দুর্নীতির পারমাণবিকীকরণ

দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আফগানিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। ২০১৭ সালে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭ নম্বরে। সেখানে ২০১৮ সালে চার ধাপ পিছিয়ে এখন ঠাঁই হয়েছে ১৩ নম্বরে।

প্রকাশ | ০১ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

মাহমুদুর রহমান সুমন
হালফিল বাংলাদেশে দুর্নীতি আর দূরের নীতি নয়। হাঁটিহাঁটি পা পা করে খুবই কাছে চলে এসেছে আমাদের। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হিসেবে জেঁকে বসেছে। গত কিছুদিন ধরে বালিশ নিয়ে কত কান্ডই না ঘটছে। নালিশ গিয়ে গড়িয়েছে হাইকোর্ট অব্দি। রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের 'মহামূল্যবান' বালিশ নিয়ে কথা! গোপন কথাটি আর গোপন থাকেনি। হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে সাংবাদিকরা। বালিশকান্ড নিয়ে খবরের কাগজে তোলপাড়। ফেসবুকে ধুন্ধুমার কমেন্টস, তর্ক-বিতর্ক, নিন্দা সমালোচনার ঝড়। এক প্রকার সুনামিই বলতে গেলে। সাম্প্রতিক আপডেট : রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্রের আবাসিক প্রকল্পে বালিশ নিয়ে যে অভিনব, নজিরবিহীন ও চাঞ্চল্যকর দুর্নীতি হয়েছে, সেই লুটপাটের প্রমাণ পেয়েছে এসংক্রান্ত তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে গৃহায়ন অধিদপ্তরের কমিটি ৬২ কোটি টাকা এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কমিটির প্রতিবেদনে ৩৬ কোটি ৪০ লাখ ৯ হাজার টাকা লুটপাটের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই যে দুর্নীতি, তার দায়ে নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলমসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। এই সুপারিশের পাশাপাশি এই পরিমাণ অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হয়েছে। গত ১৬ জুলাই ২০১৯ অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে দুটি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমা দেয়া হয়। এই ঘটনার একটু পিছন ফিরে দেখি আমরা। বলা নেই কওয়া নেই, দেশজুড়ে বেড রুমের বালিশ নিয়ে আচমকা এত হালস্নাচিলস্না, চায়ের কাপে তুফান তোলা কেন? ঘুমানোর নিরীহ উপাদান বালিশ কেন কী কারণে কীভাবে লোকজনের মুখে মুখে চলে এলো? কী সেই রহস্য? ঈশ্বরদীর রূপপুরে আবাসিক ভবনের জন্য বিভিন্ন জিনিসপত্র কেনাকাটায় দুর্নীতি হয়েছে- গত মে মাসে এমন রিপোর্ট বের হয়েছিল খবরের কাগজে। তারপর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কী ছিল সংবাদপত্রের সেই প্রতিবেদনে, যা নিয়ে এতই হুলস্থূল কান্ডকীর্তি? ওই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল : 'প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ সম্পন্ন হওয়া নয়টি ভবনের ৯৬৬টি ফ্ল্যাটের জন্য আসবাব কেনা শেষ হয়েছে। এর মধ্যে একটি ২০তলা ভবনের ১১০টি ফ্ল্যাটের আসবাবপত্র কেনা ও তা ভবনে ওঠাতে সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে ২৫ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ২৯২ টাকা। ২০তলা ওই ভবনটির প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য প্রতিটি বালিশ কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা করে। ফ্ল্যাটে ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৭৬০ টাকা। ৯৪ হাজার ২৫০ টাকা করে কেনা প্রতিটি রেফ্রিজারেটর উপরে ওঠাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১২ হাজার ৫২১ টাকা। একেকটি ওয়াশিং মেশিন কেনা হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা দরে। ফ্ল্যাটে ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৩০ হাজার ৪১৯ টাকা করে।...'