দিবাযত্ন থেকে বৃদ্ধাশ্রম

প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

নাবিল হাসান সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সভ্যতার আরও সভ্য হওয়ার ব্যাপক প্রতিযোগিতায় আজকের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বড় দুটি ফলাফলের তথাকথিত নাম হলো 'ডে-কেয়ার সেন্টার' আর 'বৃদ্ধাশ্রম'। কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন আমাদের নাবিল হাসান। খুঁজতে খুঁজতে সাহায্য নিলেন গুগল স্যারের/সাইটের। বের করলেন সামান্য পরিমাণের ইতিহাস, পরিসংখ্যান আর সম্ভাবনাভিত্তিক ভবিষ্যৎ। ডে-কেয়ার বা দিবাযত্ন সেন্টার আর বৃদ্ধাশ্রমের আনুপাতিক সংখ্যা আর সম্পর্কের মাত্রা নির্দেশের জন্যই আজকের আয়োজন। মূলত কাজ হলো এই দুটি বিষয়কে নেড়েচেড়ে পোস্টমর্টেম করা। নচিকেতার এই গানটি কে না শুনেছি বলেন- 'ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার। নানান রকম জিনিস, আর আসবাব দামি দামি সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি। ছেলের আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম!' গানটির মর্মার্থ অনেককে করেছে মর্মাহত, অনেকের বিবেকে তুলেছে মহাপস্নাবন আর সূক্ষ্ণ বিচারশক্তিকেও ছাড়েনি। বৃদ্ধাশ্রমের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে, পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনে। ঘরছাড়া অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের এই উদ্যোগ ছিল শান রাজবংশের। খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতাড়িত বৃদ্ধদের জন্য আলাদা এই আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করে ইতিহাসে আলাদা জায়গাই দখল করে নিয়েছে এই শান রাজবংশ। পৃথিবীর প্রথম প্রতিষ্ঠিত সেই বৃদ্ধাশ্রমে ছিল বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আরাম-আয়েশের সব রকম ব্যবস্থাই। ছিল খাদ্য ও বিনোদনব্যবস্থা। ইতিহাসবিদরা এই বৃদ্ধাশ্রমকে প্রাচীন চীনে গড়ে ওঠা সভ্যতারই অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে অভিহিত করেছেন। উদ্দেশ্য ছিল যে মানবিক সেবা কিন্তু জানেন ভায়া আর বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজনবোধ নানাবিধ বাংলাদেশের কথা যদি বলি তো বলতে হয়, বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা প্রবর্তন হয় ডা. একেএম আবদুল ওয়াহেদের হাত ধরে। বার্ধক্যে সবার জন্য শারীরিক-মানসিক সুস্থতা ও স্বস্তিময় জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ডা. একেএম আবদুল ওয়াহেদের উদ্যোগে ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান। সরকারি উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে ঢাকার আগারগাঁওয়ে নিজস্ব ভবন এবং পরে ১৯৯৩-৯৪ সালে সরকারি অনুদানে হাসপাতাল ও হোম ভবন নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠানটির ৫০টিরও বেশি শাখা রয়েছে। এ ছাড়া কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যেমন- অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতি, ব্র্যাক, ইআইডি, প্রবীণ অধিকার ফোরাম। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় প্রবীণদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী ছিল ১৯৯০ সালে ৪০ লাখ ৯০ হাজার। এরপর ১৯৯১ সালে দাঁড়ায় ৬০ লাখে। ২০১০ সালের পর ১ কোটি ২৫ লাখের বেশিতে এসে দাঁড়ায় এ সংখ্যা। ২০২৫ সালে এ সংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ হবে প্রায়। অবস্থা বুঝতেই পারছেন। আর ডে-কেয়ার সেন্টারের খই উৎপাত শুরু হয় সাম্প্রতিক দশকে। প্রথম ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের জামালপুর জেলায় সরিষাবাড়ী উপজেলায় তিনটি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে ইউনিসেফ। পরে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দিবাযত্ন