বেলুচিস্তান সংকট ও পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ

বেলুচদের ভূমির প্রাকৃতিক সম্পদ দেশি-বিদেশিরা লুটে খাচ্ছে। বেলুচিস্তানের ভৌগোলিক সুবিধাজনক অবস্থানের ফসলও অন্যের ঘরে। বেলুচদের ভবিষ্যৎ একে-৪৭ ও এফ-১৬-এর নিচে! বেলুচিস্তানে বেলুচদের সার্বিক সহায়সম্পত্তি কমছে; বাড়ছে কেবল বিভিন্ন বাহিনীর স্থাপনা ও বাহিনীর বুটের আওয়াজ। এমতাবস্থায় এটি বলা যায় যে, শোষণ ও বঞ্চনা দিক দিয়ে বেলুচিস্তান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চেয়েও সব প্যারামিটারেই খারাপ।

প্রকাশ | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
এক সময়ের ব্রিটিশ শাসিত কালাত, খারন, মারখান ও লাসবেলা নিয়েই মূলত গঠিত বেলুচিস্তান। পাকিস্তানের চার প্রদেশের একটি বেলুচিস্তানের আগ্নেয়গিরির আগুন সেই সাতচলিস্নশ সাল থেকেই জ্বলছে! কালাত চুক্তির মাধ্যমে বেলুচিস্তানের শাসকরা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। চুক্তিতে কেবল প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি- ইসলামাবাদের হাতে থাকার কথা ছিল। বাকি বিষয়গুলো বেলুচিস্তানের শাসকদের ওপর ন্যস্ত রাখা হয়। আটচলিস্নশ সালে জিন্নাহর সঙ্গে বেলুচিস্তানের শাসকদের যে চুক্তি হয়, তা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মানেনি। পাকিস্তানি শাসকরা সেনাবাহিনী পাঠিয়ে আরও অঞ্চল দখল করে বেলুচিস্তান নামক প্রদেশটি তৈরি করে। বেলুচিস্তান প্রদেশটি পাকিস্তানের ৪০ ভাগ জায়গাজুড়ে অবস্থিত। এর জনসংখ্যা প্রায় দশ লাখ। বেলুচরা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার হারিয়ে ভুলের খেসারত দিচ্ছে। তবে পাকিস্তানি শাসকদের বিশ্বাসঘাতকতা বেলুচরা মানতে পারেনি। স্বাধীনচেতা বেলুচরা আটচলিস্নশ সালেই পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়। পরবর্তী সময়ে বহুবার বেলুচদের স্বাধীনতার সংগ্রাম দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে। তাতেও কোনো ফল আসেনি। বিশেষ করে, একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় বেলুচদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৭৩-এ তেজময় হয়ে ওঠে। বেলুচদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে অভীষ্ট লক্ষ্যে নেয়ার জন্য বেলুচদের একজন 'বঙ্গবন্ধু' খুবই অপরিহার্য। এখনও বেলুচদের মধ্যে কেউ বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি। পাকিস্তান অধু্যষিত বেলুচিস্তান ও ইরানের প্রদেশ সিসতানের সমস্যা এক নয়। উভয় অঞ্চলের মানুষের মিল এক জায়গায়- তারা বেলুচি এবং উভয় অঞ্চলেই উন্নয়ন হয়নি। এ কারণে তাদের ক্ষোভ রয়েছে। পাকিস্তান অধু্যষিত বেলুচিস্তানের স্থায়ী বাসিন্দা অর্থাৎ বেলুচিরা ক্রমেই সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে। অন্য প্রদেশ থেকে মানুষ এসে সেখানে বসবাস করছে। অন্যদিকে সিসতানের সমস্যাটা মূলত অনুন্নয়ন। বেলুচিস্তান নিয়ে সমস্যা মূলত দুটি। এক, আফগানিস্তানের পশতুনরা আর বেলুচিস্তানের পাঠানরা এক হয়ে ভবিষ্যতে একটি পশতু রাষ্ট্র গঠন করতে পারে। আফগানিস্তানে তালেবানদের যদি নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তাহলে একদিন এ অঞ্চলে জন্ম হবে তালেবানমুক্ত পশতু রাষ্ট্র। পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন থাকবে এব্যাপারে। দুই, ইরান ও পাকিস্তানের বেলুচিস্তান মিলে একটি গ্রেটার বেলুচিস্তান রাষ্ট্র গঠন করতে পারে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যদি কোনো ধরনের সহাবস্থান না হয়, তাহলে এই গ্রেটার বেলুচিস্তান রাষ্ট্রের ধারণা আরও শক্তিশালী হবে। পাকিস্তানে বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির কথা আগেই বলেছি। এ ছাড়া রয়েছে বেলুচিস্তান পিপলস ফ্রন্ট, যাদের নেতৃত্বে গ্রেটার বেলুচিস্তান আন্দোলন শুরু হতে পারে। বেলুচিস্তান পাকিস্তানের