দুই সপ্তাহ তা অব্যাহত থাকবে। দুই সপ্তাহের মধ্যে বড় বন্যার ঝুঁকি দেশে নেই। আগামী ১০ দিন ভারতীয় অংশে বাংলাদেশের উজানে বিশেষ করে নেপাল, আসাম, মিজোরাম এবং মেঘালয়ে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা কম। তবে হালকা ধরনের বৃষ্টিপাত হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশেরও বিভিন্ন অংশে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হবে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এবার বন্যা দেখা দেয়া জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলবীবাজার, নেত্রকোনা, শেরপুর, টাঙ্গাইল, জামালপুর, বগুড়া, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও চাঁদপুর। বন্যায় এসব জেলার মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। ডেঙ্গু ও বন্যা মোকাবিলায় সরকার সবসময় সতর্ক রয়েছে। বন্যা মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে স্থায়ী পরিকল্পনার দিকে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কীভাবে কমানো যায় সে বিষয়েও নিতে হবে যথাযথ উদ্যোগ এবং এর কোনো বিকল্প নেই। সালাম সালেহ উদদীন: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক