বস্তি উচ্ছেদে আগুন থেরাপি: লাভবান হয় কারা?

প্রকাশ | ২৫ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

মোহাম্মদ অংকন ঢাকা
রাজধানী ঢাকা বৈচিত্র্যময় শহর। এখানে যেমন ধনীরা অট্টালিকায় বসবাস করেন, তেমনি বসবাস করেন অতি দরিদ্রগোছের মানুষ। সাধ-আহ্লাদ থেকে এ শ্রেণির মানুষ ধনীদের সঙ্গে বসবাস করে না। বরং প্রতিদিন তাদের সংগ্রাম করতে হয় কষ্টের সঙ্গে। প্রতিবছর নদীভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা এলাকায় কাজের অভাবের কারণে ঢাকা শহরে এসে বসবাস করছেন। গড়ে তুলছেন বস্তি এলাকা। বর্তমানে ঢাকায় বস্তি ও বস্তিবাসীর সংখ্যা মোটেও কম নয়। ২০১৪ সালের আগে ১৯৯৭ সালে বস্তিশুমারি করা হয়। সে সময়ে বস্তিবাসীর সংখ্যা ছিল ৭ লাখ। পরের ১৭ বছরে বস্তিবাসীর সংখ্যা বাড়ে ৩ গুণ। বিবিসি থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে সর্বশেষ ২০১৪ সালে বস্তিশুমারি করেছিল পরিসংখ্যান বু্যরো। এরপর সে নিয়ে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তখন ঢাকা শহরের দুই সিটি করপোরেশনে মোট ৩ হাজার ৩৯৪টি বস্তি ছিল। মোট ঘরের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজারের মতো। সর্বশেষ শুমারির পর ৫ বছর পেরিয়ে গেছে। এ সময়ে বস্তিবাসীর সংখ্যা কতটা বেড়েছে বা কমেছে তা নিয়ে কোনো পরিসংখ্যান নেই। এ তো শুধু রাজধানী ঢাকার পরিস্থিতি। সমগ্র দেশে কতগুলো বস্তি, কতজন বস্তিবাসী রয়েছে? ২০১৫ সালের বস্তিশুমারি অনুযায়ী দেশে বস্তিবাসীর সংখ্যা সাড়ে ২২ লাখ। এদের অর্ধেকের বেশি বাস করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাঁচ হাজারের বেশি বস্তিতে। সরকারি জমিতে এসব বস্তি গড়ে উঠলেও সেখানকার ঘরের মালিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। সরকার বদলায়, বস্তির মালিকানাও বদলায়। স্বাস্থ্যসেবা, বিদু্যৎ, গ্যাস, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন কিংবা শিক্ষার নূ্যনতম সুবিধা না থাকলেও বস্তির বাসিন্দাদের প্রতি মাসেই গুনতে হয় নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাড়া। মাথা গোঁজার যেটুকু জায়গা এবং অপ্রতুল যে নাগরিক সুবিধা পায়, তার বিনিময়ে তাদের যে টাকা গুনতে হয়, ঢাকার অনেক বাসিন্দার তুলনায় তা বেশি। এটা এক প্রকার চাঁদাবাজি। এটাও বলা যেতে পারে, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। কোথায় একটু আশ্রয় নিয়ে জীবিকার তাগিদে ছুটে ফিরবে, ভাগোন্নয়ন করে গ্রামে ফিরে যাবে, সে সুযোগ নেই। মাত্রাতিরিক্ত আনুষঙ্গিক ব্যয় তাদের আরও নু্যব্জ করে তোলে। ফেরা হয় না আপন পথে। বস্তিবাসীদের নাগরিক সুবিধা ও জীবনযাপনের ব্যয়-ব্যবহার্যতার প্রসঙ্গ আপাতত বন্ধই রাখলাম। উচ্ছেদ আর আগুন বস্তিবাসীর পিছু ছাড়ছে না, এ প্রসঙ্গ নিয়ে কথা না বললে লেখক হিসেবে সামাজিক দায় থেকে যায়। ঘূর্ণিঝড়, পাহাড়ধস, নদীভাঙন, জলবায়ুজনিত উদ্বাস্তু এসব ছিন্নমূল মানুষ নগরে রিকশা, ভ্যান, সিএনজি চালিয়ে, গৃহকর্মীর কাজ করে, চায়ের টং বসিয়ে চার ফুট বাই চার ঘরে নতুন করে যে ঘরকন্যা সাজায় নিমিষেই সে স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এমন দুঃখ প্রকাশের ভাষা কারও নেই। বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনাকে তুচ্ছ ভাবারও অবকাশ নেই। সাম্প্রতিক কিছু বিভীষিকাময় অগ্নিকান্ড নতুন ভাবনার উদয় করেছে। প্রশ্ন তুলেছে, বেশ গুরুত্বর। উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। আসলেই বস্তিতে দুর্ঘটনাবসত আগুন লাগে নাকি আগুন লাগিয়ে দিতে অনুপ্রেরণা দেয়া হয়? সব কথা বলতে নেই। কাজটি যে সহজ, তা-ও অনুমেয়। বস্তির কতিপয় দু'একজনকে অনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দিলে, মোটা অঙ্কের টাকার লোভ দেখালে, এতে কাজ না হলে অস্ত্রের ভয় দেখালে, তারাই কাজটি এক নিমিষে সেরে ফেলতে পারে। এর পেছনে আরেকটি প্রশ্ন চলে আসে, বস্তিতে আগুন জ্বালালে কাদের লাভ হয়? বোঝাই যাচ্ছে, এক শ্রেণির মানুষ তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে বস্তি পুড়ে যাওয়া স্বপ্নের ছাই সরিয়ে গড়ে তুলতে পারেন অট্টালিকা, সুবিশাল শপিং মল, কারখানা। নামকরণ করতে পারেন, সিঙ্গাপুর সিটি, মালেশিয়ান সিটি ইত্যাদি। এভাবে গরিবের পেটে লাথি মেরে গড়ে ওঠা ধনিকশ্রেণির দাপটে আমরা ব্যথিত। আমাদের সামাজিক অবস্থান আজ কোথায়? শ্রেণিবৈষম্য যেন পিছু ছাড়ছে না। সর্বশেষ ১৬ আগস্ট (শুক্রবার) সন্ধ্যায় ভয়াবহ আগুনে ছাই হয়ে গেছে মিরপুরের রূপনগরের ঝিলপাড় বস্তির প্রায় আট হাজার ঘর। কি দুঃসহ দৃশ্য! সাড়ে তিন ঘণ্টায় আগুনের লেলিহান শিখা ৫০ হাজার মানুষকে আশ্রয়হীন করে দিয়েছে। (খবরটি যখন কানে এলো, আমার চোখের কোণে নিমিষেই জল চলে আসে। প্রতিদিন এ বস্তির পাশ দিয়েই পথ চলতে হয়। আগুন পোড়া গন্ধ যখন নাকে আসে, মনে হয় আমাদের বিবেক পোড়া গন্ধ এটা।) মিরপুরের ঝিলপাড় বস্তিতে ভয়াবহ আগুনের পেছনে নাশকতা থাকতে পারে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে অভিযোগ করেছেন। ঈদের ছুটিতে আগুন লাগায় তাদের এ সন্দেহ। আবার বর্ষা মৌসুমে আগুনের ঘটনা যেখানে কালেভদ্রে ঘটে সেখানে এত বড় অগ্নিকান্ড কীভাবে হলো- এ প্রশ্নও করেছেন অনেকে। এমন সন্দেহপোষণ স্বাভাবিক ব্যাপার। কেননা, এসব সন্দেহের পেছনে অবশ্যই আগের অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। ঢাকার বস্তি উচ্ছেদে আগুন থেরাপির ব্যবহার অনেক পুরনো। আগুন থেরাপির পেছনে কাদের হাত রয়েছে, বিষয়টি কেউই খতিয়ে দেখবেন না হয়তো। তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোরও কেউ নেই। বস্তি পুড়িয়ে দু'চারটে অট্টালিকা গড়ে উঠবে, উঠছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজধানীতে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক বস্তিতে আগুন লেগেছে। অনেকে এটাকে বলছে, আগুন থেরাপি; অর্থাৎ গরিব এখন ক্ষত বা রোগের মতো, সেটা সারানোয় আগুন ব্যবহার করা হচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের গরিবের সহ্য ক্ষমতা এতই বেশি যে আগুনে ছ্যাঁকা খাওয়ার পরও তারা রয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গরিব তাড়িয়ে ঢাকার সমস্যার সমাধান হবে কি? ঢাকায় এত মানুষের চাপ কমানো যাবে কি? ঢাকার পরিবেশদূষণ বন্ধ করা সম্ভব হবে কি? হবে বৈকি! চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত তিন মাসেই বিশের অধিক বস্তিতে আগুন দেয়া হয়েছে। (দেয়া হয়েছে কথাটি এ কারণেই প্রাসঙ্গিক যে আগুনগুলো আপনা-আপনি লাগছে না, এর পেছনে সিন্ডিকেট রয়েছে। দুর্ঘটনাজনিত অগ্নিকান্ড আর প্রণোদিত অগ্নিকান্ড এক নয়।) এসব ছিল পরিকল্পিত উচ্ছেদের অংশ হিসেবেই বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া। এ কথাটি বর্তমান প্রসঙ্গে তুচ্ছ করার অবকাশ নেই। বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এমনটাই ঘটে