মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব

প্রকাশ | ২৫ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

নাজমুল হক ঢাকা
সরকারি হিসাব মতে ৭০-৮০ লাখ যুবক মাদকাসক্ত; কিন্তু বেসরকারি তথ্যমতে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি (ইত্তেফাক- ৯/১/১৯) অন্যদিকে মাদকাসক্ত নিয়ে বিভিন্ন গবেষকের তথ্যমতে দেশের সংগঠিত অপরাধের ৫০%-এরও বেশি মাদককে কেন্দ্র করেই সংগঠিত হচ্ছে। তাছাড়া ধর্ষণের ঘটনায় অনেক মাদকাসক্ত ব্যক্তির সম্পৃক্ততা এখন প্রমাণিত। গত ৪ মে ২০১৮ থেকে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে প্রায় ৪০০-রও বেশি মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়। নিহতের সংখ্যা যদি ১০০ গুণ বেড়ে ৪০ হাজার হয় তবে কি বাংলাদেশ মাদকমুক্ত হবে? বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এধরনের মাদকবিরোধী যুদ্ধে এর থেকে শত শতগুণ বেশি মাদক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মৃতু্যর পরও সেসব দেশে মাদকের বিচরণ তেমন কমেনি তার জলজ্যান্ত উদাহরণ মেক্সিকো, কম্বোডিয়া ও ফিলিপাইন। তাছাড়া আমাদের দেশেও এত অভিযান ও আত্মসমর্পণের পরও গত কয়েকদিনে বিশাল বিশাল ইয়াবার চালান ধরা পড়েছে বরং অভিযানের অজুহাতে একই মাদক এখন দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। যে দেশে প্রায় ৪৫ লাখ যুবক বেকার, তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও স্বল্প পুঁজিতে অথবা বাহক হিসেবে অল্প সময়ে কাঁচা টাকা উপার্জনের জন্য মাদক বিক্রির রাস্তা খুঁজে নেবে সে ক্ষেত্রে ক্রসফায়ারে একজন মেরে ফেললে টাকার জন্য আরেকজন গজিয়ে উঠবে। বাংলাদেশে মাদক বিস্তৃতিতে মাদকের চাহিদার ব্যাপারটা সবার আগে বিবেচনায় নিতে হবে। বর্তমানে সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন মাদক ইয়াবা যার চাহিদা প্রায় ৭১% পরের স্থানেই আছে ফেন্সিডিলের চাহিদা প্রায় ১৫%, বাকি ১৪% মাদকের চাহিদায় আছে মদ, হেরোইন, প্যাথেড্রিন, আফিম ও অন্যান্য মাদকের আবার সব মাদকসেবীর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই গাঁজায় অভ্যস্ত। শুধু ইয়াবা ও ফেন্সিডিল নিয়ন্ত্রণ করা গেলে প্রায় ৮৬% মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ইয়াবার তীর্থস্থান মিয়ানমার অন্যদিকে ফেন্সিডিলের তীর্থস্থান ভারত অথচ আশ্চর্যের বিষয় মিয়ানমার ও ভারতে তাদের উৎপাদিত মাদকে আসক্ততা নেই বললে চলে। কেন নিজ দেশে উৎপাদিত মাদকে তাদের আসক্ততা নেই? আমি দুটি দেশে কয়েকবার ভ্রমণ করে যা উপলব্ধি করলাম তা হলো তুলনামূলক হালকা বা কম ক্ষতিসম্পন্ন মাদকগুলো তাদের দেশে সহজলভ্য যার ধরুন ভারী বা ভয়ঙ্কর মাদকে তারা কম জড়াচ্ছে। তাদের দেশের মাদকসেবীদের মাদকের পিছনে ব্যয়কৃত মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার নিজ দেশেই থেকে যাচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে বিক্রীত ইয়াবা ও ফেন্সিডিলের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আমাদের দেশ থেকে পাচার হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের মূল অর্থনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব রাখছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলো বাদে অন্য বৃহৎ দলগুলোর অনেক নেতাকর্মীরা কমবেশি মাদক গ্রহণ বা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। যার দরুন তাদের মধ্যে প্রায় সময় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে অথবা বিভিন্ন ইসু্যতে আন্তঃকোন্দল সৃষ্টি হয়; কিন্তু ধর্মাশ্রয়ী দলে এই ধরনের আন্তঃকোন্দল নেই বললেই চলে। এ ছাড়া বৃহৎ দলগুলোর যুবক ও ছাত্রসমাজ যেভাবে মাদকে জড়িয়ে যাচ্ছে তাতে পরে তাদের নেতৃত্বের সংকট তৈরি হবে। তাই দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক বিবেচনায় মাদক নির্মূলে, মাদকের চাহিদা শূন্যপর্যায়ে না আনতে পারলেও সহনীয় মাত্রায় আনতে হবে। কোনো একসময় বাংলাদেশে হেরোইনের ব্যাপক চাহিদা ছিল; কিন্তু বর্তমানে এর চাহিদা নেই