রেমিট্যান্সব্যবস্থাপনা ও বাংলাদেশের উদীয়মান অর্থনীতি

শুধু পরিবারের খাবার কেনা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় হয় মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ৭৮ শতাংশ। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এসব পরিবারের বিদেশের আয় ছাড়া বিকল্প কোনো আয়ের উৎস নেই। এ ছাড়াও এসব পরিবারের সদস্যদের সঞ্চয়ের মনোভাবের অভাব ও বিনিয়োগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। তবে তাদের একটি অংশ খুব সামান্য পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করে ঘর তৈরি, জমি বা ফ্ল্যাট কিনে, যা এক ধরনের অনুৎপাদনশীল খাত হিসেবে গণ্য করা যায়।

প্রকাশ | ০৫ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অর্থনীতিতে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন ও উন্নয়ন সূচকে বিশ্বব্যাপী ঈর্ষণীয় অবস্থান প্রশংসিত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এক গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে কয়টি ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে তার একটি হলো রেমিট্যান্স বা প্রবাসীদের আয়। বর্তমানে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগুচ্ছে বাংলাদেশ; এটা এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। আর এই সমৃদ্ধির অর্থনীতি গড়তে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করছে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাখো প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স। সরকারি হিসাব অনুযায়ী সারা বিশ্বের ১৬২টি দেশে আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশিরা রয়েছে। যাদের সংখ্যা ৮৯ লাখেরও বেশি। তবে বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা এক কোটি বিশ লাখের কিছু বেশি। প্রতি বছর লাখেরও বেশি বাংলাদেশি নিজেদের আর্থিক সচ্ছলতা আনতে পরিবার-পরিজন ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে এবং সেখানের ভিন্ন পরিবেশে কষ্টকর জীবনযাপনের মাধ্যমে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে। শুধু এই নয়, বিদেশে নির্মাণ শিল্প থেকে শুরু করে কৃষি জমিসহ বিভিন্ন স্থানে নিরলস পরিশ্রম করে হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠাছে তারা। আর এই রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করছে। প্রবাসে কর্মরত নাগরিকদের স্বদেশে প্রেরিত অর্থকে রেমিট্যান্স বলে। তাদের অর্জিত অর্থের একটা অংশ তারা ব্যাংকের মাধ্যমে পরিবারের কাছে পাঠায়। এই অর্থ কেবল তাদের পরিবারের প্রয়োজনই মেটায় না, তাদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করে এবং নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের অর্থনৈতিক গতিশীলতার ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। রেমিট্যান্স আমাদের মোট অভ্যন্তরীণ আয় বা জিডিপির ৩০ ভাগ। জাতীয় অর্থনীতির তাই অন্যতম চালিকাশক্তি এই রেমিট্যান্স। মূলত বাংলাদেশের অর্থনীতি এ দেশের সূচনালগ্ন থেকেই ছিল প্রধানত কৃষিভিত্তিক। বিগত কয়েক দশকে এ অর্থনীতি ব্যবসায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবসাকে পাল্টে ফেলেছে এ দেশের শ্রমিক ভাইবোনদের বিদেশ থেকে পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বিভিন্ন জরিপে প্রবাসীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি। তারাই এ বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়ে থাকে। রেমিট্যান্স অর্জন করে অনেক দেশই এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের শীর্ষে। সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স অর্জন করে ভারতীয়রা। এ বছর মোট ছয় হাজার ৯০০ কোটি ডলার নিজ দেশে পাঠিয়েছেন। ক্রমান্বয়ে চীন, ফিলিপাইন, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, মিসর, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, (নবম স্থানে বাংলাদেশ) ইন্দোনেশিয়া। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রেমিট্যান্স আদান-প্রদানে বিশ্বের শীর্ষ ৩০টি করিডরের মধ্যে ভারত-বাংলাদেশ উলেস্নখযোগ্য অবস্থানে রয়েছে। এ করিডোর দিয়ে বছরে ৫৬০ কোটি ডলার আদান-প্রদান হয়। এ ছাড়া সৌদি আরব-বাংলাদেশ করিডোরটির অবস্থান বিশ্বে ২৩তম। দেশে উন্নয়নের এই মহাশক্তি রেমিট্যান্স যেমন দেশের জন্য প্রয়োজন ঠিক তেমনি রেমিট্যান্স অবদানকারীদের বাঁচানোও আমাদের সবার দায়িত্ব। জনশক্তি রপ্তানি খাত দেশের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা নিরসনে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখছে। বিশ্ব শ্রমবাজারে আমাদের চাহিদা বাড়াতে হবে তা না হলে বেকার সমস্যা আরো ভয়াবহতা লাভ করবে। রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার সঙ্গে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করে