অটিজম নিয়ে ভাবতে হবে নিতে হবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা

অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষা এবং চিকিৎসা শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক থাকলে চলবে না। সুষ্ঠু চিকিৎসা, শিক্ষা, থেরাপি- রাজধানী থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় ছড়িয়ে দিতে হবে। সহযোগিতা ও সহানুভূতির হাত প্রসারিত করতে হবে এসব পরিবারের প্রতি। বোঝা নয়, সম্পদ করে গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রের নিতে হবে সুদূরপ্রসারী কর্ম-পরিকল্পনা। সময়ের প্রয়োজনেই আমাদের অটিজম নিয়ে ভাবতে হবে।

প্রকাশ | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
'অটিজম' নিয়ে সচেতনতামূলক একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম গত চার/পাঁচ বছর আগে। একজন ডাক্তার সে অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ঋষি এবং সাধকরা ধ্যানের মাধ্যমে মোহমুক্ত যে জীবনের জন্য একযুগ সাধনা করেন একটি অটিস্টিক শিশু জন্মগতভাবেই সেই মোহমুক্ত নির্লিপ্ত জীবন লাভ করে। পৃথিবীর মলিনতা, স্বার্থপরতা, হিংস্রতা তাকে গ্রাস করে না। অনুষ্ঠানের শুরুতেই তার সূচনা বক্তব্য 'অটিজমের' মতো একটি বিষয়কে অন্যমাত্রায় পৌঁছে দেয়। প্রত্যেকেই নড়েচড়ে বসে এ সম্পর্কে জানার জন্য। ১৯৪৩ সালে একজন আমেরিকান চিকিৎসক লিও ক্যানার শিশুদের আচরণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে ১১ জন শিশুর মধ্যে আচরণগত তিনি প্রথম এ রোগের বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করেন। তিনিই প্রথম এ রোগের নামকরণ করেন 'অটিজম' পরবর্তীকালের প্রায় এক বছর পর অস্ট্রিয়ার চিকিৎসক হ্যান্স অ্যাস্পারজার ও শিশুদের ওপর গবেষণা করে কিছু শিশুর মধ্যে আচরণগত বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করেন। মজার বিষয় হলো, তিনি এই রোগের নামকরণ করেন 'অটিজম' এই নামকরণের আগ পর্যন্ত তারা কেউ কাউকে চিনতেন না এবং নামকরণও করেছিলেলেন তারা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে। ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর কাতারে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৬২তম সাধারণ সভায় বিশ্বে অটিজম সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২ এপ্রিলকে বিশ্বে অটিজম সচেতনতা দিবস হিসেবে পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই জন্যই ২০০৮ সালের ২রা এপ্রিল সর্বপ্রথম 'বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস' পালন করা হয়। বিশ্বব্যাপী প্রতি দেড়শ শিশুর মধ্যে একটি শিশু অটিজমে ভোগে। কিন্তু অটিজমের সুনির্দিষ্ট কারণ আজও জানা যায়নি। সাধারণত অটিজমের কারণ হিসেবে ধরা হয়: ১। মস্তিষ্কের কোনোরূপ গঠনগত ক্ষতি ২। অস্বাভাবিক বৈদু্যতিক ক্রিয়া। ৩। শরীরে নিউরো কেমিক্যাল ক্রিয়ার অসাম্য। অটিজমের জেনেটিক কারণ হিসেবে ক্রোমোজমের অস্বাভাবিক অবস্থা '৭য়১১.২৩' কে দায়ী করা হয়। সেসব শিশু একটির বেশি '৭য়১১.২৩' বহন করে, তাদের ক্ষেত্রে ক্রোমোজমের ৭-এর অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। জেনেটিক কোডিংয়ের এই অবস্থার কারণে অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের সম্মুখীন হতে হয়। অটিজমের নির্ধারিত কোনো কারণ নেই। জটিলতা, লক্ষণ এবং তীব্রতার ওপর নির্ভর করে এর কারণগুলো বিভিন্ন হতে পারে। সতর্কতা অবলম্বনের জন্য কিছু কারণ জেনে রাখা উচিত। অটিজমের কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর হলো: ১। মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক গঠন। ২। শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব। ৩। অপুষ্টি (ভিটামিন-ডি, বি-১ অভাব) ৪। গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে মার নানাবিধ ক্ষতিকর ওষুধ সেবন। ৫। গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাসে মা যদি রুবেলায় আক্রান্ত হয়। ৬। গর্ভাবস্থায় মা