বঙ্গবন্ধু: মৃতু্যঞ্জয়ী এক মহানায়ক

অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এই মৌলিক অধিকারগুলো পূরণের মাধ্যমে বাঙালি উন্নত জীবন পাবে, দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি পাবে, সেই চিন্তাই তিনি প্রতিনিয়ত করতেন। বাংলার মানুষের মুক্তির এই মহানায়ক মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে যখন জাতীয় পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছিলেন তখনই নৃশংস ঘাতকের নির্মম বুলেট স্ত্রী-পুত্র-পরিজনসহ কেড়ে নিল তার প্রাণ!

প্রকাশ | ০২ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

দিবাকর সিকদার
"একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।" (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান) সময় বয়ে চলে অবিরাম। সময়ের পথ-পরিক্রমায় কিছু স্মৃতি হারিয়ে যায়, আবার কিছু স্মৃতি মনের মনিকোঠায় স্থায়ী আসন পেতে নেয়। ১৯২০ সালটি বাঙালি জাতির জন্য চিরস্মরণীয় একটি সময়। ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে স্বাধীন বাংলার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, সেই দুঃসময়কে অতিক্রম করে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে চিরতরে বাঙালির কাছে ফিরিয়ে দিতে আবির্ভূত হন বিশ্বের সংগ্রামী মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বাঙালির মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবের জন্ম। পিতা: শেখ লুৎফর রহমান, মাতা: বেগম সায়রা খাতুন। ১৯৩৮ সালে মাত্র আঠার বছর বয়সে সহধর্মিণী হিসেবে গ্রহণ করেন বেগম ফজিলাতুন্নেসাকে। চার বোন, দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ১৯৪১ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। ১৯৪৬ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে ধ্বনিত হয় এক কালপুরুষের দীপ্ত পথচলা। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। রাজনৈতিক অঙ্গনে শেখ মুজিবের সম্পৃক্ততা বেড়ে চলে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং তিনি এর সঙ্গে যুক্ত হন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে হরতাল পালনের সময়ে ঢাকায় গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ হন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত ও গ্রেপ্তার হন। বাংলার নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের শোষণ মুক্তির সংগ্রামে শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃস্থানে আসীন হন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে টুঙ্গিপাড়া এলাকা থেকে পূর্ববঙ্গ সাধারণ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার কৃষি, বন ও সমবায় মন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ১৯৫৫ সালের কাউন্সিল সভায় আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে দলকে অসাম্প্রদায়িক করার ক্ষেত্রে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে নানা ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে তিনি বাঙালিদের সংগঠিত করতে থাকেন। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের স্বপ্নের বীজ বাঙালিদের হৃদয়ে বপন করতে সক্ষম হন তিনি। ১৯৬৬ সালে লাহোরে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে আমাদের বাঁচার দাবি '৬-দফা কর্মসূচি' পেশ করেন। 'আগরতলা মামলা' নামক মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ফুঁসে ওঠে বাঙালি। ১৯৬৯ সালে প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে 'আগরতলা মামলা' নামক মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলাটি প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রম্নয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমানকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় বঙ্গবন্ধুকে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতার আসনে অধিষ্ঠিত করে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবতার আরো কাছাকাছি চলে আসে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, তর্জনী উঁচিয়ে বাঘের গর্জন ধ্বনিত হলো, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হলো পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। একদিকে দীর্ঘ নয় মাস ধরে বাঙালিদের ওপর চলল পাকিস্তানি আগ্রাসন, বাঙালিদের রক্তাক্ত প্রতিরোধ আর অন্যদিকে পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগারে প্রতিমুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর মৃতু্যর হাতছানি। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ আর কয়েক লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আসে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, মৃতু্যঞ্জয়ী মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরে এক মুহূর্ত সময় অপচয় করেননি। পাকিস্তানি হানাদাররা শুধু এ দেশের ৩০ লাখ মানুষকেই হত্যা করেনি, এ দেশের স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, অফিস-আদালত, কল-কারখানা সব ধ্বংস করে দেয়। স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনে শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম। দিন-রাত বঙ্গবন্ধুর অক্লান্ত পরিশ্রম আর কূটনৈতিক পারদর্শিতায় বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য! ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের হাতে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। ব্যাহত হয় স্বাধীন বাংলাদেশে স্বপ্নিল অগ্রযাত্রা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বঙ্গবন্ধু মানেই প্রতিটি বাঙালির মনের মুকুরে ভেসে ওঠে এক বীর নায়কের প্রতিচ্ছবি। ভেসে ওঠে বাংলার প্রতিটি নির্যাতিত মানুষের প্রতি দরদ ও ভালোবাসা সিক্ত একটি মানুষের মুখ। যে অসাধারণ ধৈর্য, সাহস ও দৃঢ়তা নিয়ে তিনি তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামে অসংখ্য অগ্নি-পরীক্ষার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি শাসক ও শোষক চক্রকে রুখে দাঁড়িয়ে একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়েছেন, তার তুলনা বিশ্বে বিরল। প্রতিটি সংগ্রামেই শেষ পর্যন্ত তিনি বিজয়ীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তার অদম্য সাহস, ইস্পাত-কঠোর সংকল্প, আদর্শ ও লক্ষ্যের প্রতি নিষ্ঠা এবং জনগণের ঐক্য ও সংহতিতে প্রগাঢ় বিশ্বাস থেকে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার মুহূর্তেও তিনি এক বিন্দু সরে আসেননি। তিনিই বীর যিনি মৃতু্যকে ভয় পান না। আমৃতু্য স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য নিমগ্ন ছিলেন বলেই তিনি স্বাধীনতার মহান স্থপতি, তিনিই বাঙালির 'জাতির পিতা'। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এই মৌলিক অধিকারগুলো পূরণের মাধ্যমে বাঙালি উন্নত জীবন পাবে, দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি পাবে, সেই চিন্তাই তিনি প্রতিনিয়ত করতেন। বাংলার মানুষের মুক্তির এই মহানায়ক মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে যখন জাতীয় পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছিলেন তখনই নৃশংস ঘাতকের নির্মম বুলেট স্ত্রী-পুত্র-পরিজনসহ কেড়ে নিল তার প্রাণ! সেদিন নরঘাতকদের হাত একটুও কাঁপেনি। সোনার বাংলার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই এক ইতিহাস। তার মৃতু্য হয়নি। তিনি মৃতু্যঞ্জয়। মৃতু্যর তুচ্ছতা অতিক্রম করে তিনি আজকের ও আগামীকালের মহানায়ক। দিবাকর সিকদার: কলাম লেখক