খাবারে ভেজাল ও মনুষ্যত্বের চরম বিপর্যয়

প্রকাশ | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সোমা খাতুন মার্কেটিং বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী 'খাদ্য' বাংলার মানুষের মৌলিক অধিকার। সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অধ্যায়ে খাদ্যের নিরাপত্তার বিষয়টি স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ খাবার পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতির শীর্ষে অবস্থান করে সাংবিধানিক নীতিকে কে তোয়াক্কা করে! আমরা সেই অসভ্য, বর্বর জাতি যারা নিজেদের খাদ্যে নিজেরাই বিষ মেশাই। সামান্য কিছু মুনাফার জন্য প্রাকৃতিক নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সঠিক সময়ের আগেই মৌসুমি ফল বাজারে তোলা হয়। সময়ের আগে অপুষ্ট ফলকে পাকানোর জন্য মিশানো হচ্ছে ক্যালসিয়াম কার্বাইড নামক রাসায়নিক বিষ। সেগুলো আবার বেশিদিন সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার হচ্ছে ফরমালিন। পচা মাছ সংরক্ষণে ব্যবহার হচ্ছে ফরমালিন। এমনকি শুঁটকি মাছ ও রেহাই পায়নি। পোকারোধে শুঁটকি মাছে দেয়া হচ্ছে ক্ষতিকর ডিডিটি। শাক-সবজি উৎপাদনে ব্যবহার হচ্ছে ক্ষতিকর কীটনাশক ও রাসায়নিক সার। বিষাক্ত হাইড্রোজ ও ইউরিয়া মিশিয়ে মুড়িকে ধবধবে সাদা ও আকারে বড় করা হচ্ছে। মসলাতে মেশানো হচ্ছে রং, ভুসি, কাঠের গুঁড়া ইত্যাদি। জীবনরক্ষাকারী পানিও আজ নিরাপদ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরীক্ষাগারে ওয়াসার পানিতে মিলেছে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও মলের জীবাণু। কোম্পানিগুলো ঠিকমতো পানি পরিশুদ্ধ না করে বিশুদ্ধ পানি হিসেবে বাজারে ছাড়ছে। সেসব কোম্পানিতে আবার রয়েছে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন! তাই একটা কবিতার লাইন মনে পড়ে যায়- 'রক্ষক যদি ভক্ষক হয় কে করিবে রক্ষা ধার্মিক যদি চুরি করে কে দিবে তারে শিক্ষা।' ক্যালসিয়াম কার্বাইড বাতাসে বা জলীয় সংস্পর্শে ক্যালসিয়াম কার্বাইড থেকে অ্যাসেটিলিন নামক গ্যাস উৎপন্ন করে। তার উত্তাপেই ফল পাকে। কার্বাইড মিশ্রিত ফল খেলে বদহজম, পেটের পীড়া, পাতলা পায়খানা, অ্যাজমা, জন্ডিস, গ্যাস্টিক, শ্বাসকষ্ট, লিভার ও কিডনি নষ্ট হওয়া, ক্যান্সারের মতো মরণ ব্যাধি রোগের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া কার্বাইড মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটায় ফলে স্নায়ুতে সমস্যা হয়। ফরমালিন জীবাণু, প্যারাসাইট ও ছত্রাকের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য মাছ চাষে স্বল্প মাত্রায় ফরমালিন ব্যবহারের অনুমোদন আছে। সাধারণত পানিতে ৩৭ থেকে ৪০ শতাংশ ফরমাডিহাইড ও ০ থেকে ১৫ শতাংশ মিথানলের দ্রবণকে ফরমালিন হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু মাছ, ফলমূল, শাক-সবজি সংরক্ষণে ব্যাপক মাত্রায় ফরমালিনের ব্যবহারের ফলে আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। ফরমালিন খাবারের সঙ্গে ও নিঃশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। শরীরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে লিভারে ফরমিক এসিডে রূপান্তরিত হয় এবং এসিডোসিস উৎপন্ন করে যা রক্তের অম্স্নত্ব বৃদ্ধি করে। ফরমিক এসিড শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটায়। এমনকি যকৃত, কিডনি ধ্বংস করে দিতে পারে। ফরমালডিহাইড পাকস্থলী, ফুসফুস ও শ্বাসনালিতে ক্যান্সার সৃষ্টি করে। এটি চোখের রেটিনার কোষ ধ্বংস করে দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিতে পারে। এছাড়া খাবারে ব্যবহৃত কীটনাশক, রাসায়নিক সার ও অন্যান্য পদার্থ ব্যবহারে মানবদেহ ছোট-বড় নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যকৃত, কিডনি নষ্টের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দেহে বাসা বাঁধছে মরণব্যাধি ক্যান্সার। এসব ভেজাল খাবার মানুষের দেহে সৃষ্টি করছে ছোট-বড় মরণব্যাধি সব রোগ। আর আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম একটা অসুস্থ জাতি হিসেবে গড়ে উঠছি। এই ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে হলে যেমন দরকার শক্তিশালী প্রশাসনিক কর্মতৎপরতা তেমনি দরকার সর্বস্তরের মানুষের ব্যাপক জনসচেতনতা। মাঠপর্যায়ের কৃষক থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত সর্বস্তরে খাদ্যে ভেজালের ভয়াবহতা তুলে ধরতে হবে এবং কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারলেই কেবল এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।