যদি সিজোপ্রোনিয়ায় ভোগেন। ৭। মায়ের টেরাটোজেনিক ওষুধ সেবন। ৮। জন্মের সময় ওজন কম, অক্সিজেনের অভাবে নীল হয়ে যাওয়া, পূর্ণ গর্ভ হয়ে না জন্মানো। ৯। শিশুর রক্তে সিসার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। ১০। শরীরে পাচক রসের অভাব। প্রভৃতি। যেহেতু অটিজম সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়, তাই সচেতনতা বৃদ্ধিই পারে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। পরিবারে কারো অটিজম অথবা কোনো মানসিক এবং আচরণগত সমস্যা থাকলে পরবর্তী সন্তানের ক্ষেত্রে অটিজমের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। পরিকল্পিত গর্ভধারণ এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় অধিক দুশ্চিন্তা না করা, পর্যাপ্ত ঘুম, শিশুর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন, বেশি বয়সে বাচ্চা না নেয়া, বাচ্চা নেয়ার আগে রুবেলা ভ্যাকসিন দেয়া এবং অবশ্যই বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করানো- এসব বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। অটিজম শনাক্ত করতে যত দেরি হয়, জটিলতা তত বাড়তে থাকে। শিশুর স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সম্ভাবনা ততই কমতে থাকে। তাই বিজ্ঞানী ও ডাক্তাররা এক থেকে দুই বছরের মধ্যে অটিজম শনাক্তের প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছেন। মা-বাবাকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে দু'একটা দেখা গেলেই দ্রম্নত ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। ১। ১২ মাস পূর্ণ হওয়ার পরও বাবা, দাদা না বলা। ২। ১২ মাস পূর্ণ হওয়ার পরও আঙুল দিয়ে, হাত দিয়ে বা হাত ধরে আগ্রহের জিনিসের দিকনির্দেশনা করতে না পারা। ৩। ১৬ মাস পূর্ণ হওয়ার পরও একটি অর্থবোধক শব্দ উচ্চারণ করতে না পারা। ৪। এক বছরের কম বয়সি শিশু সরাসরি চোখের দিকে না তাকিয়ে চোখের বাইরের কোণা দিয়ে আড়চোখে অতি অল্প সময়ের জন্য তাকানো। ৫। কিছু কিছু শব্দ না শোনার ভান করা। উচ্চস্বরের শব্দে সাড়া না দেয়া। বিশেষ ধরনের শব্দের প্রতি অতি আকর্ষণ। ৬। নাম ধরে ডাকলে না শোনা। ৭। খেলাধুলায় আগ্রহের অভাব। ৮। খেলনা ভাগাভাগি করে খেলতে না পারা। ৯। এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হলো- অন্যের দিকে তাকানোর অস্বাভাবিকতা। ১০। নিজের নাম উচ্চারণ করার পরও কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখানো ইত্যাদি। অটিস্টিক শিশুকে অনেকে পাগল, আলগা দোষ, মা-বাবার অভিশাপ ইত্যাদি কুসংস্কারে সংজ্ঞায়িত করে থাকেন। এটা সম্পূর্ণ ভুল এবং ভিত্তিহীন। এসব কুসংস্কার ও ভুল ধারণার কারণে চিকিৎসার পরিবর্তে অপচিকিৎসা হয়। ফলে ভালো কিছু না হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে শিশুর জীবন। যত দ্রম্নত শনাক্ত করা যায় ততই শিশুর জন্য কল্যাণকর। কারণ অন্যসব শিশুর মতো সুস্থ, স্বাভাবিক আচরণ না করলেও ৮০ থেকে ৯০ ভাগ পর্যন্ত একটি শিশুকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। এ ধরনের শিশুর জন্য বিশেষায়িত স্কুল আছে। সেখানে তাদের জন্য বিশেষ পাঠদানের ব্যবস্থা আছে। তবে এসব স্কুলে ভর্তির আগে অবশ্যই একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্টের পরামর্শ নিতে হবে। অটিস্টিক শিশুর লালন-পালনে মা-বাবাকে দিতে হয় সীমাহীন ধৈর্যের পরিচয়। কর্মজীবী মা-বাবার জন্য খুবই কষ্টের ব্যাপার এটা। অটিজমে আক্রান্ত একজন শিশুর মা-বাবা তাদের সন্তানের শিক্ষা এবং চিকিৎসার জন্য বদলি হয়ে ঢাকায় এসেছেন। কিন্তু তাদের কর্মক্ষেত্রে প্রতি তিন বছর পর পর বদলির নীতিমালা থাকায় সন্তানকে নিয়ে তারা খুবই সমস্যায় পড়ে গেছেন। যেহেতু এ ধরনের শিশুদের উন্নত শিক্ষা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা ঢাকাকেন্দ্রিক তাই যেসব কর্মজীবীদের সন্তান অটিস্টিক তাদের জন্য বদলির নীতিমালা নমনীয় করা উচিত। এ ধরনের শিশুর অভিভাবকদের জন্য সন্তানকে কর্মক্ষেত্রে রাখা, তার শিক্ষা এবং চিকিৎসার জন্য সময় এবং ছুটির ক্ষেত্রে নানা ধরনের সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ নেয়া এখন সময়ের দাবি। একজন কর্মকর্তা সায়লা (ছদ্মনাম)। প্রথম সন্তানের জন্মের এক বছর সাত মাসের মধ্যেই জানতে পারলেন সন্তান অটিজমে আক্রান্ত। সন্তান ধীরে ধীরে বড় হলো। সমস্যা আরও প্রকট হলো। তিন বছর যখন সন্তানের বয়স তখন সন্তানকে কেন্দ্র করেই ডিভোর্স হয়ে গেল স্বামীর সঙ্গে। সন্তানের পুরো দায় এসে পড়ল শায়লার ওপর। এ রকম অনেক সংসার আছে যেখানে মায়ের ওপর দায় চাপিয়ে বাবা নিজের জীবন বেছে নেন। বিজ্ঞানের কল্যাণে জীবন যত উন্নত হচ্ছে, সভ্যতা যত বিকশিত হচ্ছে, অটিজম ততই বাড়ছে। এটা শুধু বাংলাদেশেরই নয়, সারা বিশ্বের সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্রের অটিজম সোসাইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় এক শতাংশ অটিজম আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রায় দেড় লাখের মতো অটিজম আক্রান্ত মানুষ রয়েছে। প্রতি বছর এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে ১৫শ শিশু। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে গড়ে ১৭ জন অটিজমে আক্রান্ত। এ সমস্যা মোকাবিলা দেশের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার উস্তিতে শিরাখেলে ৫২ একর জমির ওপর একটি উপনগরী গড়ে তোলা হচ্ছে। এই উপনগরীতে অটিজম নিয়ে সুসংহত উন্নয়ন কর্মসূচি রূপায়নের কাজ হবে। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সুরেশ সোমানি ও রত্নাবলী গ্রম্নপের উদ্যোগে এটা তৈরি হচ্ছে। এই উপনগরীতে অটিজম শিশুদের থাকার ব্যবস্থা যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে এদের আগামী দিনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি। একই ছাতার তলায় থাকবে হাসপাতাল, স্কুল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সুরেশ সোমানির ছেলে অটিজমে আক্রান্ত। তাই তিনি অটিজম নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। ২০১১ সালের ২৫ জুলাই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বিশ্বের অটিজম আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে একটি ফলপ্রসূ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দেশে অটিজম আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি বৈশ্বিক অটিজম কর্মসূচিতে নেতৃত্বদানকারী মার্কিন সংস্থা 'অটিজম স্পিকসের সদস্য।' মূলত তার প্রচেষ্টায় দেশে অটিজম সচেতনতা ও জাগরণ তৈরি হয়। অটিজম নিয়েও পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়েছেন এমন অনেকেই আছেন। যেমন- লেসলি লেমকে যাকে তার নিজের মা বর্জন করেছিলেন। ১৬ বছর বয়সে শুরু করেন পিয়ানো বাজানো। ঈশ্বর প্রদত্ত প্রতিভা দিয়ে জয় করেন সারা বিশ্ব। অসাধারণ ছবি আঁকার প্রতিভা নিয়ে জন্মান স্টিফেন উইল্টশায়ার, সংগীত শিল্পী লেডি হাক, কার্টুন ছবির আবিষ্কারক সাতসি তাহেরি, বিজ্ঞানী আইজাক নিউটনসহ অসংখ্য বিখ্যাত ব্যক্তি অটিজমে আক্রান্ত ছিলেন। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিরও উন্নয়ন ঘটাতে হবে। অটিস্টিকদের প্রতি এবং তাদের মা-বাবার প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক এবং সহানুভূতিশীল করতে হবে। অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষা এবং চিকিৎসা শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক থাকলে চলবে না। সুষ্ঠু চিকিৎসা, শিক্ষা, থেরাপি- রাজধানী থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় ছড়িয়ে দিতে হবে। সহযোগিতা ও সহানুভূতির হাত প্রসারিত করতে হবে এসব পরিবারের প্রতি। বোঝা নয়, সম্পদ করে গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রের নিতে হবে সুদূরপ্রসারী কর্ম-পরিকল্পনা। সময়ের প্রয়োজনেই আমাদের অটিজম নিয়ে ভাবতে হবে। শাকিলা নাছরিন পাপিয়া: কবি, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক ও কলাম লেখক