রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কোথায়?

মনে রাখতে হবে, এটা আমাদের জাতীয় সমস্যা। সব রাজনৈতিক দলকেও এটা নিয়ে রাজনীতি না করে দেশের মঙ্গলের জন্য সরকারের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করতে হবে। এভাবে বছরের পর বছর বাংলাদেশে তাদের অবস্থান দেশের জন্য কখনো মঙ্গলকর হবে না, এটা সবাইকে অনুধাবন করতে হবে।

প্রকাশ | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

আজহার মাহমুদ
বর্তমান বাংলাদেশের যে সমস্যাটি সবচে বেশি মাথাচড়া দিয়ে উঠেছে, সেটা হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। এ প্রক্রিয়া এখন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। ১৯৭০ সাল থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আগমন। তখন থেকেই শরণার্থীর নাম দিয়ে এ দেশে রোহিঙ্গারা বসবাস করে আসছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়েছে বলে বিভিন্ন সরকারি সূত্রে জানা গেছে। সেই ৫ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে বর্তমানে আরও ১১ লাখের অধিক রোহিঙ্গা যোগ হয়েছে বাংলাদেশে। তারা কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করছে। এখনও তাদের আসা থেমে নেই। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর ও মিয়ানমার সরকার বৈঠকের পর বৈঠক করছে। আট হাজারের অধিক রোহিঙ্গা পরিবারের একটি তালিকা বাংলাদেশের পক্ষে হস্তান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে টেকনাফে গেলে দেখতে পাবেন হাজার হাজার দেশি-বিদেশি এনজিওর কর্মকর্তারা গাড়ি নিয়ে সকালে প্রবেশ করে এবং সন্ধ্যায় সেখান থেকে বের হয়ে আসে। তাদের এই অতি আগ্রহ আমাদের জন্য চিন্তার বিষয়ও বটে। পৃথিবীর নানা দেশের অনেকগুলো এনজিও এখানে তাদের নিয়ে পুনর্বাসনের কথা বললেও তাদের আচরণে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সাহায্য ও সহযোগিতার প্রলোভন দেখিয়ে কতিপয় গড়ফাদাররা ক্যাম্পে ক্যাম্পে রোহিঙ্গা যুবকদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে ফেলছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ ধ্বংস করতে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী তৎপর। রোহিঙ্গা যুবকদের প্রশিক্ষণের নামে সন্ত্রাসী হিসেবে তৈরি করার কথা শোনা যাচ্ছে। ক্যাম্পের বাইরে অনেক রোহিঙ্গা যুবক সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। অনেকে আশ্রয় ক্যাম্প ত্যাগ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে ওই এলাকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন পরিবেশ হুমকির মধ্যে। গাছপালা, পাহাড়, টিলা, ভূমি কর্তন করে বেড়ে উঠেছে রোহিঙ্গাদের অবস্থান। আর তাদের এই অবস্থানে হাজার হাজার একর পাহাড় গাছগাছালি ধ্বংস, পশুপাখির বিচরণ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয় কর্মক্ষেত্রগুলোও এখন তাদের দখলে চলে যাচ্ছে। মিল-কারাখানায় রোহিঙ্গারা ঢুকে পড়ছে। ক্যাম্প ও ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গারা অনেকেই এখন ছোটখাটো ব্যবসা চালাচ্ছে। তাদের জন্য কক্সবাজার-টেকনাফের পরিবেশ ক্রমেই ভারি হচ্ছে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প হচ্ছে ক্ষতির সম্মুখীন। যা অদূর ভবিষ্যতে আমাদের অর্থনীতিতেও আঘাত হানবে। দিন দিন কক্সবাজার, টেকনাফ এলাকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিবেশ নষ্ট হতে চলছে। ২০১২ সালে রামু সহিংসতায়ও রোহিঙ্গারা জড়িত ছিল বলে গোপন সূত্রে জানা যায়। কিন্তু এতকিছুর পরও একটি মহল তাদের বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে রেখে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। এটা যে বাংলাদেশের ভূখন্ডের জন্য কতটা হুমকি তৈরি করছে সেটা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। ১৭ কোটির অধিক জনবহুলের বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের চাপ আর কতদিন নিতে পারবে, বলা কঠিন। তবে তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া যে বিলম্বিত ও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে সেটা এখন আলোর মতো পরিষ্কার। রোহিঙ্গারা তাদের জন্মভূমিতে নাগরিক অধিকার, কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসন সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ফিরতে চায়। এর ব্যতিক্রম ঘটলে সেখানে তারা যেতে চায় না। মিয়ানমার সরকারের নীতিনির্ধারণী চিন্তায় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ চায় সুষ্ঠু ও সুন্দর ব্যবস্থাপনায় নাগরিক মর্যাদায় তাদের পূর্ণ অধিকার দিয়ে ফেরত নেয়া হোক। বাংলাদেশের নাগরিক ও সরকারের সেটাই কাম্য। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার চায় যত দ্রম্নত সম্ভব তাদের প্রত্যাবাসন করতে। মিয়ানমার সরকারের নানা নিয়ম ও বিধি প্রক্রিয়ায় এ চেষ্টায় বারবার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘসহ পৃথিবীর নানা দেশের অব্যাহত চাপকেও মিয়ানমার সরকার তেমন তোয়াক্কা করছে না। এই বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মমতার হাত থেকে রক্ষা করতে মানবিক কারণে মমতাময়ী মায়ের ভূমিকায় আবতীর্ণ হয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে বিশ্ব দরবারে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন এই মমতাময়ী নেত্রী। যেহেতু এ দেশের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে সেহেতু এই রোহিঙ্গাদের অধিক সময় এখানে আশ্রয় দেয়া সম্ভবপর হবে বলে আমার মনে হয় না। বাংলাদেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান আর শিক্ষার সুযোগ থেকে যেখানে অনেক নাগরিক এখনও বঞ্চিত সেখানে ভিনদেশি নাগরিকের ভরণপোষণ এ দেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। ফলে তাদের সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ বিষয়ে চীন এবং ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা অতীব জরুরি। পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য শক্তিশালী দেশগুলোকেও এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশের যে কোনো অঞ্চলে তাদের পুনর্বাসনের আমি বিরোধী। এমনিতেই তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঢুকে যাচ্ছে। দেশের নাগরিকত্বের পরিচয় বহন করে বিদেশেও বাংলাদেশি পরিচয়ে বৈধ-অবৈধ পথে পাড়ি জমাচ্ছে। এসব কর্মকান্ড অবশ্যই স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের জন্য মহাবিপদ ডেকে আনছে। পৃথিবীর যে কোনো দেশে তারা বাংলাদেশ থেকে গিয়ে দেশের সুনাম নষ্ট করার সংবাদ পাওয়া যায়। আশ্রয় দেয়া এলাকাগুলোতে বাংলাদেশি প্রকৃত নাগরিকরা রোহিঙ্গাদের অনৈতিক কর্মকান্ডের ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে। কফি আনানের রিপোর্টের ভিত্তিতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তাদের দ্রম্নত ফেরত পাঠাতে ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এটা আমাদের জাতীয় সমস্যা। সব রাজনৈতিক দলকেও এটা নিয়ে রাজনীতি না করে দেশের মঙ্গলের জন্য সরকারের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করতে হবে। এভাবে বছরের পর বছর বাংলাদেশে তাদের অবস্থান দেশের জন্য কখনো মঙ্গলকর হবে না, এটা সবাইকে অনুধাবন করতে হবে। আজহার মাহমুদ: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট