রিজিয়া রহমানের বিদায়

তার অনন্য সৃষ্টি অমূল্য সম্পদ

প্রকাশ | ১৮ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান পরপারে চলে গেছেন। রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত শুক্রবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে তার মৃতু্য হয়। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। নারী লেখক, এই বিবেচনায় তাকে কখনো মূল্যায়ন করা হয়নি। নীরবে নিরন্তর কাজ করে বাংলা কথাসাহিত্যে তার অবস্থান শক্ত করেছেন। একজন লেখক হিসেবে তোষামোদি তিনি একদম পছন্দ করতেন না। কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তিও করেননি তিনি। কলমের শক্তিই ছিল তার প্রধান শক্তি। তার গদ্যশৈলী ও বিষয়ের গভীরতা এবং তা বিশ্লেষণের ক্ষমতা ছিল অনন্যসাধারণ। তার ভাষার গতিশীলতা পাঠককে আকর্ষণ ও আবিষ্ট করে সহজেই। পাঠককে নিয়ে যায় ভিন্ন এক জগতে। তার লেখালেখির শুরু কবিতা দিয়ে। তারপর গল্প-উপন্যাস লেখা শুরু করেন। তার 'নির্জন প্রহরে' গল্পটি আজও পাঠক হৃদয়ে দাগ কেটে আছে। একইভাবে তার উপন্যাস 'রক্তের অক্ষর' ও 'বং থেকে বাংলা'। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী একজন নারীর অন্ধকার অসহায় জীবন নিয়ে লেখা 'রক্তের অক্ষর' উপন্যাস। এই উপন্যাসের বর্ণনাভঙ্গি অসাধারণ ও হৃদয়গ্রাহী। তার 'বং থেকে বাংলা' উপন্যাস বাঙালির ইতিহাসের ধারাক্রম অতি সুনিপুণভাবে ফুটে উঠেছে। তার 'উত্তর পুরুষ' উপন্যাসে তিনি চট্টগ্রামে হার্মাদ জলদসু্যদের অত্যাচার ও পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের দখলদারির চিত্র তুলে ধরেন। এতে চিত্রিত হয়েছে আরাকান-রাজ-সন্দ-সুধর্মার অত্যাচার, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্ব, পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের গোয়া, হুগলি, চট্টগ্রাম দখলের ইতিহাস। তার অন্যান্য গ্রন্থ হচ্ছে- অগ্নিস্বাক্ষরা, ঘর ভাঙা ঘর, অরণ্যের কাছে, শিলায় শিলায় আগুন, অলিখিত উপাখ্যান, ধবল জোৎস্না, সূর্য সবুজ রক্ত, একাল চিরকাল, হে মানব-মানবী, হারুন ফেরেনি, উৎসে ফেরা। রিজিয়া রহমান 'অভিবাসী আমি' ও 'নদী নিরবধি' নামে দুটি আত্মজীবনী লিখেছেন। ১৯৩৯ সালে কলকাতার ভবানীপুরে রিজিয়া রহমানের জন্ম। দেশে রিজিয়া রহমানের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ফরিদপুরে। সেই সময় শখের বশে কবিতা লিখতেন। দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে তিনি এপার বাংলায় চলে আসেন। ১৯৫০ সালে তিনি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন, তখন তার লেখা গল্প 'টারজান' সত্যযুগ পত্রিকায় ছোটদের পাতায় ছাপা হয়। ১৯৫২ সালে বাবার মৃতু্যর পর তারা ঢাকার শাইনপুকুরে নানাবাড়িতে চলে আসেন। শৈশব থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় রিজিয়া রহমানের কবিতা ও গল্প ছাপা হলেও তার প্রথম গল্পগ্রন্থ 'অগ্নিস্বাক্ষরা' ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি ইডেন মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৫ সালে এই কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রিজিয়া রহমান সাহিত্য পত্রিকা ত্রিভুজের সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি বাংলা একাডেমি ও জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ষাটের দশক থেকে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্যসহ সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার মূল পরিচিতি ঔপন্যাসিক হিসেবে। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান রিজিয়া রহমান। আর সরকার চলতি বছর তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। পারিবারিক জীবনে রিজিয়া রহমান মো. মীজানুর রহমানের সহধর্মিণী। মীজানুর রহমান ছিলেন একজন খনিজ ভূ-তত্ত্ববিদ। রিজিয়া রহমানের একমাত্র ছেলে আবদুর রহমান। তার মৃতু্যর মধ্যদিয়ে বাংলাসাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তিনি দূর আকাশে মিলিয়ে গেছেন কিন্তু রেখে গেছেন তার অনন্য সৃষ্টি, যা বাংলাসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারকে জানাই গভীর সমবেদনা।