আকাশ সংস্কৃতির কবলে দেশ

প্রকাশ | ১৮ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

মাহমুদুল হক আনসারী ঢাকা
আকাশ সংস্কৃতির কবলে গোটা দেশ ভাসছে। সংস্কৃতির মাধ্যমে একটা দেশের পরিচয় পাওয়া যায়। শিক্ষা সংস্কৃতি, জাতিকে জাগিয়ে তুলে আবার ধ্বংসও করতে পারে। সংস্কৃতি একটা বিপস্নব। নীরব এ বিপস্নবের মাধ্যমে সমাজকে নানাভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব। বাংলাদেশের মূলত কী ধরনের সংস্কৃতির লালন ও ব্যবহার সে বিষয়ে এখনো দেশের অনেক সচেতন নাগরিক বুঝে উঠতে পারছে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা কৃষ্টি, কালচার ও সভ্যতা কী নিয়ে গঠিত সে সব ইতিহাস-ঐতিহ্য-প্রজন্ম সঠিকভাবে বুঝতে ও গ্রহণ করতে বুঝে উঠতে পারছে না। শিক্ষায় যেভাবে এ দেশের শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন গড়ে উঠছে, একই ভাবে বাস্তবে স্বাধীন বাংলাদেশের কী সংস্কৃতি সেটাও ঠিক করতে পারছে না। বাংলাদেশ বহু ধর্মীয় অনুসারীর দেশ। এখানে মুসলিম হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বহু উপজাতীয় ধর্মীয় অনুসারীদের মানুষের বসবাস। তাদের কৃষ্টি-কালচার-সংস্কৃতি সেখানেও ভিন্ন ভিন্ন রুচি আচার-অনুষ্ঠান রয়েছে। তবে বাংলাদেশের সব মানুষের সংস্কৃতির কোনো না কোনো জায়গায় কিছু কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেও ভাবগাম্ভীর্যের আনুগত্য দেখা যায়। ধর্মে ধর্মে হানাহানি উচ্ছৃঙ্খলতা সেখানেও সহমর্মিতা সম্প্রীতি রয়েছে। তবে একটি জায়গায় এখনো গোটা জাতি অন্ধকারে নিমজ্জিত। সেটা হচ্ছে, আকাশ সংস্কৃতি। বাংলাদেশের আকাশে সারা পৃথিবীর সব চ্যানেলে উন্মুক্ত দেখা যাচ্ছে। একটা সীমানায় আরেকটা দেশের চ্যানেলের প্রচার প্রকাশের কী নিয়ম সে বিষয় আমি বেশি অবগত না হলেও অন্ততপক্ষে এটুকু বলা যায় অনুমতি নিয়ে এক দেশের চ্যানেল অন্য দেশে প্রচারের সুযোগ পায়। মনে হয় বাংলাদেশের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়েই এ দেশে হাজার হাজার চ্যানেল সরকারি-বেসরকারিপর্যায়ে প্রচার পাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উন্মুক্ত হওয়ায় এসব চ্যানেলের আধিক্য বৃদ্ধি পেয়েছে। শহর থেকে গ্রাম এখন সবখানে বসেই এ দেশের মানুষ বাতাসের মাধ্যমে স্যাটেলাইটের সুবিধা নিচ্ছে। হাজার প্রকারের চ্যানেল বাংলাদেশের আকাশে ঘুরছে। বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ভালো-মন্দের সব চ্যানেলের চাবি ঘরে বসেই পাওয়া যাচ্ছে। ভাল-মন্দ উপকার-অপকার বাচ-বিচার না বুঝেই সব চ্যানেলের ব্যবহার সমাজে হচ্ছে। এসব চ্যানেলে ক্রাইম, হাইজ্যাক, মারামারি, অপহরণ, পরিবারের নানা চরিত্রে তৈরি করা নাটক ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পারিবারিক, সামাজিক নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি করতে দেখা যাচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশের অনেক চ্যানেলের কারণে দেশের অসংখ্য পরিবার প্রতিদিন পারিবারিক সম্প্রীতি নষ্ট করে খান খান হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খবর নিয়ে জানা যায়, প্রতিটি সিটি শহর ও উপজেলা সদরে পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনে কলহ সৃষ্টি হয়ে শত শত পরিবার বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। সমাজ বিশ্লেষক অনেকেই এ জন্য পার্শ্ববর্তী আকাশ সংস্কৃতিকে দায়ী করেছে। আজ থেকে মাত্র এক যুগ আগেও এ সমাজে পারিবারিক, সামাজিক সম্প্রীতি ছিল। পরিবারের ছোট-বড় ছেলে-সন্তান বউ, শাশুড়ি, ননদের মধ্যে গভীর ভালোবাসা পূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। আজকের সমাজে ও পরিবারে সে ধরনের সম্প্রীতি পারিবারিক ভালোবাসা স্বামী-স্ত্রী থেকে পরিবারের সবার মধ্য প্রায় অনুপস্থিত। এসব চ্যানেলের মাধ্যমে পারিবারিক অশান্তি ও শান্তি শৃঙ্খলা ভঙ্গ হচ্ছে। এসব চ্যানেলের ক্ষতিকর বিষয় বহু লেখক গবেষক লেখালেখির মাধ্যমে সমাজ পরিচালকদের কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করেছে। প্রকৃতপক্ষে যারা সমাজের পরিচালক তাদের পক্ষ থেকে এসব বিষয় গুরুত্বসহকারে প্রতিকারের মুখ দেখছে না। অহরহ চ্যানেলের প্রবেশ প্রতিদিন ঘটছে। এসব চ্যানেলের কী উদ্দেশ্য কী তারা সমাজের জন্য অবদান রাখছে কিছুই আমরা দেখছি না। চ্যানেলের নাটক, অনুষ্ঠানে শিক্ষামূলক জাতিগঠনে কী আছে সেখানে কোনো কুলকিনারা খুঁজে পাওয়া যায় না। অনুষ্ঠানের নামে যে সব নাটক ও সংস্কৃতি এ সব চ্যানেলে প্রচার করা হয় বাস্তবে সেখান থেকে পরিবার, সমাজ শেখার কী আছে সেখানেও অনেক প্রশ্ন। একটা অনুষ্ঠান একটা নাটক কী উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি হয়, নাটকের পরিচালকের সে সব গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার। দেখা যায় নাটক ও বড় বড় এক দুই ঘণ্টার চিত্র অনুষ্ঠানে মারামারি, সন্ত্রাস, হাইজ্যাক, অপহরণ কীভাবে করতে হবে সে ধরনের চরিত্র দেখানো হয়। এসব অনুষ্ঠানের কী উপকারিতা আমরা বুঝে নিতে পারছি না। কিন্তু খারাপ প্রতিক্রিয়া সেটা সমাজে দেখা যায়। একটা নাটক ও টিভি চ্যানেল থেকে অনুষ্ঠান দেখার পর সেটা প্র্যাকটিস করে অনেক কিশোর-কিশোরী। তারা বোঝে না আসলে ওইসব অনুষ্ঠানে চরিত্রগুলো সাজানো। বাস্তবে এগুলো সমাজের জন্য বাস্তবায়নযোগ্য চরিত্র নয়। প্রশ্ন হলো বিনোদনের নামে এসব ক্রাইম অনুষ্ঠানে টিভি চ্যানেলে প্রচার করে কী শেখাতে চায় প্রযোজক পরিচালকরা। তথ্য ও সংস্কৃৃতি মন্ত্রণালয় যারা এ সব অনুষ্ঠান অনুমোদন দেয় তারা কী উদ্দেশ্যে ছাড়পত্র দেয় সেটাও আমাদের বুঝে আসে না। যুবসমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র ও দেশের উন্নয়নে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান নিশ্চয় করা যায়। কেন সে ধরনের অনুষ্ঠান তৈরি করে প্রচার হয় না, এ সব বিষয় আমাদের মতো লেখকদের অজানা থেকে যায়। বাস্তবে বাংলাদেশের ধর্ম, কৃষ্টি, কালচার ও মানুষের সভ্যতার সঙ্গে মিল রেখে বই, নাটক, সংস্কৃতি গড়ে তোলা চাই। বাস্তবে কী আমাদের সংস্কৃতি পরিচয় এ সব অনেক কিছু প্রজন্ম বুঝে উঠতে পারছে না। যার ফলে বিদেশি সংস্কৃতি আর অনুষ্ঠান, নাটক দেখে সে দেশের ভক্ত অনুসারী হয়ে পড়ছে। আমার দেশের কৃষ্টি-কালচার অনুষ্ঠান কী হওয়া উচিত, কী হওয়া উচিত না, সে সব প্রজন্মের সন্তানরা ধরে নিতে পারছে না। কোনদিন কোন মাসে কখন কী অনুষ্ঠান আমাদের হবে সে সব কোনো বাচ-বিচার আজকের সমাজে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বিয়েশাদি থেকে সব সামাজিক অনুষ্ঠানে এখন সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি ভিনদেশী কালচার প্রবেশ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সঙ্গে আকাশ সংস্কৃতির পরিধি, অপতৎপরতা নিত্যদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব লক্ষণ ধর্মানুরাগী, শান্ত, শৃঙ্খলাপূর্ণ জাতির জন্য কখনো মঙ্গলজনক নয়। যে কোনো মূল্যে আকাশ সংস্কৃতি ও টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান, প্যাকেজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অনুমোদন আদান-প্রদানে অনুষ্ঠানের ভালোমন্দের দিক গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। যে সে ধরনের অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে সমাজকে নষ্ট করার কোনো অধিকার জনগণ কাউকে দেয়নি।