কাশ্মীরের মতো। এটি পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও আজ স্বাধীনতার ৭০ বছর পরও প্রদেশটি বিদ্রোহে ফুঁসে উঠছে। কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং ৭০ বছর আগে ভারতে যোগ দিলেও সেখানে সব সময়ই বিদ্রোহের আগুন ধিকিধিকি জ্বলেছে, যেটা কখনো কখনো স্ফুলিঙ্গে রূপ নেয়। তবে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু কথা দিয়েছিলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কাশ্মীরে গণভোট হবে। কিন্তু তিনি সে কথা রাখতে পারেননি। ২০০৩ সালে থেকে কয়েক বছর ধরে বেলুচরা আবারও স্বাধীনতার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আত্মনিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার জন্য বেলুচদের ন্যায্য সংগ্রাম তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। সেই সময়ে সামরিক শাসক পারভেজ মুশাররফ বেলুচদের স্বাধীনতার চেতনাকে নির্মূল করতে চেয়েছিলেন। বেলুচদের ওপর নেমে আসে মধ্যযুগীয় বর্বরতা। গুহার ভেতর থেকে ধরে বেলুচদের অবিসংবাদিত জাতীয় নেতা নবাব আকবর বুগতিকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। বুগতিকে হত্যার পর বেলুচদের স্বাধীনতার সংগ্রাম স্ফুলিঙ্গের মতো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। গত সাত দশক ধরে বেলুচরা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী দ্বারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মতো শোষিত হচ্ছে। সময়ের পরিক্রমায় বেলুচদের শোষণ করার জন্য নতুন নতুন ভূ-রাজনৈতিক হাতিয়ার পাকিস্তানি শাসকরা ব্যবহার করছে। যতবারই স্বাধীনতার জন্য মরিয়া হয়েছে ততবারই পাকিস্তানি সেনারা বেলুচদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী একাত্তরের শিক্ষাকে উচ্চতার চিহ্ন হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে বেলুচদের দমিয়ে রাখছে। বেলুচরা প্রায় দশবার পাকিস্তানের শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রতিবারই বেলুচ স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর নির্মম দমননীতি প্রয়োগ করেছে। খোদ পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থার হিসাবে, এখন পর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজার বেলুচিস্তানের মানুষ হারিয়ে গেছে। বিভিন্ন সংস্থার জরিপে দেখা যায়, গড়ে প্রায় প্রতিটি বেলুচ পরিবারের একজন করে মানুষ গুম হয়েছে। কেবল গ্রাউন্ডে সেনা পাঠিয়ে নয়, আকাশ থেকেও বেলুচ স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর হামলা করা হচ্ছে। পাকিস্তানের জাতীয় গ্যাস উৎপাদনের ১৭ শতাংশ আসে বেলুচিস্তান থেকে। বেলুচরা ব্যবহার করে মাত্র সাত শতাংশ। অপর দিকে পাঞ্জাব মাত্র জাতীয় গ্যাস উৎপাদনে চার শতাংশ অবদান রাখে; অথচ পাঞ্জাবিরা ব্যবহার করছে ৪৩ শতাংশ। বেলুচিস্তানের ৪০ শতাংশ মানুষ গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ পায়। অন্যদিকে পাঞ্জাবের ৯৭ শতাংশ মানুষ গ্যাস ব্যবহার করে। অনুরূপভাবে, প্রতিটি খাতে বেলুচদের শোষণ করা হচ্ছে। সারা দিনে বেলুচদের ঘণ্টাদুয়েক পানি দেয়া হয়। বেলুচদের পানি দেয়া হয় সিন্ধু প্রদেশে। বেলুচিস্তানের সেচ প্রকল্পগুলোরও একই রকম অবস্থা। অথচ পাকিস্তানের জাতীয় খাদ্যভান্ডারে বেলুচিস্তানের ভূমিকা অনেক। কয়েক দিন আগেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর 'হাতের পুতুল' খোদ বেলুচিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নবাব সানাউলস্নাহ খান জাহেরি বেলুচিস্তানের কৃষকদের সরকারি ঋণ না দেয়ার অভিযোগ আনেন। প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ থাকার পরও বেলুচিস্তানেই সবচেয়ে বেশি বেকারত্ব, দরিদ্রতা। প্রশাসনের উপরের স্তরে বেলুচদের সংখ্যা হাতেগোনা। এমনকি বেলুচিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল প্রকল্পগুলোতেও অন্যান্য প্রদেশ ও চীন থেকে লোক নিয়োগ করা হয়। শোষণ করার তারতম্যের প্যারামিটারের পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে বেলুচিস্তানের অবস্থা খুব খারাপ। এর পেছনে মূল কারণ বেলুচিস্তানের প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজসম্পদ। বেলুচদের ভূমির প্রাকৃতিক সম্পদ দেশি-বিদেশিরা লুটে খাচ্ছে। বেলুচিস্তানের ভৌগোলিক সুবিধাজনক অবস্থানের ফসলও অন্যের ঘরে। বেলুচদের ভবিষ্যৎ একে-৪৭ ও এফ-১৬-এর নিচে! বেলুচিস্তানে বেলুচদের সার্বিক সহায়সম্পত্তি কমছে; বাড়ছে কেবল বিভিন্ন বাহিনীর স্থাপনা ও বাহিনীর বুটের আওয়াজ। এমতাবস্থায় এটি বলা যায় যে, শোষণ ও বঞ্চনা দিক দিয়ে বেলুচিস্তান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চেয়েও সব প্যারামিটারেই খারাপ। বেলুচদের জাতীয় সম্পদের হরিলুটে কেবল পাকিস্তানের এলিট সম্প্রদায় জড়িত নয়, চীনের নব্য পুঁজিবাদীরাও এ দলে আছে। চীনের অর্থায়নে গুয়াদার সমুদ্রবন্দর বেলুচদের ভূমিতে নির্মাণ হলেও বেলুচদের এই বন্দরের শত্রম্ন হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, আমেরিকা ও ভারত গুয়াদার সমুদ্রবন্দরে চীনের অর্থায়নের পেছনে চীনের নৌঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনার অভিযোগ করে আসছে। পাকিস্তানের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও আমেরিকা বেলুচিস্তানের কোয়েটাতে একটি অফিস খোলার চেষ্টা করছে। চীন নৌঘাঁটি নির্মাণ করছে এমন ধারণা সাধারণ বেলুচদেরও। বেলুচিস্তানের স্বর্ণের খনিগুলোও অব্যবস্থাপনার মতো নানা অজুহাতে প্রাদেশিক সরকারকে নিষ্ক্রিয় করে পাকিস্তানের এলিট সম্প্রদায় হাতে নিয়েছে। চীনের কোম্পানিগুলো স্বর্ণ উত্তোলনের বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, বেলুচিস্তানের চাগাই জেলার রিকু ডিকের মতো ছোট শহরটিতেই প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলারের দামের স্বর্ণ ও তামা জাতীয় সম্পদ রয়েছে। একই জেলায় আরেকটি ছোট শহর সেইনডাকেও স্বর্ণ ও তামার মজুতের পরিমাণ শত বিলিয়ন ডলার মূল্যেরও বেশি। বেলুচের এই মূল্যবান সম্পদ আরোহণের দায়িত্বে রয়েছে চীনা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিগুলো। বেলুচিস্তানের ওপর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর ভয়াবহ নির্যাতন, নিপীড়ন ও শোষণের চিত্র বহির্বিশ্বের কাছে অনেকটাই অজানা। বহির্বিশ্বের দেশগুলো, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ বেলুচদের শোষিত হওয়ার খবর জানলেও কেউ দীর্ঘদিন তেমন মাথা ঘামায়নি। পুরো বিষয়টি দ্রম্নত পাল্টে যায় দুটি ঘটনার পর। আফগানিস্তানে মার্কিন নতুন কমান্ডার জেনারেল জন নিকোলসন নিয়োগ পান তিন মাস হতে চলল। এই তিন মাসে তিনি দুবার ভারত সফর করেন। চলতি মাসের ১০ তারিখে ভারত সফরে গিয়ে আফগানিস্তানে ভারতের সামরিক অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করেন। আফগানিস্তানে ভারতের কেবল সামরিক খাতে নয়, বেসামরিক খাতেও সহযোগিতা বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছে মার্কিন প্রশাসন। আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও ভারত সফরে এসে ভারতের বিনিয়োগকারীদের আফগানিস্তানের বিনিয়োগ করার আহ্বান জানান। ভারত ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে ২২০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানকে তাদের ভূমি থেকে জঙ্গিদের স্বর্গরাজ্য নিশ্চিহ্ন করার তাগিদ দিলেন জেনারেল জন, বিশেষ করে হাক্কানি নেটওয়ার্ককে নির্মূল করার। আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আশরাফ ঘানিও পাকিস্তানে সফর গিয়ে কীভাবে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে নির্মূল করা যায় তা ভাবার জন্য পাকিস্তানের সরকারকে অনুরোধ করলেন। আফগানিস্তানের অভিযোগ, আফগানিস্তানের বিগত