গুজবের প্রতি মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তিটা কী

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমুল পরির্বতন আনা প্রয়োজন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে কুদরত এ খুদার নেতৃত্বে যে শিক্ষা কমিশন হয়েছিল সেই শিক্ষা কমিশনের গৃহীত নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা দরকার। তাহলে এই গুজবীয় অলীক বিষয়গুলো মানুষের মনে আর প্রবেশ করতে পারবে না।

প্রকাশ | ০৩ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
সারাদেশে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাধ্যমতে চেষ্টা করছে তা থামাতে। তবে মানুষের মন থেকে ছেলেধরার ভয়টা কিছুতেই কাটতে চাচ্ছে না। গণমাধ্যমগুলোতে গুজবে কান না দেয়ার জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিভিন্ন তথ্য সূত্র থেকে জানা, একটি মহল গুজব ছড়িয়েছে যে, পদ্মা নদীতে যে সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে সেই সেতুতে শিশুকে উৎসর্গ করতে হবে (বিষয়টির অর্থ হলো এমন পদ্মা সেতুর নির্মাণ স্থানে শিশুদের জবেহ বা বলি করতে হবে তাহলে সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হবে)। সেতুতে শিশু উৎসর্গ যে কোনো ধর্ম মতেই গ্রহণযোগ্য না। তা হলে কেন এই গুজবটি বাংলাদেশের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্বাসে ঢুকে গেল। মানুষ বিশ্বাস করে ফেলেছিল যে, সেতু নির্মাণে শিশু উৎসর্গের প্রয়োজন রয়েছে, তাই ছেলেধরারা শিশু ধরে নিয়ে সেতু নির্মাণকারীকে দিয়ে দিচ্ছেন। সেই ভয়ে শিশুদের রক্ষার্থে ছেলেধরা সন্দেহের মানুষগুলোকে তারা পিটিয়ে মেরে ফেলছেন। সেতু নির্মাণে সার্বক্ষণিক কাজ করছে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর। সরকারি কর্মীদের উপস্থিতিতে শিশু নিধনের মতো এ রকম অমানবিক কাজ কোনো ক্রমেই সম্ভব না। এই বিশ্বাসবোধটাও মানুষ হারিয়ে ফেলেছিল। ফলে দেখা গেছে (ছেলেধরার গুজবীয় সময়টাতে) দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশু উপস্থিতির হার কমে যায়। শিশু বলি বা শিশু হত্যা করে সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা আদ্যে কি সম্ভব? এটা যে অবাস্তব বিষয় তা বুঝতে অসুবিধা নেই। তাহলে কেন এ ধরনের গুজবে মানুষ কান দিচ্ছে? এক বিংশ শতাব্দীতে এসেও বাংলাদেশের মানুষের কেন মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারণা? যেখানে উপমহাদেশে ডিজিটাল বা ই-নেট ব্যবহারে বাংলাদেশের অবস্থান অন্যতম। তারপরও কেন মানুষ বিশ্বাস করে যে, শিশু বলি দিলেই নির্মাণকাজ বা অন্য কোন কঠিন বিষয় সহজেই সম্পন্ন হয়ে যাবে? এমন কোনো নির্দশন কি কেউ দেখেছে কখনো? যদি না দেখে থাকে, তাহলে কেন এই গুজবে মানুষ কান দিচ্ছে? এ দেশে মানুষের মনে ধর্মীয় আচার এবং ধর্মীয় সংস্কৃতিটা নিপুণভাবে প্রোথিত হয়ে আছে (তা মানুষটি যে ধর্মই পালন করুন না কেন তার ধর্মের বিষয়টাই মূল), আর সেই বিশ্বাস থেকে অলৌকিক ঘটনাগুলো মানুষ বিশ্বাস করে। প্রতিটি ধর্মেই রয়েছে বহু রকমের বা ধরনের অলৌকিক কিছু ঘটনা- যা মানুষ বিনা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে বা কোনো যুক্তিতর্ক ছাড়াই বিশ্বাস করে। ধর্মীয় সব অলৌকিক ঘটনাই প্রাচীন, কেউ দেখেছে এমন কোনো নির্দশন নেই, তবে বংশ পরম্পরায় শুনে আসছে বা পুস্তক বা বই থেকে পড়েছে। এই অলৌকিক ঘটনাগুলোর বাস্তবসম্ভবত ব্যাখ্যা বিশ্লষণ করা যাবে না, শুধু মাত্র বিনা যুক্তিতে বিশ্বাস করে যেতে হবে। যদি কেউ এর বাস্তব ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ বা যুক্তির মাধ্যমে বুঝতে চান বা বুঝাতে চান তাকে নাস্তিক আখ্যা দেয়া হয়। সুতরাং এ দেশের সেতু নির্মাণ করার জন্য শিশু বলির প্রয়োজন তা অবিশ্বাস হলেও ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরায় বর্ণিত অন্য অলৌকিক ঘটনার আবহে এটাও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠে। উপমহাদেশের রাজনীতিতে ধর্মটা প্রধান অনুসঙ্গ, বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তানে রাজনীতিবিদরা নির্বাচনী বৈতরণি পার হচ্ছেন ধর্মকে ব্যবহার করে। সুতরাং রাজনীতিবিদরাই নিপুণতার সঙ্গে মানুষের মনে ধর্মকে প্রবেশ করিয়ে দেন। ভারতের গত নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি চারদিন গুহায় ধ্যানমগ্ন থেকে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন, বাংলাদেশে কওমি শিক্ষাকে (যে শিক্ষাকে অনেকেই ইসলামের মূল শিক্ষা বলে মনে করেন) সমমর্যাদা দিয়ে সরকার এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট নিজেদের পক্ষে নিয়ে গেছেন। অনুরূপভাবে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানেও হচ্ছে। প্রতিটি ধর্মেতে কিছু ঘটনা আছে যার বাস্তব সম্ভবত ব্যাখ্যা করলে বুঝা যায় তা কল্পনাপ্রসূত হওয়াটাই স্বভাবিক। তবে এ ঘটনাগুলোকে অলৌকিক কাহিনী বলা হয়। আর অলৌকিক কাহিনীগুলো বিশ্বাস না করলে ধর্ম নষ্ট হয়ে যায়। তাই ধর্মে বর্ণিত কাহিনীগুলো বাস্তবতা নিরীক্ষণ করার কোনো উপায় নেই। যেহেতু ধর্মীয় কাহিনীগুলোর সঙ্গে বাস্তবসম্মত অনেক কিছু মিল নেই তাকে ধর্মীয় বিশ্বাসের নিরিখে মেনে নিতে হয়, সেই রকম কিছু মানুষ অজ্ঞতা প্রসূতভাবে গুজবগুলোকে বিনা যুক্তিতে বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ না করে বিশ্বাস করে থাকে। গুজব এই উপমহাদেশে একটি প্রচলিত প্রথার মতো হয়ে দাঁড়িয়ে। গুজবের প্রতি মানুষের বিশ্বাসের মূল ভিত্তিটা ঘটেছে অনেকটা ধর্মীয় অলৌকিক ঘটনার সঙ্গে মিল রেখেই। তাই দেখা যায়, গুজবগুলোও ধর্মীয় অলৌকিক ঘটনার মতো করে বংশ পরম্পরায় মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, গুজবের মতো অপসংস্কৃতিটা দ্রম্নত ছড়ায়। আর এই ছড়ানো গুজবের রোষানলে পড়ে প্রাণ হারায় নিরীহ মানুষ। বাংলাদেশে শিক্ষিতের হার ৬০-৭০ শতাংশের মতো। এই উচ্চহারের শিক্ষিতদের দেশে কি করে গুজব ছড়ায়? আসলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কি রয়েছে তাও দেখার প্রয়োজন। দেশের শিক্ষায় আধ্যাত্মিকতা একটি মূল বিষয়বস্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে কোনো কিছুর পরির্বতনের সম্ভাবনা রয়েছে এমন কিছু বিষয়ও এ দেশের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত আছে যা খালি চোখে বুঝা যাবে না। রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অন্যতম প্রকৌশল বিশ্বদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়টির মূল মন্ত্র হলো 'ঐশীর জ্যোতি আমাদের প্রদর্শক'। এখানে প্রশ্ন হলো এই ঐশীর জ্যোতিটা কি? তিনি কিভাবে পথ দেখাবেন বা দেখাচ্ছেন? এর বাস্তব সম্ভবত ব্যাখ্যা কি? তবে এর একটা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ রয়েছে। এর ব্যাখ্যা হলো প্রতিটি মানুষকেই কোনো অন্তর্ধানে অবস্থান করা নির্দেশনাই পথ দেখায়, বাস্তবতার জগতে তিনি আড়ালে থেকে সব কিছু করে থাকেন, তার নিয়মেই জগতের নানা কিছু ঘটে। এ রকম বিশ্বাসটাই মানুষকে আধ্যাত্মিকায় মগ্ন করে ফেলেছে। এ ধরনের আধ্যাত্মিকতার ওপর ভর করে, যদি এ দেশের প্রকৌশল বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষণ প্রদান করা হয় তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষণ পদ্ধতিটা যে আরো বেশি আধ্যাত্মিকতা নির্ভর তা সহজেই অনুমান করা যায়। সুতরাং আধ্যাত্মিকতানির্ভর শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের মনে কুসংস্কার বা অপসংস্কৃতি সহজেই প্রবেশ করতে পারে। কারণ আধ্যাত্মিকতা হলো একটি বিমূর্ত বিশ্বাস- যা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আধ্যাত্মিকতার বিমূর্ত বিশ্বাসের বিষয় বস্তুগুলোকে যুক্তি বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা যায় না। এই বিশ্বাসটিকে বিনা তর্কে মানুষ সন্তর্পণে নিজ মনে লালন করে। আর আধ্যাত্মিকতা লালনকারীর মনে অনুরূপ আধ্যাত্মিক ঘটনা বা যা গুজব তা অনেকটা অন্তর্নিহিত কল্পনা; এ রকম কিছু মানুষের বিশ্বাসে ঢুকে যাওয়াটা অস্বভাবিক বলে কিছু না। অধ্যাত্মবাদের বিশ্বাসে বিশ্বাসীরা আধ্যাত্মিকার সুফল অনেকটা সময় ইহজাগতিক ভাবে পায় (এটা তাদের ধারণা) আর না পেলে তা পরজগতে পাবে এই আশায় তারা আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো বিশ্বাস করে আসছে যুগ যুগ ধরে। আধ্যাত্মিকতার বিশ্বাসের কারণেই আধ্যাত্মবাদীরা মনে করে, বিনা শ্রমে কোনো কঠিন কাজ হয়ে যাবে বা কাজটিতে যথার্থ উপকরণ ব্যবহার না করে অধ্যাত্মিক ধ্যানের মাধ্যমেই তা সফলভাবে সম্পাদন করা সম্ভব হবে। অনুরূপ বিশ্বাসের ফলেই সৃষ্টি হয় নানা গুজব। সুতরাং এ দেশে গুজবীয় সংস্কৃতিটার মূল কারণটা কি তা সহজেই বুঝা যায়। গুজব সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাজনীতিবিদরা রাজনীতির উদ্দেশ্যে গুজব রটাচ্ছেন বলে বক্তৃতা বিবৃতি দিচ্ছেন। তবে যে কোনো কারণেই গুজবটা রটুক না কেন তা কিন্তু মানুষ গ্রহণ করছে সাময়িকভাবে। কেন, কি কারণে মানুষ গুজবকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে গ্রহণ করছে তার অন্তর্নিহিত রহস্যটি উদঘাটন করা দরকার আগে, তা না করে বিষয়টিকে রাজনৈতিককরণ করাটা ঠিক হচ্ছে না। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের ন্যায় রাজনীতিবিদরা যেমন ধর্মকে ব্যবহার করে ঠিক তেমনি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেও তারা গুজব ছড়াতে পিছপ হয় না। দেশের মানুষের যথার্থ শিক্ষার অভাবে গুজবগুলো রটছে এবং সাময়িকভাবে মানুষের মনে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠে। সার্বিক বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বিজ্ঞান এবং বাস্তবসম্মত শিক্ষার অভাবে এ দেশে গুজবগুলো যে কেউ ছড়িয়ে দিতে পারছেন। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমুল পরির্বতন আনা প্রয়োজন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে কুদরত এ খুদার নেতৃত্বে যে শিক্ষা কমিশন হয়েছিল সেই শিক্ষা কমিশনের গৃহীত নীতিমালা অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা দরকার। তাহলে এই গুজবীয় অলীক বিষয়গুলো মানুষের মনে আর প্রবেশ করতে পারবে না। \হ শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: কলাম লেখক