বললেই চলে যার দরুন এর আমদানিও স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে গেছে। ইয়াবা বা ক্রেজি ট্যাবলেটের জন্যই বাংলাদেশে দিন দিন খুনের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। মাদকসেবীদের তথ্যানুসারে ইয়াবা সেবন করে মানুষ হত্যা খুব সহজ; কিন্তু অন্য কোনো নেশায় তা সহজে সম্ভব নয়। তাছাড়া ইয়াবা পাচার, বিক্রি ও সেবনের সঙ্গে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাঠপর্যায়ের অনেক অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী জড়িত থাকার অনেক প্রমাণ গণমাধ্যম, মাদকসেবী ও মাদক বিক্রেতাদের কাছ থেকে জানা যায়। কারাগারে আটককৃত অনেক মাদকসেবী ও মাদক বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পাওয়া যায় যা নিচে তুলে ধরা হলো- ১। বর্তমানে বেশির ভাগ মাদক আসামিকে হেরোইন উদ্ধার মামলা দেয়া হচ্ছে অথচ হেরোইন এখন অপ্রতুল। কিন্তু কেন? প্রথমত- পুলিশ চাচ্ছে তাদের জামিন বিলম্ব দ্বিতীয়ত- হেরোইন রিকভারি দেখানো সহজ অর্থাৎ ডালের গুঁড়া (বেশন) ও কয়েলের গুঁড়া নকল হেরোইন হিসেবে দেখানো যায় পরে এই নকল হেরোইন তারা আসল হেরোইন বলে ধ্বংস করে অথচ তা আসল ছিল না। এক আসামি জানায়, পুলিশ তাকে ৫০০ গ্রাম হেরোইন বা ৫০০০ পুরিয়া হেরোইন জব্দ দেখিয়ে আটক করে। পরে সে আদালতের মাধ্যমে ল্যাব টেস্টের আবেদন জানালে তার ওই নকল ৫০০ গ্রাম হেরোইনের সঙ্গে ৫-৭ গ্রাম আসল হেরোইন মিক্সড করে .০১% বা ০.০২% হেরোইন উপস্থিত দেখায়। অনেক সময় আটককৃত ইয়াবা পুলিশ সোর্সের মাধ্যমে বিক্রি করে দিয়ে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে আসামিকে হেরোইন মামলা দেয়। চতুর্থত- অনেকের ধারণা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বড় ধরনের কোনো হেরোইন চালান পূর্বে আটক করেছে কিন্তু তা জব্দ তালিকায় দেখায়নি। যার দরুন এখন অন্য মাদকের আসামিদের হেরোইন মামলা দেয়া হচ্ছে। ২। লিটন (ছদ্মনাম) বড় মাদক ব্যবসায়ী তার সঙ্গে ২ কাট বা ২০ হাজার পিছ ইয়াবা রিকভারি ধরে পুলিশ অথচ তার কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা উৎকোচ নিয়ে তাকে ৪৮০ পিছ রিকভারি দেখায় বাকি ১৯৫২০ পিছ ইয়াবা সোর্সের কাছে বিক্রি করে দেয়। ৩। হাছান (ছদ্মনাম) একজন মাদকসেবী তার কাছ থেকে ৩ পিছ ইয়াবা রিকভারি পায় অথচ তাকে প্রায় ১০০০ পিছ রিকভারি দেখায়। সে জানায় আগে কারও কাছ থেকে বড় চালান পেয়ে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়ে ঊর্ধ্বতনের চাপে সেটি আমার ওপর চাপিয়ে দেয়। ৪। ইয়াবা খুবই চাহিদা সম্পন্ন হওয়ায় অনেক সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বড় ধরনের চালান ধরে মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা গ্রহণ করে এবং আটককৃত চালান পাইকারি দামে সোর্সের মাধ্যমে বিক্রি করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ- আজিজের (ছদ্মনাম) কাছে ২ কাট বা ২০ হাজার পিছ ইয়াবা পায় এতে তার কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা উৎকোচ নিয়ে ২০ পিছ দেখায় এবং ১৯৯৮০ পিছ ১০০ টাকা করে বিশ লাখ টাকা বিক্রি করে অর্থাৎ একজনের কাছ থেকেই ৩৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ৫। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ইনফর্মারা অনেকটা খোলামেলাভাবে মাদক বিক্রি করে কারণ এর লভ্যাংশের একটি বড় অংশ মাঠপর্যায়ের অনেক অসাধু পুলিশ পেয়ে থাকে। ৬। মাদকবিরোধী অভিযান অথবা গ্রেপ্তারের জন্য প্রশাসনিক চাপ এলে অনেক সময় তারা নিরীহ সাধারণ মানুষ অথবা সিজনাল মাদকসেবী (যারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক বা ৩-৪ মাস পরপর মাদক সেবন করে) এদের মধ্যে অনেক উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান থাকে যারা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে মাদক মামলা থেকে বাঁচার জন্য বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তা মিটমাট করে। উপরোক্ত আলোচনার পরও এটিই চিরন্তন সত্য (মাদক সম্পৃক্তদের তথ্যানুসারে)র্ যাব, পুলিশ ও অন্যান্য প্রশাসনে এখনো অনেক ন্যায়-পরায়ণ কর্মকর্তা আছে যারা কোটি কোটি টাকার অন্যায্য প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে দেশের জন্য মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। ইতোমধ্যে এনএসআই, ডিজিএফআই,র্ যাব, কোস্ট গার্ড, বিজিবি, আনসার-ভিডিপির সমন্বিত তালিকা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে জমা হয়েছে। ওই প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, মাদক পাচার ও সরবরাহ বাণিজ্য জেলার মধ্যে শীর্ষস্থান কক্সবাজার আর কুমিলস্না এবং থানা হিসেবে টঙ্গি আর আশুলিয়া শীর্ষে তাই এই জেলা ও থানাগুলোর প্রতি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন এ ছাড়া নতুন কোনো জেলা বা থানায় যাতে এর প্রাদুর্ভাব না বাড়ে সেদিকে নিয়মিত ফলোআপ প্রয়োজন। ব্যক্তিগতভাবে যাতে কেউ মাদকে না জড়াতে পারে এজন্য কিছু উদ্যোগের প্রয়োজন : ১। মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য একটি কেন্দ্রীয় সার্ভার অ্যাপস করা যায় যাতে বাংলাদেশের সব জেলা, থানা ও ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত থাকবে। সাধারণ জনগণ যার যার এলাকায় গোপনীয়ভাবে সে অ্যাপসে তথ্য প্রদান করবে। পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা তা যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করবে এতে স্থানীয় মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীরা ব্যাপক চাপে থাকবে। ২। যেখানেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কোনো মাদকের চালান আটক করবে সেখানে স্থানীয়দের উপস্থিতিতে অথবা নিজেরা অ্যাপসে মাদক জব্দের তথ্য প্রদান করবে তাহলে মাদকের চালান নিয়ে কোনো রকম হেরফের হবে না। ৩। মাদকসেবী (প্রথমে কিনে খায় পরে টাকার অভাবে মাদক বিক্রিতে সহায়তা করে) ও খুচরা মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে বেকারত্ব ঘুচানোর জন্য এবং শর্টকাটে টাকা উপার্জনের জন্য তারা মাদক ব্যবসা বেছে নেয়। সে ক্ষেত্রে এদের চিহ্নিত করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা খুবই জরুরি। ৪। উঠতি বয়সের যুবক-যুবতীদের পারিবারিক কলহের চাপ ও পরীক্ষার চাপ কমানো প্রয়োজন। এ ছাড়া থানাভিত্তিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অথবা মনোরোগ চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন কারণ যুবক-যুবতীরা এই দুটি কারণে ব্যাপক হারে মাদকাসক্তে জড়িত হচ্ছে। ৫। উঠতি বয়সের যুবক-যবতীদের জন্য প্রত্যেক এলাকার খেলার মাঠ ও জিমনেসিয়াম প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন কারণ খেলাধুলা ও জিমে অভ্যস্ত ছেলেমেয়ে মাদকে জড়িত নেই বললেই চলে। ৬। জমির মামলাগুলো (সিভিল মামলা) বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে শেষ করতে হবে কারণ অনেক মাদকসেবীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে যারা মূলত সংগঠিত বিভিন্ন দলের/গ্যাংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রধান কারণ পারিবারিক জমির ঝামেলা, পারিবারিক শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সে সংগঠিত বিভিন্ন দলের/গ্যাংয়ের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে শক্তি প্রদর্শন করতে চায় পরে জড়িয়ে যায় ভয়ঙ্কর মাদকে। ৭। নতুন কেউ মাদকাসক্ত না হওয়ার জন্য ব্যাপক সচেতনতা প্রয়োজন। প্রয়োজনে তা পাঠ্যপুস্তকে তুলে ধরতে হবে এবং সমগ্র বাংলাদেশের একসঙ্গে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। ৮। মাদক থেকে মুখ ফিরিয়ে যারা সুস্থ জীবনে ফিরবে তাদের সমাজে বিশেষ মর্যাদায় পুরস্কৃত করা এবং মিডিয়ায় তা ব্যাপক প্রচার করা যাতে অন্য মাদকসেবীরা তা দেখে উৎসাহিত হয়। ৯। মাদক নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে 'মাদক নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়' প্রতিষ্ঠা এবং মাদকসেবীদের জন্য সরকারি রিহ্যাব সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা এখন খুবই জরুরি।