কাশ্মীর দ্বিতীয় প্যালেস্টাইনে পরিণত হতে যাচ্ছে

ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে কাশ্মীরকে যে স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের মর্যাদা দেয়া হয়েছিল সেটি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। একই সঙ্গে কাশ্মীর থেকে ভেঙে লাদাখকে আলাদা করার ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে 'বিশেষ মর্যাদা' হারালো জম্মু-কাশ্মীর। উপত্যকায় রইল না আলাদা সংবিধান, আলাদা পতাকা। বদলে গেল ৬৯ বছরের ইতিহাস। ইতিমধ্যে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় এসংক্রান্ত বিলও উত্থাপন করা হয়েছে।

প্রকাশ | ২২ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
এক কাশ্মীরকে তিনভাগ করে এক মহাগোল বাধিয়ে রেখে গেছে মহান ব্রিটিশরা। সেই গোলের শোরগোলে ভূস্বর্গ নির্ভেজাল নরক আজ। আর সেই নরককে পাকাপোক্ত রূপ দিতে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি প্রস্তুতি নিচ্ছিল বহুবছর আগে থেকেই। কাশ্মীরে স্বায়ত্তশাসন বাতিলের দাবিটা সম্ভবত প্রথম তুলেছিলেন, ভারতীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ। এই জনসংঘই বিজেপির পিতৃসংগঠন। ২০১৯ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বিজেপি বলেছিল, দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলেই বাতিল করা হবে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ ও ৩৫-এ ধারা। কথা রেখেছে বিজেপি। পথের কাঁটা সরিয়েছে ক্ষমতায় বসেই। যার মূল কলকাঠি নেড়েছেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। যার মাথা থেকেই এসেছে আসামের নাগরিকপঞ্জি করার বুদ্ধি। যে নাগরিক তালিকার জোরে আসামের লাখো বাসিন্দাকে নিমিষেই অনুপ্রবেশকারী বলে তাড়িয়ে দেয়া যাবে। এই ৩৭০ অনুচ্ছেদের সুবাদে কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারাই শুধু সেখানে বৈধভাবে জমি কিনতে পারতেন, সরকারি চাকরি করার সুযোগ পেতেন এবং সেখানে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন। ওই অনুচ্ছেদ বিলোপ করার বিষয়টি বিজেপির পুরনো রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলোর একটি। এই সিদ্ধান্তের ফলে সেখানে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখন জম্মু এবং কাশ্মীর 'ইউনিয়ন টেরিটরি' বা কেন্দ্রীয়ভাবে শাসিত রাজ্য হিসেবে পরিচালিত হবে। লাদাখ কেন্দ্রশাসিত তৃতীয় একটি এলাকা হিসেবে বিবেচিত হবে। ৩৭০ অনুচ্ছেদ ও ৩৫-এ ধারা বাতিল হওয়ায় এখন আর কাশ্মীর ভারতের বিশেষ রাজ্য নয়। ফলে দিলিস্ন, গোয়ার মতো দেশের বাকি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোর সঙ্গে আর কোনো পার্থক্য থাকছে না জম্মু ও কাশ্মীরের। আগে কাশ্মীরীদের ছিল দ্বৈত নাগরিকত্ব। মানে তারা বিশেষ সংবিধানের কারণে একই সঙ্গে কাশ্মীর ও ভারতের নাগরিকত্বের সুবিধা ভোগ করত। সেই সুবিধা আর থাকছে না, তারা এখন কেবল ভারতের নাগরিক। আলাদা পতাকার যে গৌরব ছিল রাজ্যটির, সেটিও আর থাকছে না। কাশ্মীরের আকাশে এখন থেকে কেবল দোল খাবে ভারতের তিনরঙা পতাকা। এছাড়া ভারতীয় সংবিধানের ৩৬০ ধারার জোরে যে কোনো রাজ্যে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারি করা গেলেও কাশ্মীর ছিল এর আওতামুক্ত। তবে এখন এই ধারার আওতায় খুব সহজেই কাশ্মীরেও অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা কার্যকর করতে পারবে মোদি সরকার। অন্য রাজ্যের বাসিন্দারাও অনায়াসেই কাশ্মীরে জমি কেনার সুবিধা পাবেন, কাশ্মীরীদের সঙ্গে পালস্না দিয়ে করতে পারবেন সরকারি চাকরির আবেদন। এছাড়া আগে কাশ্মীরে সংখ্যালঘু আইন কার্যকর ছিল না ভারতের অন্য রাজ্যগুলোর মতো। এখন থেকে রাজ্যটিতে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু সংরক্ষণ আইনও কার্যকর হবে। যার ফলে বিশেষ সুবিধা পাবে কাশ্মীরের সংখ্যালঘু হিন্দুরা। পাশাপাশি কমবে কাশ্মীর বিধানসভার মেয়াদ। আগে বিশেষ ক্ষমতাবলে কাশ্মীর বিধানসভার মেয়াদ ছিল ছয় বছর, এখন তা অন্য রাজ্যগুলোর মতো নেমে আসবে পাঁচে। যদিও বিগত ৭১ বছর ধরে তাদের সে দাবিকে পাত্তা না দিয়ে দমিয়ে রাখা হয়েছে; কিন্তু দেখেশুনে বা কথা বলে যা বোঝা গেল তা হলো- বংশপরম্পরায় কাশ্মীরীরা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি থেকে সরে আসবেন না। আর এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানও তাদের মদদ দিতেই থাকবে। কারণ এ ছাড়া পাকিস্তানেরও গতি নেই। কাশ্মীরীদের সাহায্য, সহযোগিতা, সমর্থন না দিয়ে পাকিস্তানে কোনো সরকারই টিকে থাকতে পারবে না। কারণ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সে ক্ষেত্রে সরকারকে চাপ সৃষ্টি করবে। তাই কাশ্মীর ইসু্য পাকিস্তানের জন্যও একটি প্রেস্টিজ ইসু্য। স্বাধীনতার পর ভারতের প্রথম সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী নেহরু যে কথাটি পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে রেখেছিলেন এবং রেডিও ভাষণেও তিনি যা বলেছিলেন, সে কথা এখন বাস্তবায়নের সুযোগ আছে বলেও মনে হয় না। কারণ বহু আগেই ভারত সেখান থেকে সরে এসে স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরীদের বিরুদ্ধে দমননীতির মাধ্যমে কাশ্মীর শাসন করে চলেছে। আর ভারত এখন বিরাট সামরিক শক্তির অধিকারী। তাই কাশ্মীর সমস্যার সমাধান কোন পথে হবে, কোন সময়ে হবে এখনই তা বলা যাচ্ছে না। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে কাশ্মীরকে যে স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের মর্যাদা দেয়া হয়েছিল সেটি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। একই সঙ্গে কাশ্মীর থেকে ভেঙে লাদাখকে আলাদা করার ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে 'বিশেষ মর্যাদা' হারালো জম্মু-কাশ্মীর। উপত্যকায় রইল না আলাদা সংবিধান, আলাদা পতাকা। বদলে গেল ৬৯ বছরের ইতিহাস। ইতিমধ্যে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় এসংক্রান্ত বিলও উত্থাপন করা হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের আলাদা যে অধিকার ছিল দিলিস্ন সরকার তা আগে থেকেই মানছিল না। সংবিধানের ৩৭০ ধারায় রাজ্যটিকে স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের মর্যাদা দেয়া হলেও কেন্দ্র শুরু থেকেই সেখানে হস্তক্ষেপ করছিল। এই ধারা বাতিল করে দুটি আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করায় অবস্থার আসলে কোনো পরিবর্তন হলো না। জম্মু-কাশ্মীরে হস্তক্ষেপের আগে সাংবিধানিক যে বাধা ছিল ৩৭০ ধারা বাতিল করায় এখন সেই বাধা আর রইল না। জম্মু-কাশ্মীরে যারা স্বাধীনতাকামী, ভারত যাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বলছে রাজ্যটির বিশেষ মর্যাদা হরণ করায় তাদের লড়াইটা আরও জোরালো হলো। কারণ তারা নিশ্চিত হলো, তাদের এতদিনের যে লড়াই সেটি ঠিক ছিল। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে তাদের এই লড়াইকে নতুন করে উস্কে দিল সরকার। কয়েক দিন আগে কাশ্মীর ছাড়তে বলা হয়েছে অমরনাথ তীর্থযাত্রী ও পর্যটকদের। আগের অতিরিক্ত ১০ হাজার সেনার সঙ্গে আরও অতিরিক্ত ২৫ হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে, বিজেপি সরকার সামরিক চুক্তির মাধ্যমে সমাধান চাচ্ছে। ভারতে কাশ্মীরী জনগণের যে একটা বিশেষ মর্যাদা ছিল সেটা তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। ভারতের সঙ্গে যে সম্পর্কের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা ভেঙে গেছে। এখন মনে হচ্ছে এটা একটা 'ভগ্ন প্রতিশ্রম্নতির গল্প'। এটা কোনোভাবেই আমাদের