'কিশোর গ্যাং' দেশের জন্য হুমকি

প্রকাশ | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
কিশোর গ্যাং শব্দটি আমাদের সমাজে খুব বেশিদিনের নয়। এটি মূলত কিশোরদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার একটি প্রবণতা। গ্যাং বলতে আমরা জানি একাধিক জনের একটি দল, যা বর্তমানে নেতিবাচক কর্মকান্ডকে নির্দেশ করে। কিশোর গ্যাং অনেকটা সে রকম। এসব গ্যাং তৈরি হয় বিপথে যাওয়া কিশোরদের মাধ্যমে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব কিশোররা নিজেদের কার্যকলাপ শেয়ার করে। এসব কিশোরদের মধ্যে এ সময় হিরোইজম তৈরি হয়। প্রথম দিকে অপরাধের সঙ্গে সঙ্গে হাতে মাদকও উঠে আসে। এলাকার আধিপত্য নিয়েও এক ধরনের অহমিকা কাজ করে এদের ভেতর। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা নিজেদের এলাকায় নিজেরাই রাজা। রাতে স্পিডে মোটরসাইকেল রেস, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, ছিনতাই বা চাঁদাবাজিও এদের অন্যতম কাজ। এরপর একসময় মাদক বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ে এসব কিশোররা। এছাড়া এক এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে অন্য এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সব সময়ই দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। দ্বন্দ্ব থেকে প্রায়ই হুমকি-ধমকি ও শারীরিক আঘাতের মতো ঘটনা ঘটে থাকে। প্রকাশ্যে ফেসবুকে ঘোষণা দিয়েই একদল আরেক দলের ওপর হামলা চালায়। এতে খুন-খারাবির মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। সম্মানিত ও বয়োজ্যেষ্ঠদের তাদের কাছে কোনো মূল্যই নেই, তাদের কোনো তোয়াক্কাই করে না এসব কিশোর গ্যাং। এদের পরনে বেশিরভাগ টি-শার্ট, চোখে সানগস্নাস। চুলে নিত্যনতুন অভিনব স্টাইল। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানে। গান গায় উচ্চৈঃস্বরে। পর্দার আড়ালের গ্যাং লিডার বড় ভাইরূপী গডফাদাররা এদের 'দেখভাল' করে। বড় ভাইরা তাদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে এদের ব্যবহার করে। অথচ যেখানে এই বয়সে কিশোরদের চোখে থাকার কথা দেশকে ভালোবাসার স্বপ্ন, নিজেকে যোগ্যতর করে গড়ে তোলার স্বপ্ন সেই কিশোরদের চোখে আজ হিংসার আগুন। তাদের হাতে কলমের পরিবর্তে চাপাতি, রামদা, ছুরিসহ বিভিন্ন অস্ত্র। তাদের মুখে মাদকের নেশা। তাদের কাজ ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জমিদখল, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, ধর্ষণ এমনকি হত্যা। পত্রপত্রিকায় বা টেলিভিশনে এদের গ্রেপ্তারের খবর মাঝেমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি। আশঙ্কার বিষয় হলো এই ধরনের চক্র ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের মাথাব্যথার কারণ এখানেই। এসব কিশোররা সমাজ নির্মাণের কারিগর হতে পারত। অথচ আজ তাদের আচরণ বা তাদের চলন দেখলে মনে প্রশ্ন জাগে আমাদের এ কিশোর প্রজন্ম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। যদিও কয়েকটি গ্রম্নপ বা কয়েকজন কিশোর-কিশোরী নিয়ে সামগ্রিক বিচার করা ঠিক না তবে এদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে যে একসময় আমাদের বড় সংকটে পড়তে হবে না তার নিশ্চয়তা নেই। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি সামান্য কথা কাটাকাটির জেদ ধরে নৃশংসভাবে খুন হয় চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র আদনান ইসমাইল। এছাড়া, বাড়ির সামনে থেকে ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত হত্যা, ঝাউতালা বাজারে সোহেল হত্যা এবং সর্বশেষ নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া চট্টগ্রামের এমইএস কলেজের সানি হত্যাকান্ডও কিশোরদের মাধ্যমে ঘটেছে। চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলার চিত্র এমনটাই। এরকম ঘটনা এখন আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত ঘটছে। সারাদেশে কিশোর অপরাধ নিয়ে এখন আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এদের সংশোধনের উপায় নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। যে ভুল পথে এরা এগিয়ে চলেছে তা যে অন্ধকার তা তাদের মস্তিষ্কে ঢোকাতে হবে। যে পথের না আছে কোনো শুভ সমাপ্তি। যে পথে রয়েছে পদে পদে অনিশ্চয়তা, সেখানে এসব কিশোরকে দেখলে মনে হয় এরা অপার শান্তি পায়। তাদের এই বোধ কেন হলো। কোনো নিঃসঙ্গতার জালে পড়ে এসব পথে তরুণরা পা বাড়চ্ছে সেটাও ভাবার বিষয়। শিশু-কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর। তাদের এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। যেখানে এসব ছেলের হাতে থাকার কথা বই। এদের কালচার হবে একাডেমিক। রাস্তায় কুপিয়ে মানুষ মারতে এদের হাত কাঁপে না। অথচ ওদের হাতেই দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব ছিল। তবে এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা বেশিরভাগ, ভেঙে যাওয়া পরিবারের সন্তান যারা ছোটবেলা থেকেই একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে শৈশবকালীন সময় পার করেছে, পথশিশু যারা সমাজে সর্বদাই অবহেলিত এবং আনন্দের কোনো উপলক্ষ পায়নি এবং সেই সব কিশোর যারা প্রযুক্তিকে নেতিবাচক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। এসব ছাড়া আরও কারণ রয়েছে কিশোরদের বিপথগামী হওয়ার। এসব কিশোরকে সংশোধন করা জরুরি। কেবল শাস্তি দিয়েই সমস্যার সমাধান করা যায় না। বিশ্লেষকদের মতে, দরিদ্রতা, খেলাধুলার অভাব, পারিবারিক মনিটরিংয়ের অভাবে ছেলেরা এই বিপথে হাঁটছে। তাই এটা নিয়ে রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। কিশোর গ্যাংয়ের কারণে সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। পিতামাতারা সন্তানদের নিয়ে রয়েছেন চিন্তিত। এই বুঝি সন্তান কোনো দলের সঙ্গে জড়িয়ে গেল। তবে আমি মনে করি পিতা-মাতা ও অভিভাবকরা চাইলেই নিজেদের সন্তানকে এসব থেকে দূরে রাখতে পারেন। এজন্য অবশ্যই নিজের কিশোর বয়সের সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলাভাবে মিশতে হবে। বুঝতে হবে সন্তান কি চায়! অবশ্যই সন্তানের সব অন্যায্য চাহিদা পূরণ নয় বরং যেটা দরকারি সেটাকেই পূরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে কিশোররা আমাদেরই দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। এদের সুপথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের সবার। পরিশেষে বলতে চাই একটি দেশের ভবিষ্যৎ এবং সম্পদ এই কিশোররাই। তাই তাদের বিপথগামী থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব আপনার আমার আমাদের সবার। এসব কিশোররা কারও ভাই, কারও ছেলে, কারও বন্ধু। তাই আমাদের উচিত তাদের সচেতন করা এবং এসবের কুফল বর্ণনা করা। সচেতনতাই পারে আমাদের রক্ষা করতে। আজহার মাহমুদ খুলশী-১, চট্টগ্রাম