রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশের দায়

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা উচিত। এটা সম্ভব না হলে রোহিঙ্গাদের জন্য সারা জাতিকে একদিন বড় ধরনের মাশুল দিতে হবে।

প্রকাশ | ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। রোহিঙ্গা সমস্যাটির কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলাকে ক্রমেই অবনতির দিকে নিয়ে যাবে। সম্প্রতি টেকনাফ ছাত্রলীগ নেতা খুন হওয়ার পেছনে রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠী জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। রোহিঙ্গারা তাদের জন্য নির্মিত ভাসান চরের আশ্রয় কেন্দ্রেও যেতে রাজি হয়নি। তাহলে রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ্যটা কি? তারা কি চায়? গত ২২ আগস্ট প্রথম দফায় তিন হাজারের অধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের কথা থাকলেও একজন রোহিঙ্গাকেও সেদিন মিয়ানমারে পাঠানো সম্ভব হয়নি। গত এক দশকে প্রায় ১০ লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে রাখা হয়েছে কক্সবাজার জেলার উখিয়া এবং টেকনাফ উপজেলায় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে। এই দুই উপজেলার মোট জনসংখ্যার চাইতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনংখ্যা অনেক বেশি। যতই দিন যাচ্ছে আর এই রোহিঙ্গারা নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে। ইয়াবাসহ নানা মাদক ব্যবসার সঙ্গে রোহিঙ্গারা জড়িত। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপনের জন্য এই দুই উপজেলার অসংখ্য বন এবং পাহাড় কাটা হয়েছে। এর ফলে এই দুই উপজেলার প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্য ঘটেছে। রোহিঙ্গারা জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করে না। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন অসংখ্য রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে। গত ১০ বছরের জন্ম নেয়া রোহিঙ্গা শিশুর হিসাব করলে দেখা যাবে প্রায় এক লাখের কাছাকাছি হয়ে গেছে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মূল জনসংখ্যার সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত। অনেকেই ভোটার হয়ে গেছে বলে নানা সূত্র থেকে খবর পাওয়া যায়। বিভিন্ন অসমর্থিত তথ্যের সূত্র থেকে জানা যায়, রোহিঙ্গারা তাদের শরণার্থী শিবিরে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তাই অশঙ্কা করা যাচ্ছে যে, এই রোহিঙ্গারা বলপূর্বক এ দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের চেষ্টা করতে পারে। আর এ রকম ঘটনা ঘটলে দেশের আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি দেখা দিবে- যা নিয়ন্ত্রণ করাটাও কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়বে। ২২ আগস্ট রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে না যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, প্রত্যাবর্তনকারী রোহিঙ্গাদের দাবি ছিল মিয়ানমারে তাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব বিষয়টি নিশ্চিত করা দায় বাংলাদেশের না। বাংলাদেশ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বিষয়টি নিশ্চিত করা দায়িত্ব আন্তর্জাতিক মহলকেই দেখতে হবে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে এটা যথেষ্ট। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিকদের সামাজিক সাংস্কৃতিকগত কোনো মিল নেই। রোহিঙ্গাদের খাবার প্রণালি, পোশাক, ভাষা, সামাজিক আচার, নিষ্ঠা বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ- তবে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৮০-৮৫ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্ম পালন করে আর রোহিঙ্গারা ইসলাম ধর্ম পালন করে সে হিসেবে কিছু একটু মিল রয়েছে। একমাত্র ধর্ম পালন ছাড়া বাংলাদেশের মানুষের অন্য কোনো কৃষ্টি কালচারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মিল নেই। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অধু্যষিত এলাকার সঙ্গে ভারত, চীন ও বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে, তাহলে কেন এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দায়ভার বাংলাদেশকে একা বহন করতে হচ্ছে? মিয়ানমারে বসবাসকারী এই রোহিঙ্গারা অতীতে বাংলাদেশ থেকে বার্মায় গমন করা কোনো জনগোষ্ঠী নয়। তারা মিয়ানমারে প্রায় পাঁচ থেকে সাতশ বছর আগে বসতি স্থাপন করেছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ১৪৩০ সাল থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা প্রদেশটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওয়াফা এ রাজ্য দখল করে মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্ত করে। পরবর্তী সময়ে সমগ্র মিয়ানমার অর্থাৎ তৎকালীন বার্মা ব্রিটিশ শাসনাধীন হয়ে যায়। ব্রিটিশরা তৎকালীন বার্মায় ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তত করে আর সেই তালিকা থেকে বাদ পড়ে রোহিঙ্গারাদের নাম। একটি সূত্র থেকে জানা যায় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নে রোহিঙ্গা সমস্যাটির সৃষ্টি হয়েছিল রোহিঙ্গাদের দ্বারাই। ১৯৪৬ রোহিঙ্গারা ব্রিটিশদের নির্দেশনানুযায়ী বৌদ্ধ-মুসলিম সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায়। ব্রিটিশদের ধারণা ছিল যে দ্বিতীয় বিশ্বেযুদ্ধে জাপানিদের জয়কে স্বাগত জানাতে পারে আরাকানের বৌদ্ধরা। সেই ধারণার আলোকে ব্রিটিশরা ১০ মাইলের একটি বাফার জোন নির্দিষ্ট করে সেখানকার অভিবাসী রোহিঙ্গাদের লেলিয়ে দেয় বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে। কথিত আছে যে, এক সপ্তাহের রোহিঙ্গা নৃশংসতায় প্রায় ১০ হাজার বৌদ্ধ নিহত হয়, ব্রিটিশ প্ররোচনায় রোহিঙ্গা জনপদকে প্রথম এভাবেই রক্তের প্রান্তর গড়ে তোলে রোহিঙ্গরাই। এই রক্তাক্ত হাঙ্গামায় বৌদ্ধদের হাতে ৫ হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ হারায়। আর এভাবেই দুই ধর্মপালনকারী জনগোষ্ঠীর মাঝে বিবাদের সূত্রপাত শুরু- যা আজও বিদ্যমান। ওই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িকতার সংঘর্ষের বীজ ব্রিটিশরাই রোপায়িত করে রেখে যায়; আজ তা মহিরুহে পরিণত হয়েছে। ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতার পর বার্মা বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করলেও এই যাত্রা থেমে যায়। গণতন্ত্রের আমলে মিয়ানমারের পালামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভু্যত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করে। নে উইন গণতন্ত্রকে নির্বাসন দেয়। ব্রিটিশদের করা ১৩৯টি জাতিগত সম্প্রদায়ে রোহিঙ্গাদের নাম না থাকায় তাদের নাগরিক অধিকার হরণ করে নেয় সামরিকজান্তারা এবং ১৯৪৬ সালের ঘটনার পর থেকে বিবাদমান দুই গ্রম্নপের বারবার সংঘর্ষ হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুদ্র জাতি সংখ্যার অধিবাসীরা নানা নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়। কারও কারও মতে রোহিঙ্গারা পৃথিবীর অন্যতম নিগৃহীত জনগোষ্ঠী। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইনের ফলে রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিকত্ব হারায়। তারা নিজভূমে হয়ে যান কারাবন্দি। সরকারের অনুমোদন ব্যতিত তারা ভ্রমণ করতে, আর দুটির অধিক সন্তান জন্ম দিতে পারবে না বলে আইনও হয়। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখলের পর থেকেই এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এই রোহিঙ্গা শরণার্থীরদের আশ্রয় দিয়ে আসছে। ১৯৭৮ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নাগামান (ড্রাগন রাজা) অভিযান চালায় রাখাইন প্রদেশে। এই অভিযানে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। মিয়ানমার সরকার এই অভিযানের কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিল যে, তাদের অভ্যন্তরে বসবাস করা অবৈধ অভিবাসীদের উচ্ছেদ করা। ১৯৬২ সালে নে উইন সরকার যখন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণ করে নেয় তখন থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা অবৈধ অভিবাসী। এই অবৈধ অভিবাসীদের উচ্ছেদ করতে মিয়ামারের সরকার বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অভিযান চালায়। ১৯৮২ সালেও অনেক রোহিঙ্গা নানাভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ১৯৭৮ সালে অ্যামন্যাস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছিল, মিয়ানমারারে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। কিন্তু এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো প্রতিকার অ্যামন্যাস্টি গত ৩৮ বছরেও করতে পারেনি। প্রতি বছরই কোনো না কোনোভাবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে- তবে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে চার/পাঁচ বার। ১৯৯১-৯২ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা অধু্যষিত অঞ্চলে রোহিঙ্গা এবং বৌদ্ধদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয় ওই সময় প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে, ২০১২ সালে রোহিঙ্গা এলাকায় কয়েকজন বৌদ্ধ তরুণী রোহিঙ্গাদের হাতে গণধর্ষণ এবং হত্যা হওয়ার পর আবার দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। ওই সময়ও রোহিঙ্গা মুসলমানরা সরকারি ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর নিপীড়নের শিকার হয়ে দলে দলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। \হরাষ্ট্রসমূহের অভিভাবক জাতিসংঘকে এত বিপুলসংখ্যায় রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আসছে সেই সম্পর্কে স্থায়ী কোনো সমাধানের পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। ২০০৫ সালে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ নেয় কিন্তু রোহিঙ্গা শিবিরে নাকি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এই অভিযোগে তা ভেস্তে যায়। ২০১৬ সালে আবার দাঙ্গা দেখা দেয় মিয়ানমারের। রোহিঙ্গা দাঙ্গা ১৯৪৬ থেকে ২০১৮ প্রায় ৭২ বছরের বিবাদমান একটি সমস্যা। সুতরাং এর দায় বাংলাদেশ কেন একা বহন করবে। বাংলাদেশের বেশ কিছুসংখ্যক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক এনজিও এই রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে কাজ করছে। তারা এই রোহিঙ্গাদের বদৌলতে বিপুল পরিমাণের বৈদেশিক সাহায্য পাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, এই এনজিওগুলোও পরোক্ষভাবে রোহিঙ্গাদের ইন্ধন দিচ্ছে মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন না হওয়ার জন্য। কিছু কিছু এনজিও মানবাধিকারের কথা তুলে বলছেন, জোর করে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পাঠানো হলে তা হবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। জাতীয় আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিয়ে গিয়ে সেখানে কাজ করে তাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করুক। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কেন? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিপুল পরিমাণের সাহায্য প্রদান করছে। এখানে প্রশ্ন আসে, বিদেশিরা এই সাহায্যটা মিয়ানমারকে দিক। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ করিয়ে বাংলাদেশের মতো আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করে তারা এই সাহায্যটা দিতে পারে। রোহিঙ্গারাতো বাংলােেদশের নাগরিক না। তারা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আছে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর উচিত, এই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে শরণার্থী হিসেবে রাখার ব্যবস্থা করা এবং মিয়ানমারে শরণার্থী হিসেবে রেখে ওই দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে রোহিঙ্গা সমস্যাটির সমাধানের উদ্যোগ নেয়া। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল রাষ্ট্রের কাঁধে এরকম জনবিস্ফোরণ সমস্যাটি চাপিয়ে দেয়াটা অনৈতিক। দেশের অভ্যন্তরে যে সমস্ত এনজিও নিজেদের স্বার্থে রোহিঙ্গা সমস্যাটি ধরে রাখছেন তারা নীতি গর্হিত কাজ করে দেশকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। সরকার অবশ্য বেশ কিছু এনজিওকে প্রত্যাহার করেছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা উচিত। এটা সম্ভব না হলে রোহিঙ্গাদের জন্য সারা জাতিকে একদিন বড় ধরনের মাশুল দিতে হবে। শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: কলাম লেখক