সাহায্য করবে না। যেটাকে সংস্কার বলা হচ্ছে সেটার মানে কি বড় কোম্পানিগুলো সেখানে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে? কাশ্মীরী জনগণ মনে করে তাদের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। ভারত সরকার সব কিছু বন্ধ করে দিয়েছে কারণ তারা জানত কাশ্মীরীরা এটা মেনে নেবে না। এই ধরনের নিষ্ঠুরতা দিন দিন বাড়ছে। কাশ্মীরীরা সবসময় মেনে এসেছে যে কাশ্মীর একটা বিতর্কিত ইসু্য। কাশ্মীরী জনগণ মনে করে তারা কখনো ভারতের অংশ ছিল না। সেখানে নিজস্ব আইন ছিল যেটা তাদের অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে। তাদের ভারতের অংশ করা হয়েছিল কিছু নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে। সেটা এখন বিজেপি সরকার শেষ করে দিয়েছে। গত কয়েকদিনে অমরনাথ যাত্রী ও পর্যটকদের এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ায় তাদের অর্থনীতির প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। মোদি সরকার যদি কাশ্মীরীদের ভালো চাইত, তাহলে বছরের যে সময়ে সেখানে সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসে, এসময় এরকম ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করত না। ভবিষ্যতে সহিংসতা আরও বাড়বে, কেউ কাশ্মীরে আসবে না। সেটা কি কাশ্মীর অর্থনীতির জন্য ভালো হবে? ইসরাইল প্যালেস্টাইনের সঙ্গে যা করছে, ভারতের সরকারও কাশ্মীরের সঙ্গে সেটাই করতে চায়। তারা একই প্যাটার্ন অনুসরণ করছে। ভারতশাসিত কাশ্মীরে ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত একাধিক সামরিক ঘাঁটির ওপর হামলা হয়েছে। সবশেষ পুলওয়ামায় গত সপ্তাহে এক জঙ্গি আক্রমণে ৪০ জনেরও বেশি আধাসামরিক পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে আবারও তৈরি হয়েছে তীব্র উত্তেজনা। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, ভারত যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেয়- তাহলে পাকিস্তানও পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। হুমকি পাল্টা হুমকিতে এ অঞ্চলের জনগণের স্বস্তি ও শান্তি বিঘ্নিত হবে। যেভাবে ইসরাইলি আগ্রাসন প্যালেস্টাইনে জনগণকে বিধ্বস্ত করছে ভারত ও পাকিস্তানের এহেন যুদ্ধের হুংকার উস্কানিমূলক কর্মকান্ড তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রমে অনুপ্রাণিত করছে। এ যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো অবস্থা তৈরি হতে যাচ্ছে। এবং প্রকারান্তরে মধ্যপ্রাচ্যে প্যালেস্টাইন যে পরিণতির শিকার কাশ্মীরবাসীকে একই পরিণতির মুখোমুখি হওয়ার অশনি সংকেত পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি পারমাণবিক যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার অবস্থাকেও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। এই বাস্তবতার উপলব্ধিতে যদি চির ধরে তাহলে পাকিস্তানের পরিণতি যাই হোক কাশ্মীর হবে দ্বিতীয় প্যালেস্টাইন। তবে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পাকিস্তানকে মোদির নেতৃত্বে পরিচালিত শক্তিশালী ভারতে মোকাবিলা করা নেহাতই বোকামি। কাশ্মীর ইসু্যতে আন্তর্জাতিক বিশ্বে একমাত্র চীন ছাড়া পাকিস্তানের পক্ষে কোনো দেশের সমর্থন নেই। পাকিস্তান নামক দেশটির প্রধান ইমরান খান তাহলেই কি শুধুই রাজনৈতিক ফায়দা নিয়ে তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই এ ধরনের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মেতেছেন। অন্যদিকে ভারত সামরিক শক্তির বিচারে পাকিস্তানের থেকে অনেকখানি এগিয়ে আছে। হিন্দুত্ববাদের ঐক্যের জোয়ারে শেষমেশ ইমরান খান ভেসে যাবে কিনা তা সময়ই বলবে। ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ: লেখক, গবেষক ও কলামিস্ট ভড়ৎয়ধহ.রহভড়@মসধরষ.পড়স