বঙ্গবন্ধুর বাকশাল কর্মসূচি সমাজ পরিবর্তনে আজও শ্রেষ্ঠ দার্শনিক মতবাদ

দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতির, দুর্ভাগ্য আমাদের তার গৃহীত কর্মসূচি গ্রহণের মাত্র কয়েক মাসের মাথায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তার দর্শন ও অবদানকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছিল, আজ প্রমাণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর দর্শনের মৃতু্য নেই, আদর্শের মৃতু্য নেই। তার দর্শন আজও বাঙালির মুক্তির পথের দিশারি ও আলোকবর্তিকা হয়ে রয়েছে।

প্রকাশ | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

ডা. এস এ মালেক
মাসব্যাপী জাতীয় শোক দিবসের সমাপনী দিবসে গণভবনে ছাত্রলীগ আয়োজিত সমাবেশে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা যে বক্তব্য রেখেছেন, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপস্নবের কর্মসূচির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে প্রতীয়মান হয় যে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ থেকে তিনি বিন্দুমাত্র বিচু্যত হননি। যাদের উদ্দেশ্যে তিনি এই কথা বলেছেন, অর্থাৎ দেশের সচেতন, শিক্ষিত, যুবসমাজ (ছাত্রলীগ), তারাই জাতির ভবিষ্যৎ নাগরিক। তারা যদি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে তাদের ব্যক্তিজীবনে ও জাতীয় জীবনে তা প্রয়োগ করার চেষ্টা করেন, তা হলেই তারা সোনার মানুষ বলে পরিচিত হবেন ও সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সফলকাম হবেন। অনেক সময় অনেকে বলে থাকেন, বাংলাদেশের নেতৃত্বের সংকট এখনো বিদ্যমান। তাই বিশেষ বিশেষ জনকে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে জাতীয় নেতৃত্ব দেয়ার আহ্বান জানান। মনে হয় যেন, দেশের সংকটের মূল কারণ নেতৃত্ব। বাংলাদেশে বহু সংকট আছে। দেশটাও সংকটের সমাধানে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক সংকটের সমাধান ইতোমধ্যেই হয়েছে। বাকিগুলোর সমাধান অদূর ভবিষ্যতে হবে। তবে নেতৃত্বের সংকট এখনো বিরাজমান, এই কথার সঙ্গে আমি একমত নই। ১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জননেত্রী শেখ হাসিনার আগমনের পর থেকেই স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সংগ্রামে-আন্দোলনে কখনো সরকারি দলে ও কখনো বিরোধী দলে থেকে শেখ হাসিনা যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন ও তার নেতৃত্ব যেভাবে দেশ এগিয়ে চলেছে, তাতে বলা যায় নেতৃত্বের সংকট আছে বলে মনে হয় না। অবশ্য যারা স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধিতা করে আসছে, ৭৫-এর প্রতি বিপস্নব এরপর ক্ষমতা দখল করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারা বিপরীতে দেশে মহাসংকট সৃষ্টি করেছিল এবং এখন দেশের অগ্রযাত্রার পথে বাধা সৃষ্টি করছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যারা বিশ্বাসী নন, পতাকা ও জাতীয়সংগীত যাদের হৃদয়ে উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করে না, তারা তো বলতেই পারেন নেতৃত্বের সংকটের কথা। সদ্য প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকে নিবন্ধে অধ্যাপক ড. এমাজ উদ্দিন আহমেদ যে হাস্যকর উক্তি করেছেন, ইতিহাসের এক ক্রান্তিকালে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেছিলেন। জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনে, সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়োজনে, তার মতে তখন নাকি ঐতিহাসিক প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, জাতীয় ঐক্যের। আমি ড. এমাজ উদ্দিনের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই, যে ব্যক্তি পর্দার অন্তরালে থেকে, বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করে, স্বাধীনতার পক্ষের দলকে ক্ষমতাচু্যত করে, স্বৈরাচারী কায়দায় অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে, প্রহসনের মাধ্যমে নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতায় আহরণ এবং অন্যায়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের হত্যা ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতাকে চির স্থায়ী করার পথ প্রশস্ত করলেন জেনারেল জিয়া, এতেই প্রমাণিত হয় যে, জেনারেল জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি ছিলেন না। তাছাড়া সুদীর্ঘ স্বাধীনতা-সংগ্রামের কোনো পর্যায়েই যার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না; সেই জেনারেল জিয়ার জাতীয় ঐক্যের আহ্বানে কোনো নৈতিক দায়িত্ব ছিল কি? স্বৈরশাসক জিয়ার সব কর্মকান্ডেই ছিল হত্যা, কু্য ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে নিমজ্জিত। বঙ্গবন্ধু বারবার জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে সফলতার সঙ্গে সংগ্রাম ও যুদ্ধ চালিয়ে যিনি সর্বাত্মকভাবে ঐক্যভিত্তিক স্বাধীনতা অর্জন করেছিলেন ও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য আহ্বান জানান ও এর জন্য সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিপস্নবের কর্মসূচি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতির দুশমন ও স্বাধীনতার শত্রম্নরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেন। এই নির্মম হত্যাকান্ড সম্পর্কে ড. এমাজউদ্দিন সাহেবের মতো শিক্ষাবিদদের কোনোরূপ অনুশোচনা বা দুঃখবোধ রেখাপাত করে না। বিএনপির ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দলের মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরও জনসভার বক্তব্যে ড. এমাজউদ্দিনের ভাষায় কথা বলতে শোনা গেছে। আসলে প্রকৃতপক্ষে এরা সবাই জ্ঞানপাপী। তা না হলে এরকম মিথ্যাচার করতে পারেন। শেখ হাসিনা সুদীর্ঘ ৩৮ বছর সংগ্রামের মাধ্যমে কখনো বিজয় অর্জন, কখনো পরাজয়ের সম্মুখীন হয়ে, যে কোনো অবস্থাতেই তার মন সবসময় তার পিতার আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র সরে যায়নি। আজও সেই আদর্শ বাস্তবায়নে তিনি কাজ করছেন। তার জীবনসংগ্রাম প্রমাণ করে তিনি পিতার মতো দেশকে গভীরভাবে ভালোবাসেন এবং দেশের মানুষের প্রয়োজনে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে তিনি প্রস্তুত আছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার জীবন সংগ্রামে বিভিন্নপর্যায়ে শত প্রতিকূলতা ও বিরোধিতার সম্মুখীন হলেও তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র সরে দাঁড়াননি। জীবন দিয়েছেন কিন্তু আদর্শের প্রতি অবিচল ছিলেন। সেই কারণে তার আদর্শকে ধারণ করে তার সুযোগ্য কন্যা, বাংলার দুঃখী মানুষের নেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ দ্রম্নত এগিয়ে চলেছে। শেখ হাসিনা তার পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে চান। আর ওই অসমাপ্ত কাজটা কি? বাংলার মানুষের মুক্তি। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি। ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, বৈষম্যহীন, শোষণহীন, ন্যায়ভিত্তিক ও সমতাভিত্তিক একটি আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল বঙ্গবন্ধুর দর্শনের মূল কথা। চিরদিনের জন্য শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। তিনি ভালো করেই জানেন আদর্শের কারণে বিশ্বের কোনো নেতা-নেত্রীর কাছে আবেদন-নিবেদনের প্রয়োজন পড়ে না। কেননা তার পিতা বলেছিলেন কোনো বিদেশি দর্শন ধার করে নয়, বাংলার জনগণের জন্য যে দর্শন প্রয়োজন, তাই তিনি অনুসরণ করে যাবেন। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে ৩ বছর পর একটা পর্যায়ে দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে তার মনে হয়েছিল দেশের মানুষকে মুক্ত করতে হলে বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন। নিজস্ব দলের কাঠামোগত পরিবর্তন করে কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের সহায়ক শক্তি হিসেবে দাঁড় করার জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে পরিবর্তন করে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ অর্থাৎ বাকশাল গঠন করেন। শুরু হয় জাতি গঠনের কাজ। বাকশালের যে নীতিমালা গ্রহণ করেছিলেন, তা ছিল এ দেশের ঔপনিবেশিক, আধা ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদের শোষণের হাত থেকে মানুষের চিরতরে অবসান করার পদক্ষেপ ও আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলা। বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেছিলেন আইন মেনেই। মহান জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপনের মাধ্যমে ও সংবিধান সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তেই বিলটি পাস হয়। যারা জ্ঞানপাপী তারা ভুল বুঝেই অহেতুক বাকশালের সমালোচনা