শিশুশ্রম বন্ধে বের করতে হবে প্রকৃত সমাধান

অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে শিশুরা নানা শ্রমে নিয়োজিত হয়। এ ক্ষেত্রে ভেদ নেই শহর, নগর, গ্রাম ও বন্দরের। সর্বত্র অপুষ্ট দেহে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নামতে বাধ্য করা হয়। বিনিময়ে যথাযথ পারিশ্রমিক জোটে না অনেকেরই। উপরন্তু হতে হয় নিপীড়নের শিকার। জাতীয় শিশুনীতি অনুসারে ৫ থেকে ১৮ বছরের কোনো শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারবে না। ৫ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত শিশুশ্রম নিয়োগকর্তার জন্য দন্ডনীয়।

প্রকাশ | ০২ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

অধ্যক্ষ সুমনা ইয়াসমিন
আমাদের দেশে শিশুদের বৃহত্তর অংশ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে আসছে। গরিব, দুস্থ পরিবারের শিশুরা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। অল্প বয়স থেকেই অভাব অনটনের তাগিদে বাধ্য হয়ে এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যোগ দিতে হচ্ছে। এসব শিশুদের সুকৌশলে স্কুলমুখী করা তো দূরের কথা সামাজিক বৈষম্যের কারণে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর শিশুরা তাদের জীবনের তাগিদে শ্রম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। আমাদের দেশের শহর-শহরতলিতে বসবাসকারী বস্তিবাসীসহ রেলস্টেশন, টার্মিনাল, লঞ্চঘাট, হাটবাজারে অস্থায়ী বা স্থায়ীভাবে বসবাসকারী পরিবারের অধিকাংশ শিশু অভিভাবকের সঙ্গে কাজে সহযোগিতা ছাড়াও রিকশার গ্যারেজ, গাড়ির গ্যারেজ, বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে এমন কি বালু, পাথর কোয়ারি ছাড়াও হোটেল রেস্টুরেন্টে গস্নাস বয় হিসেবে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। এসব ছাড়াও কৃষি ক্ষেত্রেও শিশুরা অবাধে শ্রম বিক্রি করলেও অল্প মজুরিতে এসব শিশু রাত-দিন খেটে যাচ্ছে। এদের ভবিষ্যৎ বলতে কিছুই নেই। এসব শিশু সামাজিকভাবে অবহেলিত। শিশু হিসেবে যে অধিকার পাওয়ার কথা, তা থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো (বিবিএস) এর জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ-২০১৩ অনুসারে দেশে প্রায় ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু শ্রমিক আছে। এদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু শ্রমিক। শ্রম মন্ত্রণালয়ের মতে এই সংখ্যা ১৩ লাখ। প্রায় ৪৫টি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ শিশুরা করে থাকে। পরিসংখ্যান বিভাগের সর্বশেষ এক জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট শিশুর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ কোটি। এর মধ্যে সব সেক্টর মিলিয়ে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা দেড় কোটিরও বেশি। যেসব সেক্টরে শিশুরা কাজ করে এদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো টেক্সটাইল, প্রিন্ট ও এমব্রয়ডারি, পোশাক শিল্প, চামড়া শিল্প, জুতার কারখানা ও ইটভাটা ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে বেশি শিশু কাজ করে কৃষিক্ষেত্রে এবং কলকারখানায়। এ ছাড়াও শিশুরা হাটে-বাজারে, হোটেল রেস্টুরেন্টে, ওয়েল্ডিং, ওয়ার্কসপে কাজ করে। অনেক শিশু রিকশাভ্যান চলায়। শহর এলাকায় বিশেষ করে ঢাকা শহরের মাঝারি যানবাহনগুলোতে যেমন লেগুনা, টেম্পো ইত্যাদিতে ছোট ছোট শিশুরা কাজ করে। চলন্ত অবস্থায় ঝুঁকির মধ্যে যাত্রী ওঠানো, ভাড়া আদায় করে তারা। অনেকে লেদ মেশিন চালায়। বিড়ি ফ্যাক্টরিতে অনেক ঝুঁকির মধ্যে বিষাক্ত তামাক পাতা হাতে নিয়ে কাজ করে। তা ছাড়া শিশুদের একটা বিশাল অংশ ফেলে দেয়া জিনিস পত্র কুড়িয়ে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেক শিশু বাসের হেলপার হয়। জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা সে হারে কমছে না বরং প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এই শিশুরা সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, বিনিময়ে ন্যায্য মজুরি পায় না। ঠিক মতো খেতে পারে না। প্রতিদিন তাদের সংগ্রাম চলতেই থাকে। এই শিশুদের স্বপ্ন হারিয়ে যায়। খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা তো পরের কথা, জীবনে বেঁচে থাকাই হয়ে ওঠে মুখ্য বিষয়। শিশুশ্রম বন্ধে প্রকৃত সমাধান বের করতে হবে। শিশুদের পরিবারের কর্মক্ষম অভিভাবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাকরণ, শিশুদের ফ্রি চিকিৎসা, লেখাপড়ার সমস্ত খরচ বহন, অর্থাৎ প্রতিটি পরিবারের কর্মক্ষম সদস্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ছাড়াও শিশুদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শিশু কল্যাণে সরকারি বরাদ্দ ও বেসরকারি সংস্থা ছাড়াও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা পথশিশুসহ কর্মরত শিশুদের কল্যাণে প্রাথমিক পর্যায় কারিগরি ও কৃষি শিক্ষা প্রদান করতে পারলে এসব শিশুরা অল্প মজুরিতে শ্রম বিক্রি না করে স্বাবলম্বী হতে পারবে। তাই শিশুদের হাতেখড়ি হিসেবে কারিগরি ও কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলে মানবসম্পদে পরিণত করা সম্ভব হবে। সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে শহরের বস্তিসহ গ্রামীণ পর্যায় কারিগরি প্রাথমিক পর্যায় শিক্ষা প্রদানে সব ধরনের অনিয়ম দূরীকরণে সচেষ্ট হতে হবে। শিশু শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের কোনো প্রকার অপচয় কঠোর হতে দমন করতে হবে। এ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যাপারে জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে সমাজে অবহেলিত বঞ্চিত শিশুদের প্রয়োজনে অর্থ দিয়ে ও সমষ্টিগতভাবে কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে তুলতে হবে। তবেই হিংসা, বিদ্বেষকে বিতাড়িত করে অসাম্প্রদায়িক মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে উঠবে। অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে শিশুরা নানা শ্রমে নিয়োজিত হয়। এ ক্ষেত্রে ভেদ নেই শহর, নগর, গ্রাম ও বন্দরের। সর্বত্র অপুষ্ট দেহে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নামতে বাধ্য করা হয়। বিনিময়ে যথাযথ পারিশ্রমিক জোটে না অনেকেরই। উপরন্তু হতে হয় নিপীড়নের শিকার। জাতীয় শিশুনীতি অনুসারে ৫ থেকে ১৮ বছরের কোনো শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারবে না। ৫ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত শিশুশ্রম নিয়োগকর্তার জন্য দন্ডনীয়। শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে এসব শিশুকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। আইন করে শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের পাশাপাশি সবাইকে মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে শিশুশ্রম বন্ধে শক্তিশালী কমিশন গঠন করে বিষয়টি পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা। সুমনা ইয়াসমিন : অধ্যক্ষ, উত্তরা ইউনাইটেড কলেজ ও সভাপতি স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ, ঢাকা মহানগর উত্তর