মোজাফফর আহমদের জীবনাবসান

গভীর শোক ও সমবেদনা জানাই

প্রকাশ | ২৫ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
উপমহাদেশের বাম রাজনীতির অন্যতম পুরোধা, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের জীবনাবসান ঘটেছে। বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম নক্ষত্র, ৯৭ বছর বয়সী মোজাফফর আহমদ বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে গত ১৪ আগস্ট রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি হন। এই জননেতার শারীরিক অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছিল। অবশেষে শুক্রবার সন্ধ্যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃতু্যতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গন, সুধীমহলসহ সর্বত্রই শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বর্ণিল রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী মোজাফফর আহমদ ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিলস্না জেলার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আলহাজ কেয়াম উদ্দিন ভূইয়া এবং মাতা আফজারুন্নেছা। মোজাফফর আহমদ যথাক্রমে হোসেনতলা স্কুল ও জাফরগঞ্জ রাজ ইনস্টিটিউশনে প্রাথমিক, দেবিদ্বার রেয়াজউদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক এবং ভিক্টোরিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি গ্রহণ করেন এবং ইউনেস্কো থেকে একটি ডিপেস্নামা লাভ করেন। কর্মজীবনে মোজাফফর আহমদ দীর্ঘদিন বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেন ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত। ১৯৩৭ সালের দিকে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে অধ্যাপনা ছেড়ে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিজ জেলা কুমিলস্নার দেবিদ্বার আসনে তৎকালীন মুসলিম লীগের শিক্ষামন্ত্রীকে পরাজিত করে রাজনীতি অঙ্গনের সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাপের প্রতিনিধি নেতা হিসেবে অধ্যাপক মোজাফফর আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সামরিক শাসক আইয়ুব সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও হুলিয়া জারি করে, তাকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কারও ঘোষণা করে। তথ্য অনুযায়ী, আট বছর আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৬৬ সালে তিনি প্রকাশ্য রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী বাম রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর রংপুর জেলায় অনুষ্ঠিত এক কাউন্সিল অধিবেশনের পর চীনপন্থি ও মস্কোপন্থি-এ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। চীনপন্থি ন্যাপের সভাপতি হন মাওলানা ভাসানী এবং মস্কোপন্থি ন্যাপের সভাপতি হন সীমান্ত প্রদেশের খান আবদুল ওয়ালী। মস্কো শিবিরে পূর্ব পাকিস্তানপন্থি ন্যাপের সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। এ অংশ মোজাফফর ন্যাপ নামেও পরিচিত ছিল। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তথা মুজিবনগর সরকারের যে ছয় সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তিনি সফর করেন। ১৯৭৯ সালে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নব্বইয়ে স্বৈরাচারী শাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শুরুতে তিনি কারারুদ্ধ হন। বলার অপেক্ষা রাখে না, মৃতু্য মানুষের অলঙ্ঘ নিয়তি। কিন্তু কিছু কিছু মৃতু্য মানুষকে খুব ব্যথিত করে। কেউ কেউ শারীরিকভাবে না থাকলেও তার অবদান ও আদর্শ দেশবাসী চিরদিন স্মরণ করে। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মৃতু্যও তদ্রূপ। তিনি শুধু রাজনীতিকই নন, একজন সাহিত্যিকও। তিনি তার জীবন ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক কর্মের মধ্যদিয়ে যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন, যে আলোকস্রোতের সন্ধান দিয়েছেন- তা অবিস্মরণীয়। তাই তার মৃতু্যজনিত শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তার মৃতু্যর মধ্যদিয়ে জাতি একজন গুণীকে হারাল। মুক্তিযুদ্ধকালে সরকারের সর্বশেষ উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মৃতু্যতে গভীর শোক ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও অনুরূপ শোক ও শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। দেশবরেণ্য এই রাজনীতিক ও সাহিত্যিকের মৃতু্যতে আমরাও গভীরভাবে শোকাহত। আমরা তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। তার সততা, বিচক্ষণতা, প্রজ্ঞা, দর্শন ও আদর্শের কারণেই দেশবাসীর হৃদয়ে তিনি চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে জাগরূক থাকবেন বলে আশা করা যায়।