আসছে। চলতি বছরের ৯ মার্চ রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে আগুন দেয়া হয়। এর আগে ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ বস্তিটিতে আগুন দেয়া হয়। ২০১৬ সালের ৪ ডিসেম্বরে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুড়ে যায় প্রায় ৫০০-র বেশি ঘর। একই বছরের ১৪ মার্চ আগুনে পোড়ে বস্তির অর্ধশত ঘর। ওই বস্তিটির জমির মূল মালিক বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। তারা আদালতের আদেশ নিয়ে ২০১২ সালে কড়াইলে জমি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা শুরু করে। প্রথম দিনের অভিযানে ৪০০টি ঘর উচ্ছেদ করা গেলেও দ্বিতীয় দিন হাজার হাজার বস্তিবাসী গুলশান-মহাখালী এলাকার সড়কে নেমে ওই এলাকা কার্যত অচল করে দেয়। পরে আর তাদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। এত কিছু করেও যখন কিছু হলো না, তখন আগুন থেরাপির বিকল্প নেই! বস্তিবাসীর ধারণাও তেমন। তারা আর্তনাদে বলে, পরিকল্পিতভাবে বারবার আগুন দেয়া হয় কড়াইল বস্তিতে। কল্যাণপুরের পোড়াবাড়ি বস্তিতে ২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি আগুন দেয়া হয়। ওই জমির মালিক হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞায় উচ্ছেদ অভিযানে ব্যর্থ হয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সহায়তায় বস্তির একটি অংশে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। বস্তি উচ্ছেদের ওই আগুনে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যেতেও বাধা দেয়া হয়। কি সাংঘাতিক ব্যাপার! বস্তিগুলোতে যে ঘন ঘন আগুন লাগছে এসব ঘটনার একটা বড় অংশের পেছনে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র রয়েছে। জমি ফিরে পেতে পূর্ব কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই রাজনীতির আশ্রয়ে আগুন থেরাপি চালাচ্ছে। এতদিন যখন বস্তির ভাড়ার টাকা পকেটে ঢুকেছে, তখন কেন তাদের অন্যত্র স্থানান্তের সুযোগ না দিয়ে আগুনের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে? অনেক বস্তিতেই দেখা যায় পুড়ে যাওয়ার পর সেখানে অন্য কোনো স্থাপনা তৈরি হয়। আবার অনেক জায়গায় অগ্নিকান্ডের পর বস্তিতে নতুন ঘর উঠলেও দেখা যায় মালিকানা বদলে যায়। নিরীহ মানুষের ভাগ্য পুড়িয়ে তারা ব্যবসার প্রসার করছেন। আগের দখলদারদের স্থলে নতুন দখলদার চলে আসেন। কি চমৎকার কৌশল! শেষ কথা, আমরা দেখছি, রাজধানীসহ সমগ্র দেশে বস্তিবাসীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এটি নিয়ন্ত্রণে, প্রতিরোধে সরকারকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। মানুষ কেন বস্তিমুখী হচ্ছে? দেশে যখন এত অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে, তখন কেন মানুষ আশ্রয় পাচ্ছে না? তাদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ নিতে হবে। এসব হয়তো আমার মুখের কথা শুধু শুধু। কেননা, দেশে যখন বস্তিবাসীদের নিয়ে কোনো পরিকল্পনা-ই গ্রহণ করা হয় না, তখন এই বিশাল জনসংখ্যার কথা খুব একটা মাথায় রাখে না সরকারসহ সংশ্লিষ্ট মহল। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় রয়েছে কিন্তু তাদের কাজে সমন্বয়হীনতার কারণে বস্তিবাসীদের প্রতিনিয়ত আগুনের মুখে পতিত হতে হচ্ছে। বস্তির মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের দায়িত্ব কার? কাজগুলো কীভাবে হবে?