বৃক্ষের সঙ্গে নির্মম আচরণ বিপদের মুখোমুখি প্রাণিকুল

প্রকাশ | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
গাছপালা কমে যাওয়ার কারণে একদিকে প্রকৃতিতে ক্রমেই বৃষ্টিপাত কমছে, অন্যদিকে উষ্ণতর হচ্ছে পৃথিবীপৃষ্ঠ, দেখা যাচ্ছে জলবায়ুর অসম পরিবর্তন, ঋতু আবর্তনে গড়মিল হচ্ছে, বাড়ছে সূর্যরশ্মির তীব্রতা, গ্রিন হাউস ইফেক্ট বাড়ছে। এভাবেই পৃথিবীকে নানান আঙ্গিক থেকে বসবাসের অযোগ্য করে তোলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো- গাছ বা বৃক্ষ। পৃথিবীর আদিকাল থেকে বৃক্ষের বিচরণ যা প্রাণিকুলের কল্যাণেই ব্যবহার হয়ে আসছে। গাছের পরম উপকারিতার কথা কেউ কোনোক্রমেই অস্বীকার করতে পারবে না। এটাও অস্বীকার করতে পারবে না কেউ যে গাছের উপকারিতার প্রতিদান হিসেবে মনুষ্যকুল গাছপালাকেই কেটে ফেলছে, গাছের বংশবিস্তারে সাহায্য করছে না। বিবেক বোধসম্পন্ন মানুষের বিচার বুদ্ধিহীনতার কারণে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার গাছ অকারণে কাটা পড়ছে। গাছ যেন তাদের চক্ষুশূল। তাই মানুষের হাতে প্রতিনিয়ত বলির শিকার হতে হচ্ছে ছোট-বড় নানা জাতির গাছকে। প্রতিদিন কত সংখ্যক গাছ অকারণে, নির্বিচারে, অপ্রয়োজনে কাটা হচ্ছে, এ হিসাব হয়তো কারও কাছে নেই, হিসাব রাখার প্রয়োজনও মনে করছে না কেউ। শুধু দেশের করাতকলগুলোর দিকে নজর রাখলে দেখা মিলবে কীভাবে প্রাণের সঞ্চারকারী বৃক্ষকুল তার খন্ড-বিখন্ড দেহকে বিলিয়ে রেখেছে অকাতরে। মানুষের বহুমাত্রিক কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে গাছপালা। আসবাবপত্র বানানো, জ্বালানি ও ঔষধি কাজে ব্যবহারসহ নানা কাজে গাছের রয়েছে অনবদ্য ও উৎকৃষ্ট ব্যবহার। তবে গাছের পরিণত বয়সে তা কাজে লাগানো যুক্তিযুক্ত। কিন্তু মানুষ কোনো বাছ-বিচার ছাড়াই গাছকে উচ্ছেদ করে চলেছে। মানছে না গাছের স্থায়িত্বকাল। অতীতের চিত্র থেকে বিপরীত এখন। বাড়ির আঙিনায় নেই শোভাবর্ধনকারী বৃক্ষ। অতীতে যেসব বাড়িতে নানা জাতের ঔষধি গাছ ছিল, সেসব বাড়ি এখন শূন্য। যথেষ্ট জায়গা থাকতেও গাছ লাগানোর মানসিকতা ও সময় কারও নেই। গাছের প্রতি কেউই আজকাল যত্নবান না। এভাবে গাছের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ বিলুপ্ত হতে থাকলে, পৃথিবী মরুকরণের দিকে ধাবিত হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। পৃথিবীর জনসংখ্যা ও আয়তনের তুলনায় গাছপালা যৎসামান্যই বলা চলে। একটি দেশের ভৌগোলিক পরিবেশ বিবেচনায় ২৫ শতাংশ গাছপালা থাকা আবশ্যক। কোনো দেশই নেই, যা কিনা গাছে স্বয়ংসম্পন্ন। বাংলাদেশে রয়েছে মাত্র ১৬ শতাংশ গাছপালা। সবখানে চলছে গাছের প্রতি বিরুদ্ধাচারণ। এটি কোনোভাবেই পৃথিবীর পরিবেশকে অনুকূলে রাখতে সচেষ্ট নয়। নানাবিধ কারণে কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় প্রকৃতি ক্রমেই উষ্ণতর হচ্ছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রক্রিয়া বেড়ে চলেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, মরুকরণ শুরু হয়েছে, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে, যা বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন। গাছপালা কমে যাওয়ার কারণে প্রকৃতি থেকে এখন আর শীতল বাতাস বয়ই না যেন- বাতাসের সঙ্গে আগুনের তীব্রতা মেশানো। প্রকৃতির বাতাস মানুষকে শান্ত করতে পারছে না বরং ক্লান্ত করে তুলছে। কোথাও দাঁড়িয়ে পথিক বিশ্রাম নেবে, তার কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু গাছের কোনো বিকল্প নেই, সেহেতু গাছের সংখ্যা বৃদ্ধির দিকে অবশ্যই বিশ্ববাসীকে নজর দিতে হবে। নচেৎ বর্তমান পৃথিবী যেভাবে বদলে যাচ্ছে, এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে প্রাণিকুলের বিপন্নতা কেউ রুখতে পারবে না। মানুষকে বৃক্ষপ্রেমী না হলেও চলবে, তবে বৃক্ষের প্রতি নির্দয়তা, নির্মমতা ও স্বেচ্ছাচারিতা পরিহার করতে হবে। পাশাপাশি সবাইকে কৃত্রিম বন নির্মাণের দিকে গুরুত্বারোপ করতে হবে। গাছের যে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, আঙিনায় গাছ থাকলে কোনো ক্ষতি নেই, রাস্তার ধারে, নদীর পাড়ে, জমির আইলে গাছ থাকলে তা লাভজনক, এসব বোধোদয় সবার মনমগজে বদ্ধমূল করতে হবে। বর্ষাকাল হলো গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময়। এ সময় মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ রস বা পানি থাকে। ফলে গাছের চারা দ্রম্নত বৃদ্ধি হওয়ার সুযোগ পায়। বৃষ্টিপাতের কারণে বাড়তি যত্ন না নিলেও চলে। বর্ষাকালকে গাছের চারা লাগানোর গুরুত্বপূর্ণ সময় বিবেচনায়, এই সময়ে 'বৃক্ষরোপণ আন্দোলন' জোরদার করতে হবে। সবুজ অভয়ারণ্যের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পাবে, প্রকৃতি-পরিবেশ ততই জীবকুলের অনুকূলে চলে আসবে। বন্যপ্রাণীগুলো যেমন নিরাপদ আশ্রয়স্থল পাবে, মানুষ পাবে আয়ের নানা উৎস, তেমনি প্রকৃতির অনাকাঙ্ক্ষিত নানান দুর্যোগ থেকে অনায়াসে মুক্তি পাওয়া যাবে। বজ্রপাত নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার এই বৃক্ষের আধিক্যতা। নদীভাঙন রুখতে পারে নদীপাড়ের গাছপালা। তবে কেন গাছের প্রতি আমাদের ভালোবাসা এত কম হবে? ঠিকমতো গাছই যদি লাগানো না হয়, গাছের পরিচর্যাই যদি না করা হয়, তাহলে বৈচিত্র্যময় ও সুস্বাদু ফল প্রত্যাশা করা যেন বোকামি। এর জন্যও আমাদের আমদানিনির্ভর হতে হবে একদিন। সব দেশের পরিস্থিতি একই হলে ফল প্রাপ্তির বিষয়টি বেশ জটিলতর হবে। ফলের সহজ প্রাপ্তি ও গাছের অন্যান্য উপকারিতা বিবেচনায় গাছপালা লাগানোর বিষয়ে সামাজিক সংস্থা ও সরকারি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরকে এখনই সক্রিয় হতে হবে। তারা জনবল দিয়ে গাছ লাগানোর কর্মসূচি গ্রহণ না করলেও চলবে যদি সাধারণ জনগণকে সামান্যতম সচেতন করে গাছ লাগানোয় উদ্বুদ্ধ করানোর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। বিনামূল্যে গাছের চারা বিতরণ কর্মসূচি, গাছ পরিচর্যা সপ্তাহ পালন, গাছের উপকারিতা নিয়ে মিটিং-মিছিল-সভার আয়োজন করা, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গাছ লাগানোর বিষয়ে সভা-সেমিনারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের গাছ লাগাতে আগ্রহী করে তোলার মতো কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। এ কর্মসূচিগুলো প্রাথমিক ধাপের হলেও এর গুরুত্ব অর্থবহ। আমাদের এ কথাটি মাথায় রাখতে হবে, অকারণে একটি বৃক্ষকে ধ্বংস করা যেন একটি সন্তানকে ধ্বংস করার সামিল। আমাদের মানসিক পরিবর্তন বৃক্ষের জন্য হতে পারে একটি ইতিবাচক দিক। বাড়ির আঙিনার খালি জায়গায় যখন একটি গাছের চারা লাগানোর মানসিকতা আমাদের তৈরি হবে, সেদিন থেকেই প্রকৃতি যেন সবুজায়িত হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে। আমাদের গ্রাম অঞ্চলে যথেষ্ট পরিমাণ বৃক্ষরাজি রয়েছে এবং এ হার বাড়ানোর সুযোগও রয়েছে। কিন্তু শহরের পানে তাকালে মনে হয়, এ যেন মরুভূমি, আমরা বড্ড হতাশ হয়ে যাই। উঁচু উঁচু দালানের ভিড়ে গাছের কোনো অস্তিত্ব নেই। শহর বেশি দূষিত এলাকা, জনসংখ্যা তুলনামূলক বেশি বাস করে। এসব বিবেচনায় শহরে বেশি বেশি গাছপালা থাকা দরকার। অথচ দেখা যাচ্ছে এর বিপরীত ও ভয়ঙ্কর দৃশ্য। শহরায়ন ও নগরায়ণের প্রভাবেই কি বৃক্ষ নিধন করা হচ্ছে, নাকি বৃক্ষ শহরায়ন-নগরায়ণের প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ? শহরায়ন-নগরায়ণের জন্য বৃক্ষ নিধন করা হয়ে থাকে যদি, তাহলে এমন শহরায়ন-নগরায়ণ কখনই প্রত্যাশিত নয়। শহরের সামান্য ছাদ বাগান কোটি কোটি মানুষের অক্সিজেন সরবরাহে ব্যর্থ, বায়ুকে নির্মল করতে হিমশিম খাচ্ছে। বাড়ছে শ্বাসজনিত নানা রোগ। উপর্যুপরি গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যার আধিক্যতার জন্য বসতবাড়ি বানাতে গাছপালা ধ্বংস যেন নিজেকে বিপদের মুখে ফেলে দেয়ার মতোই ভয়ানক। এসব বিষয়ে গণসচেতনতা আবশ্যক। কেন গাছ কাটা হচ্ছে, প্রয়োজনে তারও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করতে হবে। বৃক্ষজাতীয় গাছ কাটা যাবে, তার পরিবর্তে গাছ লাগানোর নিশ্চয়তা দিতে হবে। প্রাসঙ্গিক কিছু বাস্তবায়নমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে রক্ষা হতে পারে বিদ্যমান পৃথিবীর অবশিষ্ট গাছপালা, বৃদ্ধি হতে পারে গাছের সংখ্যা, বাস্তবায়ন হতে পারে গাছ লাগানোর গণআন্দোলন। সর্বোপরি, মানুষজাতির চৈতন্যবোধ থেকে রক্ষা পেতে পারে ধ্বংসগামী পৃথিবী ও প্রাকৃতিক পরিবেশ। নিরাপদ হতে পারে সব জীবের আবাসস্থল। গাছের বিকল্প কিছুই হতে পারে না ভেবে আসুন আমরা গাছ লাগাই, প্রতিদিন গাছের পরিচর্যা করি এবং প্রাণিকুলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। মোহাম্মদ অংকন ঢাকা