উৎপাদনশীলতা ও নারীর শ্রম

শ্রম অংশীদারিত্ব এবং উদ্যোক্তা হিসেবে নারীকে সত্যিকারভাবে সমান অবস্থানে নিয়ে আসতে পারলে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে লাভবান হবে।

প্রকাশ | ২০ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

নাসরীন মুস্তাফা
কর্মজীবী নারীর কর্মস্থলের অভিজ্ঞতা কী রকম? যৌন হয়রানির বিষয়টি বাদ দিলেও সব কর্মজীবী নারী মোটামুটিভাবে একটি বিষয় অনুভব করেন, তিনি কেবল নারী হিসেবেও কর্মস্থলে বিবেচ্য হন কখনো কখনো। পুরুষ সহকর্মীর হাঁড়ির খবর নিয়ে কারোর মাথাব্যথা না থাকলেও কর্মজীবী নারীর সংসার আছে কি নেই, সন্তান আছে কি নেই এসব বিষয়ে কৌতূহল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব পর্যায়ের সহকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করে। কর্মজীবী নারী কর্মস্থলের ব্যবসায়িক হিসেবে কতটা আদরণীয়, সে বিষয়েও সামাজিক মিথ বিদ্যমান। নব্য সিভিল প্রকৌশলী সিনথিয়া, বুয়েট থেকে পাস করে চাকরি খুঁজছেন। কেবলমাত্র নারী বলে বাদ পড়েছেন চূড়ান্ত তালিকা থেকে, এমনও হয়েছে। নিয়োগদাতা কর্তৃপক্ষ চোখেমুখে উদাসভাব এনে শুনিয়েছে, আমরা আসলে একজন ছেলেকে খুঁজছি। সিনথিয়া শক্তমুখে জবাব দিয়েছিল, বিজ্ঞাপনে বললেই হতো, নারী সিভিল প্রকৌশলীর আবেদনের দরকার নেই। তাহলে তো কেবল ছেলেরাই আসতো, আমরা এ মুখো হতাম না। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তখন চোখমুখে আরও উদাসী ভাব এনে শুনিয়েছে, মেয়েদের নিলে নানা হ্যাপা। দুদিন পরে বিয়ে করবেন, বাচ্চা-কাচ্চা হবে, তাদের জ্বর হবে, পেট খারাপ করবে, একটু বড় হলে ইস্কুল-ফিস্কুল...মেয়েরা কি অফিসের কাজ ঠিকমতো করে? কেবল বাসার চিন্তা! মেয়েদের প্রোডাকটিভিটি কম তো এই সব কারণেই। সালমা আপাকে দেখেছি, সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অফিসে থাকার কথা, তিনি ঠিক সেই সময়টাতেই থাকেন। কারোর সঙ্গে অহেতুক কোনো কথা নেই, অফিস তার উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে, তা সুচারুভাবে সম্পন্ন করেন। ৫টার পর তিনি বেরিয়ে আসেন অফিস থেকে। পুরো সময়টা এত সুন্দরভাবে কাজ করার পরও তাকে শুনতে হয়, অফিসের পরে কেন কাজ করেন না? আমার কাজ বাকি না থাকলে কি করব? সহানুভূতির সুরে এমন কথাও ছুটে এসেছে, সময়ের মধ্যে সব কাজ সেরে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বসকে দেখাতে হয়, অফিসের পরেও তুমি আছ। তাই ধীরে-সুস্থে কাজ করাই ভালো। ৫টার ভেতর শেষ না হলেই ভালো। নির্ধারিত সময়ের ভেতর কাজ শেষ করতে না পারাটা অযোগ্যতা, এই যুক্তি দেখিয়ে সালমা আপার প্রোডাকটিভিটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। অথচ ফাইল আটকে রাখার কুখ্যাতি অর্জন করা সালমা আপার পুরুষ সহকর্মী অফিস ছুটির পরে, ছুটির দিনেও অফিস করেন বলে প্রোডাকটিভিটির প্রশ্নে দিব্যি উতরে যান। সালমা আপা এবং তার মতো কর্মজীবী নারীরা এই 'অক্ষমতা' মেনে নিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দেন এই ভেবে যে, অফিসের পরে তো সংসার নামক আরেকটা চাকরি সামলাতে হয়। আসলেই তাই। অফিসের পরে সংসার নামক আরেকটা চাকরি পুরুষ সহকর্মীকে মোটেও সামলাতে হয় না। রূপা এবং ওর স্বামী দুজনেই কর্মজীবী, একই অফিসে কাজ করছেন। ছুটির পরে রূপা বাড়িতে এসে রান্নাঘরে ঢোকেন। রূপার স্বামী