করেন। বাকশাল ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির সোপান। এই কর্মসূচি বঙ্গবন্ধু বাস্তবায়ন করতে পারলে ১০ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরিত হতো। দেশরত্ন শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় দ্বিতীয় বিপস্নবের যে কর্মসূচির ব্যাখ্যা দিয়েছেন, এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল কর্মসূচি। ঘাতকের আঘাতে প্রাণ বিসর্জিত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু তার দর্শন বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা সেই দর্শন বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়েছেন। তার ওপর জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। একমাত্র তিনিই এই দর্শন বাস্তাবায়ন করতে পারেন। তাই যুবসমাজের উদ্দেশ্যে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তারা যদি প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্য পালন করে কাজ করে যান, তবে তা হবে দেশের জন্য মঙ্গলজনক। বঙ্গবন্ধু কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা শ্রেণির কাছে স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব দিতে চাননি। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কাছে সম্পদ তুলে দেয়ার কথা কখনো চিন্তা করেননি। তার লক্ষ্য ছিল সব শ্রেণির মানুষ উন্নয়ন ও অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাক। বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ বিভিন্নভাবে শোষণ-বঞ্চনার স্বীকার হয়ে থাকে। তারা সত্যিকার অর্থে মুক্তি পাক। তাদের জন্য বঙ্গবন্ধু সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। এর জন্যই এসেছে মহান স্বাধীনতা। সেই স্বাধীন দেশে মানুষ শোষিত হোক, নিষ্পেষিত হোক, বঞ্চনার স্বীকার হোক তিনি সেটা কখনো চাননি। দেশ স্বাধীনের ফলে যারা বৃত্তবান ও ধনী হয়েছেন, তাদের নিজেদেরই প্রয়োজনে সম্পদ কুক্ষিগত করতে চেয়েছিলেন, সেই কারণেই বঙ্গবন্ধু কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষ যাতে আবার স্বাধীন দেশে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে, তা কখনো মেনে নিতে চাননি। তবে এ কথা ঠিক সেদিনের বাস্তবতা থেকে দেশ আজ অনেক এগিয়ে। বিশ্ব বাস্তবতার পরিবর্তন এসেছে। শিল্পায়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার ও বৈজ্ঞানিক নবনব আবিষ্কারের মাধ্যমে সমাজ যে গুণগত পরিবর্তন এসেছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের স্বার্থ সমন্বিত রেখে বৈষম্য দূরীকরণে কাজ করে যাচ্ছেন। ঠিক বঙ্গবন্ধু যে কাজটি করতে চেয়েছিলেন, ঠিক একইভাবে সেই একই পথে কাজ করা সম্ভব নয়। বাস্তবতার কারণে কৌশলগত পরিবর্তন প্রয়োজন। একে কেউ ভুল বুঝে শেখ হাসিনা সঠিক পথে যাচ্ছেন না বলে ভুল বোঝেন, তা হবে দেশের জন্য অমঙ্গলজনক। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা রেখে তার সঙ্গে কাজ করাই হবে বর্তমানের রাজনীতির পথচলা। আশাকরি ছাত্রলীগের সভায় প্রধানমন্ত্রী যে দিকনির্দেশনামূলক ও জাতিগঠনের আহ্বান জানিয়েছেন, তা ছাত্রসমাজ বুকে ধারণ করে দেশ গঠনে অবদান রাখবে সেই প্রত্যাশা সবার। পরিশেষে এই কথা বলেই আমার লেখার ইতি টানতে চাই যে, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপস্নবের কর্মসূচি বাকশাল প্রতিষ্ঠা ছিল সমসাময়িক বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক মতবাদ। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সংমিশ্রণে এই রাজনৈতিক দর্শন যদি বঙ্গবন্ধু বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হতেন, তা হলে তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হতেন যে, বঙ্গবন্ধুর বাকশাল ছিল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মতবাদ। দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতির, দুর্ভাগ্য আমাদের তার গৃহীত কর্মসূচি গ্রহণের মাত্র কয়েক মাসের মাথায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তার দর্শন ও অবদানকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছিল, আজ প্রমাণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর দর্শনের মৃতু্য নেই, আদর্শের মৃতু্য নেই। তার দর্শন আজও বাঙালির মুক্তির পথের দিশারি ও আলোকবর্তিকা হয়ে রয়েছে। ডা. এস এ মালেক: রাজনীতিক ও কলাম লেখক