কেন্দ্র গড়ে উঠতে শুরু করে বিচ্ছিন্নভাবে। সরকারি উদ্যোগের মোট ৪৩টি ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে বাংলাদেশে। অধিকাংশই অবশ্য ঢাকায়। সারা পৃথিবীর ইতিহাস তো বর্ণনা করা সম্ভব নয়; কিন্তু ইন্টারনেটে সার্চ দিলে নানাবিধ নিউজ পোর্টাল বা পার্সোনাল সাইটেও এরকম ঘটনার কালিক ধারার অভাব নেই। বৃদ্ধাশ্রম আর ডে-কেয়ার সেন্টারের জীবনপ্রবাহ, সুবিধা-অসুবিধা আর নানান কথা হয়তো বলা লাগবে না কারণ এসব আপনি আমি এবং আমরা সবাই জানি। হিসাব-নিকাশ করে আপনারা উপযোগিতা/বাহুলতা বের করে নেবেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে পৃথিবী সর্বপ্রথম 'বৃদ্ধাশ্রমের' অভাববোধ করেছিল তারপর 'ডে-কেয়ার সেন্টারের। কেন এমনটি হলো? বৃদ্ধ মানুষ কি স্বেচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমে দিন কাটায় নাকি অন্য কোনো কারণে? বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা তাহলে কি বেড়েই চলেছে? বৃদ্ধাশ্রম কি মানবিক প্রশ্নেরও উপরে? এই কতক প্রশ্ন হয়তো আমার মাথায় এসেছে যদিও আরও থাকতে পারে। আর দ্বিতীয়ত ডে-কেয়ার সেন্টার কেন এত দ্রম্নত বৃদ্ধি পাচ্ছে? ডে-কেয়ার সেন্টার থেকে যদি নাইট-কেয়ার সেন্টারের জন্ম হয়? মানে ২৪/৭-কেয়ার সেন্টারের কথা বলছি। ব্যবসায়িক মেধাসম্পন্ন মানুষ হয়তো উদ্যোগ নিতে পারেন। তার পরের প্রশ্ন হলো- সন্তানের সামাজিকীকরণে কি ডে-কেয়ার সেন্টার আদৌ কোনো ভালো ভূমিকা রাখছে? সন্তানের পারিবারিক সম্প্রীতি বা পারিবারিক আদর্শ কি সন্তানের মধ্যে প্রবেশ করছে? কয়েকটা মহা প্রশ্ন হয়তো আপনার মতো ধৈর্যশীল আর ভাবুককে আরেকটু ভাবিয়ে তুলবে। করি তবে, ডে-কেয়ার সেন্টার কি বৃদ্ধাশ্রম ত্বরান্বিত করবে না? বৃদ্ধাশ্রমে কি আপনার ভবিষ্যৎ বৃদ্ধাশ্রমী হওয়ার বীজ রোপিত থাকে না? দশ মাস দশদিন পেটে ধারণের ব্যাপক যন্ত্রণা পরে আঁতুড়ঘরে আপনাকে ভূমিষ্ঠ করেছিলেন আপনার মা। বাবার ত্যাগস্বীকারের বিশাল কথা আমার আর্তনাদটি পড়া বন্ধ করে ৫ মিনিট ভাবুন। সেই মা-বাবাকে যখন জীবনভোগের ব্যাপক সুবিধার্থে রেখে আসলেন বৃদ্ধাশ্রমে ঠিক তখনি পৃথিবীর বুকে একবার করে ঘৃণার থুতু পরে। যেই অসহায় ছেলেটাকে ছোট্টবেলায় মা-বলা শেখায় সে কিনা আজ বলে, বৃদ্ধাশ্রমে আরও আরামে থাকবি, যে সন্তানকে হাতে ধরে হাঁটা শেখায় সেই সন্তান কিনা আজ বলে ওইখানে আরামে শুয়ে-বসে কাটাবি, হাঁটাহাঁটির ভয় নেই, আরে যেই সন্তানের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতেই মা-বাবার এই পৃথিবীজোড়া আয়োজন সেই একই সন্তান বলে ওঠে, সময়মতো খাবার দিয়ে যাবে। প্রত্যেকটা বৃদ্ধাশ্রমের মানুষের একেকটা দিন একেকটা মৃতু্যবরণ। আর ডে-কেয়ারের কথা কী বলব! শিশুর সুষ্ঠু বিকাশ আর মানবিক হওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা নিয়ে লেখার কোনো প্রয়োজনবোধ করি না কারণ এ নিয়ে বিশেষ লেখার অশেষ আয়োজন সাজানো রয়েছে পুরো ইন্টারনেট জগৎ। আমার কেন যেন মনে হয় বৃদ্ধাশ্রম বাড়ার ক্ষেত্রে ডে-কেয়ার সেন্টার বাড়ায় একটা মিষ্টিমধুর সম্পর্ক আছে। ডে-কেয়ারে থাকা সন্তানটি একদিন চাইবে তার মা-বাবা বৃদ্ধাশ্রমে থাকুক কারণ অসহায় কাল তো দুটাই: শিশুকাল আর বার্ধক্য। সমাজের সূক্ষ্ণ বাস্তবতা নামক শিক্ষকের এরকম নির্দয় শিক্ষার্থী হবে এটাই রূঢ়বাস্তবতা। আজকাল বৃদ্ধাশ্রম যেন হয়ে উঠেছে একেকটা 'বিশেষ কেয়ার' সেন্টারের ডেমো। আর কী কী ধরনের সেন্টার হতে পারে বৃদ্ধাশ্রম আর ডে-কেয়ার সেন্টারের আগেপাছে? এসব হয়তো অদূর ভবিষ্যৎকালের বিষম জ্বর। সে যাই হোক সভ্যতা উৎকর্ষ সাধনের এসব পরিণামের সমাধান যে থাকবে না তা কিন্তু নয়। কারণ যত মুশকিল তত আসান, বলে গেছেন সাকিব আল হাসান। সমাধানের বিশাল পথ খুঁজে বের করার এই গুরুভার আপনাদের সবাইকেই নিতে হবে। আমি এমনি এমনি সমাধানের কয়েকটা কথা বলি যদিও উভয় বিষয়টি একটা মানবিক বিষয় প্রধানত।