কয়েক বছরের হামলায় পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের হাত রয়েছে। উলেস্নখ্য, আফগানিস্তানে ভারতের প্রাধান্যতা বৃদ্ধির কারণে আফগানিস্তানের প্রতি পাকিস্তান নাখোশ। দ্বিতীয়ত, মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার সামরিক সাহায্য দেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিলের ঘোষণাটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেবল সামরিক সহযোগিতাই বাতিল করেনি, পাকিস্তানকে শাসিয়ে দিয়েছে। জঙ্গিদের মদদ দেয়া বন্ধ না করলে পাকিস্তানের ওপর বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে এবং উত্তর কোরিয়ার মতো পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হবে এটি স্পষ্ট করেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ভারতের ভূ-রাজনৈতিক সচেতন কূটনৈতিক সমাজ একটি বিষয় ভালো করেই বুঝতে পেরেছে: পাকিস্তান ইচ্ছে করলেই ভারত-বিদ্বেষমূলক পররাষ্ট্রনীতি বাদ দিতে পারবে না। আর সেই বিদ্বেষপূর্ণ নীতিতে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো পাকিস্তান সামরিক শক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। যে সমাজে হাফিজ সাইদের মতো একজন জঙ্গি ও সন্ত্রাসীকে 'জাতীয় বীর' ঘোষণা করা হয়, সেই সমাজকে 'উত্তর কোরিয়া' হওয়া থেকে কেউ ফেরাতে পারে না। যে সমাজে অ্যাকটিভ ট্যাঙ্ক থিংকিং ট্যাঙ্কের ভূমিকা পালন করে, সেই সমাজের উত্তর কোরিয়া হওয়ার স্বাভাবিক পদ্ধতি রোধ করা যাবে না। ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তান ও ইরানের গভীর সম্পর্কটিও বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামী জনগণের পক্ষ নেয়া মোদির সিদ্ধান্তে ভূমিকা রাখে। আফগানিস্তান দেশটির নিরাপত্তাকে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনতে হিমশিম খাচ্ছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক দর্শন যে জঙ্গিপন্থি, সেটি আফগানিস্তানের প্রতিটি নাগরিক (জঙ্গিরা ছাড়া) ভালো করেই বোঝে। পাকিস্তান যদি ক্রমশ আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যদি একেবারেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে, আফগানিস্তানের ভারত নির্ভরশীলতা বাড়বে বরং কমবে না। অন্যদিকে, ভারত যদি মোদির বেলুচিস্তান নীতি বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হয় তাতে ইরানেরও সুবিধা হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ইরান নিজের দখলকৃত বেলুচিস্তানের অংশের নিশ্চয়তা নিয়ে চিন্তা করবে। তা ছাড়া পাকিস্তান থেকে বেলুচিস্তান সরে গেলে ইরান খুশিই হবে। ইরানের চিরশত্রম্ন সৌদির ওহাবিজম আদর্শের রাজনৈতিক গবেষণার 'হ্যাচারি' পাকিস্তান দুর্বল হয়ে পড়লে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদির ক্ষমতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। মোদি বেলুচিস্তান নীতি কেবল নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ ফ্যাক্টরগুলোর ওপর নির্ভর করে নেননি। পরিবর্তনশীল বিশ্বের ভারতবান্ধব ভূ-রাজনৈতিক নতুন নতুন প্রেক্ষাপট মোদিকে অনুপ্রাণিত করেছে। যে পরিবর্তনশীল বিশ্বে পাকিস্তানের জন্য স্থান ক্রমশই সংকোচনশীল হয়ে পড়ছে। এমতাবস্থায় মোদির বেলুচিস্তান নীতির ভবিষ্যৎ একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় কি? নরেন্দ্র মোদি ভারতের ক্ষমতায় আসার পরপরই বেলুচরা কিছুটা আশান্বিত হয়েছিল। কিন্তু গত দুবছর মোদি বেলুচিস্তানের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট অবস্থান নেননি। বরং মোদি আঞ্চলিক শান্তির স্বার্থে জম্মু-কাশ্মীরের সমস্যাটিকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি পর্যায়ে নিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। গত দুবছরে মোদি তিনবার জম্মু-কাশ্মীর সফর করলেন। ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রীরই পুরো এক টার্মে তিনবার কাশ্মীর সফরের রেকর্ড নেই। মোদি সরকার দুটি বছর নানা ফোরামে জম্মু-কাশ্মীরে পাকিস্তানের মদদে সন্ত্রাসের বিষয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যান। সেইসব আলোচনায় ভারত পাকিস্তানের কাছ থেকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সমর্থিত কোনো ধরনের জঙ্গি কর্মকান্ড যেন ভারতে না ঘটে সেই নিশ্চয়তা চেয়েছিল। তবে পাকিস্তান কেবল জম্মু-কাশ্মীর ছাড়া ভারতের অন্যান্য প্রদেশের নিশ্চয়তা দিয়েছিল। জম্মু-কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গিদের পাকিস্তান অনেকটা প্রকাশ্যেই সমর্থন দিচ্ছে। পাকিস্তান এখনও মনে করে জম্মু-কাশ্মীর একটি অমীমাংসিত বিষয়। বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামী জনগণকে সমর্থন দেয়ার চাপটি ক্ষমতায় আসার পরপরই মোদির ওপর ছিল। কিন্তু মোদি আমলে নেননি। মোদি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে এড়িয়ে দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সব চেষ্টাই করেন। বর্তমানে মোদি সরকার হিন্দুত্ববাদের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে কোনো কিছুতেই তিনি হিন্দুত্ববাদের প্রশ্নে তিনি নতজানু বা আপসকামী হবেন না। মোদি ভারতের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বেলুচিস্তান, পাকিস্তান-দখলকৃত কাশ্মীর ও গিলকিটে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নির্মমনীতির সমালোচনা পথ বেছে নেন। একই সঙ্গে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামী জনগণের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন। বলা যায়, ভারত এখন বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার জন্য কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নেহরু বুঝতে পেরেছিলেন, সবকিছু স্স্নোগানে পর্যবসিত হবে। আর মানুষ এতটা ধর্মীয় আবেগ দ্বারা পরিচালিত হবে যে, তারা নিজেদের বিশেষ অধিকার প্রয়োগ করবে না। যখন শেখ আবদুলস্নাহ ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেন, তখন তিনি মনে করেছিলেন জনপ্রিয় রায় পেয়ে গেছেন, যেটা গণভোটের সমতুল্য। ফলে এই যোগদান সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। আসলে উরিতে যা হয়েছে তা রোগ নয়, লক্ষণ। রোগটা হচ্ছে এই, যে তরুণরা এখন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারা নিজেদের দেশ চায়। একইভাবে, বেলুচিস্তান পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন দেশ হতে চায়। সেটা যদি হয়, তাহলে ভারতের সীমান্তে আরও একটি মুসলিম দেশের জন্ম হবে। পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কিভাবে তার পাকিস্তান নীতিকে ঢেলে সাজাচ্ছেন সেটা বিশ্ববাসী পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি কি ভারত বিদ্বেষী মনোভাবে চাঙ্গা নাকি শান্তি সমঝোতায় বিশ্বাসী। পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নওয়াব শরীফ অনেকটা নমনীয়তার পরিচয় দিয়েছিলেন। যার মাধ্যমে এতদঞ্চলে পাকিস্তান-ভারত বিরোধিতার মধ্যে শান্তির আভাস পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পাকিস্তান সরকার নিঃসন্দেহে সেনা সমর্থিত সরকার তবে জঙ্গি সমর্থিত কি না তা সময়ই বলে দিবে। ইমরান খানের অনমনীয়তায় বেলুচ সমস্যা বিষয়ে বিচ্ছিন্নবাদীদের বিপক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়ে থাকেন তাহলে ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কে অবনতি ঘটবে। এমনকি পাকিস্তান বিশ্বে এক সংকোচিত পরিস্থিতির সম্মুখীনও হয়ে যেতে পারে। ইমরান খান পাকিস্তানের মাটিতে জঙ্গিবাদবান্ধব সমর্থিত হলে পৃথিবীর বুকে তিনি হিটলার বা মুসোলিনির মতো কুখ্যাত বীরের তকমা পেতে পারেন। ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ: কলাম লেখক, ও গবেষক