। ইত্যাদি ইত্যাদি। আজগুবি খরচ আরও আছে। বিশদ পরিসংখ্যানে পাঠকের মাথা গুলিয়ে যেতে পারে। মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'অভিযুক্ত কর্মকর্তারা মালপত্র কেনায় দর নির্ধারণের ক্ষেত্রে গণপূর্ত সিডিউলে বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণের কথা বললেও বাস্তবে দেখা যায়, তারা কিছু ফ্যাক্টরস যেমন- শ্রম, পরিবহন, সানড্রি এবং ওঠানো বাবদ অতিরিক্ত ও অস্বাভাবিক মূল্য ধরেছেন বলে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। আসবাব পরিবহন এবং বিভিন্ন তলায় ওঠানো এবং সেটিং গণপূর্ত পাবনা বিভাগ প্রণীত প্রাক্কলিত মূল্যের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। আলোচ্য ৯টি ভবনের আসবাব ও হোম অ্যাপস্নায়েন্সসহ আনুষঙ্গিক কাজের জন্য পাবনা গণপূর্ত বিভাগ প্রণীত এবং রাজশাহীর অতিরিক্তি প্রধান প্রকৌশলী কর্তৃক অনুমোদিত মূল্য ২৩১ কোটি ৪৭ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। অন্যদিকে কমিটি প্রণীত ওই কাজের প্রাক্কলিত মূল্য ১৬৯ কোটি ২৭ লাখ ৯ হাজার টাকা। যা অনুমোদিত প্রাক্কলিত মূল্য ৬২ কোটি ২০ লাখ ৮৯ হাজার টাকা কম।' গৃহায়ন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, 'প্রকল্পের যে ব্যয় দেখানো হয়েছে তা বাজারমূল্যের চেয়ে ৬২ কোটি টাকা বেশি। ইতোমধ্যে ৩৬ কোটি টাকা সংশ্লিষ্ট খাতে পরিশোধ করা হয়েছে। যে টাকা বাজারমূল্য থেকে বেশি পরিশোধ করা হয়েছে, প্রকল্পের পরবর্তী প্যাকেজের সঙ্গে সমন্বয় করে কেটে রাখতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দুর্নীতির জন্য ৩৪ জনকে দায়ী করা হয়। বড়-ছোট রুই-কাতলারা এই ঘটনায় যুক্ত। এখন তারা মুক্ত অবশ্য। অভিযুক্ত করার প্রক্রিয়া চলমান। তবে শেষতক কতখানি সফল হবে সেই প্রক্রিয়া, আলস্নাহ মালুম! দুর্নীতি এখন আর ব্যক্তি খাতে নয়, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উন্নীত (!) হয়েছে। এই যে নির্লজ্জ জোচ্চুরি, তাকে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ যদি বলি, ভুল হয় কি? এটা তো পুকুর চুরি নয়, সমুদ্র চুরির শামিল। উচ্চপর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দুর্নীতির ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে। সর্ব অঙ্গে ব্যথা মলম দেবো কোথা- এমনই একটা অবস্থা। সরকারি পর্যায়ে এই যদি হয় আস্থা, দায়িত্বশীলতা ও বিশ্বস্ততার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, তাহলে কেমন সোনার বাংলা আমরা পেতে চলেছি, তা সহজেই অনুমেয়। বাংলার মাটিতে এই দুর্নীতিবাজদের বিচার কতটুকু শেষ অব্দি হবে, আদৌ হবে কিনা, সে ব্যাপারে নিঃসংশয় হতে পারছি না আমরা। কথায় বলে না, ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। নিকট অতীতে, দূর অতীতে এমনধারা বহু তুঘলকি কান্ডকারখানা ঘটেছে। তা থেকে আমরা কতটা শিক্ষা নিয়েছি? যদি কোনো শিক্ষা আদৌ আমরা নিতাম, তাহলে এমন ভয়ঙ্কর পারমাণবিক দুর্নীতির অভিসম্পাত আমাদের গ্রাস করত না। জাতির মুখে চুনকালি লেপন করে দিতে পারত না। সত্যি সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশ! ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে। গত বছরের (২০১৮) তুলনায় এবার চার ধাপ অবনতি ঘটেছে বাংলাদেশের। টিআইর এবারের সূচক অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে সোমালিয়া। আর সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ হলো ডেনমার্ক। দুর্নীতিতে বাংলাদেশের সমান অবস্থানে রয়েছে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক এবং উগান্ডা। দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আফগানিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। ২০১৭ সালে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭ নম্বরে। সেখানে ২০১৮ সালে চার ধাপ পিছিয়ে এখন ঠাঁই হয়েছে ১৩ নম্বরে। টিআই বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান টিআইয়ের প্রতিবেদন প্রকাশ করে দুর্নীতির কারণগুলোর কথা উলেস্নখ করেছেন। এসব কারণ হচ্ছে- দুর্নীতির বিরুদ্ধে অঙ্গীকারের সঙ্গে বাস্তবায়নের অমিল, হাই প্রোফাইল লোকজনের দুর্নীতি চিহ্নিত করে তাদের বিচারের আওতায় না আনা, সরকার ও রাজনৈতিক দল এক হয়ে যাওয়া, আর্থিক ও ব্যাঙ্কিং খাতে ঋণখেলাপি ও জালিয়াতি বৃদ্ধি, ভূমি-নদী-খাল-বিল দখল, টেন্ডার ও নিয়োগে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ না থাকা, অবৈধ অর্থের লেনদেন বন্ধ না হওয়া, দুর্বল জবাবদিহিতা, দুদকের কার্যকারিতা ও স্বাধীনতার অভাব, অস্বীকারের সংস্কৃতি, দায়মুক্তি ও দুর্বল আইনের শাসন, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের ক্ষেত্র সংকুচিত করা ইত্যাদি। শুধুই কি বালিশকান্ড? না। আমাদের চারদিকে দুর্নীতির খবর। অক্টোপাসের মতো ধরেছে দুর্নীতি। জাতির কাঁধে চেপে বসেছে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো। নামানো যাচ্ছে না। দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে যে কেলেঙ্কারি হয়েছে, তাতে নাম আসছে সাবেক একাধিক এমডিসহ কোল মাইনিং কোম্পানির দুই ডজন কর্মকর্তার। দুদক এখন মাঠে নেমেছে। পেট্রোবাংলার তদন্তে কয়লা দুর্নীতির বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছিলেন তারা। সে জন্য তাদের জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হচ্ছে। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা হয়েছিল। বলা হয়েছিল সিস্টেম লসের কারণে কয়লার ঘাটতি হয়েছিল। দুদকের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে যে দুর্নীতির কারণেই ঘটেছিল ওই ঘটনা। ১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা গায়েবের ঘটনা জনসমক্ষে চলে আসে। এই দুদক নিয়েও প্রশ্নের কাঁটা খচখচ করে জনমানসে। বেড়ায় যখন ক্ষেত খায়, জনগণ তখন অবশ্যই অসহায়। দুদকের ইমেজ কতটা উজ্জ্বল? দেশবাসী তা ভালোই জানেন। ক্রেস্টে সোনা জালিয়াতি, মুক্তিযুদ্ধের ভুয়া সনদ- কত ঘটনা। একটার চেয়ে অন্যটা বিস্ময়কর। সর্বসাম্প্রতিক খবর- কবর থেকে লাশ চুরির মতো পৈশাচিক ঘটনাও ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় কবর থেকে কঙ্কাল চুরির মতো লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে। গাজীপুরে কঙ্কাল চুরি ঠেকানোর জন্য শুরু হয়েছে কবর পাহারা দেয়ার কাজ। মরেও কী তাহলে শান্তি নেই? পুনশ্চ: ১৮ জুলাই ২০১৯ ডিসিদের সম্মেলনে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, 'সরল বিশ্বাসে কেউ দুর্নীতি করলে বা অপরাধে জড়ালে সেটা অপরাধ নয়।' মাহমুদুর রহমান সুমন: কলাম লেখক