সন্ধ্যে বাড়ি ফেরার আলসেমি কাটাতে ঘণ্টাখানেক আড্ডা মারলেও অফিসে গুরুদায়িত্ব পাওয়ার সময় রূপার চেয়ে দৌড়ে এগিয়ে থাকে তার স্বামী। বছর শেষে সালমা আপার প্রাপ্য প্রমোশনটা যে কারণে পেয়ে যায় সালমা আপার সেই পুরুষ সহকর্মী, যিনি ফাইল আটকে রাখলেও অফিস ছুটির পরে, ছুটির দিনেও অফিস করেন। কর্মজীবী নারীর প্রোডাকটিভিটি নিয়ে সামাজিক ইমেজ এরকমই। কেবল আমাদের দেশে নয়, গড়পড়তা বিশ্বের প্রায় সব দেশেই নারী প্রোডাকটিভিটির দাড়িপালস্নায় সমান ওজনে যাচাইকৃত হন না। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সেখানে তিনটি তথ্য সুস্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে। এক. মেয়েরা অফিসে পুরুষ সহকর্মীর তুলনায় শতকরা ১০ ভাগ বেশি কাজ করেন। দুই. অফিসে লিঙ্গ বৈষম্য এখনো বিদ্যমান। তিন. আমাদের কিছু স্বভাব আছে যার পরিবর্তন প্রয়োজন। বিশ্বব্যাপী নারী মজুরি বৈষম্যের শিকার। এখনো পুরুষের তুলনায় গড়ে শতকরা ৮১.৮ ভাগ মজুরি পান নারী শ্রম বিক্রি করে। হাইভ (ঐরাব) নামে একটি উৎপাদনমুখী পস্নাটফর্ম বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলোর কাজের জায়গাগুলোতে উঁকি দিয়ে জেনেছে, মাটি কাটার মতো কাজে যেমন মজুরি বৈষম্য আছে, উন্নতমানের চাকরিতেও নারীবৈষম্যের শিকার। অফিস নির্ধারিত ৬৬ ভাগ কাজের পুরোটা নারী এবং পুরুষ উভয়েই শেষ করার পরও নারীকর্মীকে অফিস ১০ ভাগ বেশি কাজ চাপিয়ে দেয় এবং নারী সেই কাজ সম্পন্ন করেন। প্রমোশনে সাহায্য করবে না, এমন কাজ নারীর উপরই চাপানো হয়, কেননা তারা তা করেন। অফিস সেই সব কাজ নারীকে দিয়ে করিয়ে নিজের লাভ বাগিয়ে নেয় এবং জানে, নারী এসব কাজ করবে। প্রমোশনে সাহায্য করবে না, এমন কাজ পুরুষকে দিয়ে করানো কঠিন। যদিও অফিসে বসদের ভাব দেখলে মনে হয়, নারীকর্মীকে দয়া করে রাখা হয়েছে, কেননা নারীরা অফিসে কাজ যতটা না করেন, তার চেয়ে গল্প করেন বেশি, হ্যানো-ত্যানো। নারী গল্প করেন বেশি, কথাটা কি সত্য? ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রতি গবেষণার তথ্যটি হচ্ছে, অফিসে গল্প করে কাজের ক্ষতি হচ্ছে গড়ে ২৫ মিনিট। আরেকটা গবেষণা বলছে, গল্পের কারণে অফিসে প্রোডাকটিভিটি কমে যায় শতকরা ২০ ভাগ এবং পুরুষের তুলনায় নারী ২০ ভাগ বেশি গল্প করেন অফিসে, মোবাইলে টেক্সট ম্যাসেজ করেন ২০ ভাগ বেশি। এরপরও পুরুষের চেয়ে নারী ১০ ভাগ কাজ বেশি করছেন! এর মানে কি? পরিষ্কারভাবে বলা যায়, ওইসব গল্পগুজবে আদতে কোনো ক্ষতি হয় না অফিসের, বরং আন্তর্ব্যক্তিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। নারীর গল্প করার ধরন একজন একজন ভিত্তিতে। পুরুষ গ্রম্নপ চ্যাটে অভ্যস্ত এবং তারা এসবে নারীকে আমন্ত্রণ জানাতে খুব একটা আগ্রহী নন। ছুটির দিনে বা অফিস ছুটির পরও অফিসে কাজ বেশি করেন পুরুষরা। এতেও লাভ কি হয়? সব মিলিয়ে তো নারীরাই এগিয়ে আছেন প্রোডাকটিভিটিতে। এর অর্থও পরিষ্কার। কাজের দিনগুলোতে কাজ করলেই বেশি কাজ করা যায়, ছুটির দিনে বা অফিস ছুটির পরও কাজ করে আসলে কোনো লাভ নেই। বাংলাদেশের কাজের জায়গাগুলোতে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম সম্প্রতি জানিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ নারী-পুরুষের সমতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সেরা দেশ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি এবং রাজনীতি- এই চারটি ক্ষেত্রে গেস্নাবাল জেন্ডার গ্যাপর্ যাঙ্কিং ২০১৭-তে ২৫ ধাপ এগিয়ে জেন্ডার সমতার দেশ হিসেবে বিশ্বে ৪৭তম জায়গা অর্জন করতে পেরেছে বাংলাদেশ। শতকরা ৭২ ভাগ জেন্ডার বৈষম্য নিরসন করার পুরস্কার এটি। ফলে চতুর্থবারের মতো এইর্ যাঙ্কিংয়ে থাকতে পেরেছে বাংলাদেশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের অর্জন ০.৭১৯ পয়েন্ট, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সেরা আর এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সেরা। এশিয়ার দেশ ফিলিপাইন আছে বাংলাদেশের আগে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের পরে আছে ভারত, যার বৈশ্বিক অবস্থান ১০৮তম। ১০৯তম হয়েছে শ্রীলংকা, নেপাল ১১১তম, ভুটান ১২৪তম এবং পাকিস্তান ১৪৩তম। লিঙ্গ সমতায় সেরা দেশ আইসল্যান্ড, এরপর নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নিকারাগুয়া, রুয়ান্ডা, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন, আয়ারল্যান্ড এবং নামিবিয়া। আত্মতৃপ্তির সময় এখনো আসেনি। প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অর্জন বিস্ময়কর কিন্তু শ্রম অংশীদারিত্বে এখনো পিছিয়ে আছে দেশটা। শ্রমের অংশীদারিত্বে নারীরাও এখনো সমান সুযোগ পাচ্ছেন না। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারার মূল রহস্য নারীর অংশগ্রহণ, অবশ্যই। দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী কোনো না কোনোভাবে শ্রম দিচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া তথ্য মতে, নারী ১০ ভাগ বেশি প্রোডাকটিভিটি উপহার দিচ্ছেন এ দেশেও। আর ফলাফল হিসেবে মিলছে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, যাকে বিশ্ব বলছে এক বিস্ময়কর অগ্রগতি। শ্রম অংশীদারিত্ব এবং উদ্যোক্তা হিসেবে নারীকে সত্যিকারভাবে সমান অবস্থানে নিয়ে আসতে পারলে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে লাভবান হবে। মার্কেট সিস্টেমে নারীর ভূমিকা কী হবে, এ নিয়ে বাংলাদেশকে আরও আধুনিকভাবে ভাবতে হবে। নারীর জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্ষেত্র নির্ধারণ করে দেয়ার প্রথাগত অভ্যাসের পরিবর্তন প্রয়োজন। এর সঙ্গে পরিবর্তন ঘটাতে হবে ব্যাংক লোন ও অন্যান্য আর্থিক প্রণোদনা সুবিধারও। বাংলাদেশ সরকার সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (২০১৬-২০২০) মাধ্যমে লিঙ্গ-দর্শন নির্ধারণ করেছে, যেখানে নারী এবং পুরুষের শ্রম বাজারে ঢোকার সমান সুযোগ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। নারীর অধিকারকে চিহ্নিত করা হয়েছে নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক আর রাজনৈতিক উন্নয়নে অংশীদারের অধিকার হিসেবে। ফলে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও নারী ক্ষমতায়নের অসংখ্য সফল গল্পও জমা হচ্ছে ঝুলিতে। তৃণমূল পর্যায়েই ঘটছে বেশির ভাগ ঘটনা, ফলে পাদপ্রদীপের আলোয় আসছে কম। সত্যটা এরকমই-নারীর শ্রম বেশি প্রোডাকটিভ, সে শ্রম নারী ঘরেই দিন আর কর্মক্ষেত্রে। বাংলাদেশ তার বড় প্রমাণ। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কিছু জানতে চাইলে গুগল দেখবেন বাংলাদেশ নামটা কীভাবে এগিয়ে দেয়! নাসরীন মুস্তাফা: নাট্যকার ও কলাম লেখক।