সরকারের শক্তিশালী ভূমিকাই জনশক্তি রপ্তানি খাতকে আরো গতিশীল করতে পারে। জনসংখ্যা রপ্তানি কিভাবে বাড়ানো যায়, বৈদেশিক কমসংস্থান মন্ত্রণালয়কে নতুন করে ভাবতে হবে এবং যুগোপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নার্স, মেকানিক, কারিগরি শিক্ষাপ্রাপ্ত ও কারিগরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনশক্তিকে কিভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেশি হারে রপ্তানি করা যায়, সেভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমরা যদি বিদেশে জনসংখ্যা রপ্তানি বৃদ্ধি করতে না পারি, তাহলে জনসংখ্যা সমস্যার বিরূপ প্রভাব পড়বে আমাদের অর্থনীতিসহ জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি সামান্য কয়েকটি দেশকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে বেশি সংখ্যক জনশক্তি রপ্তানি করা হয়। বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ওমান এবং সিঙ্গাপুরে জনশক্তি রপ্তানি করা হয়। অবশিষ্ট জনশক্তি রপ্তানি করা হয় অন্যান্য দেশে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে জনশক্তি রপ্তানি বাড়ানো গেলে এ খাতের আয় অনেকগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। আগামীতে বিশেষ করে মন্দা কাটিয়ে ওঠার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে লাখ লাখ শ্রমিকের দরকার হবে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের অনেক দেশে দক্ষ জনশক্তির আবশ্যকতা দেখা দিবে। বর্তমানে গোটা বিশ্বে নগণ্যসংখ্যক কর্মী আন্তর্জাতিক মানের চাকরি করার যোগ্যতা রাখে। ফলে আগামীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষিত জনশক্তির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। সেই চাহিদা পূরণে এখনই আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে এই জনসংখ্যা রপ্তানি নিশ্চিত বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত। শুধু নিশ্চিত বিনিয়োগ নয়, নিরাপদ বিনিয়োগ হিসাবেও জনসংখ্যা রপ্তানিকে বিবেচনা করা যায়। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে জনসংখ্যা রপ্তানির যেমন প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে, তেমনি বিদেশে কর্মরত জনশক্তির পারিশ্রমিক যাতে কাজ ও দক্ষতা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়, সে জন্যও সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে হবে। উলেস্নখ্য যে, জনসংখ্যা রপ্তানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকার যদি কূটনীতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে, তাহলে জনসংখ্যা রপ্তানির সুফল ও রেমিট্যান্স প্রবাহ আমাদের অর্থনীতির ইতিবাচক খাতের সঙ্গে একই ধারায় প্রবাহিত হবে। বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাতে রেমিট্যান্স আয় আরো বাড়ানোর জন্য হুন্ডি প্রতিরোধ করার উদ্যোগ জোরদার করতে হবে। বর্তমানে মোট উপার্জিত রেমিট্যান্সের একটা বিশেষ অংশ অনেক দেশ থেকেই হুন্ডির মাধ্যমে আমাদের দেশে আসছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণ করার ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ না থাকায় প্রবাসীদের অনেকেই হুন্ডির মাধ্যমে তাদের টাকা দেশে প্রেরণ করছে। জনশক্তি রপ্তানি খাতটি এখনো বলতে গেলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। তাদের প্রাধান্যে বিদেশ গমনকারীদের যেমন বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে তেমনি নানাভাবে প্রতারিত হতে হচ্ছে। সরকারি উদ্যোগ ও নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর আওতায় বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি করা গেলে এ সমস্যার অনেকটাই সমাধান করা সম্ভব হতো। বাংলাদেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক অবস্থায় জনশক্তি রপ্তানি খাত ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে এক মহিরুহ। কিন্তু এ খাতের সম্ভাবনাকে এখনো পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অর্থ উপার্জন যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনি সমান তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে সেই অর্থের উৎপাদনমুখী ব্যবহার এবং তা নিশ্চিত করা। পরিকল্পিতভাবে জনশক্তি রপ্তানি খাতের সমস্যা সমাধান এবং পেশাজীবী ও দক্ষ জনশক্তি বিদেশে প্রেরণের পাশাপাশি তাদের পাঠানো অর্থ সঠিকভাবে উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার করা গেলে এ খাত দেশের অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে দিতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা পৃথিবীর অনেক দেশেই কর্মী সরবরাহ করার মাধ্যমে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে তা তাদের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছে। এর ফলে অভিবাসী কর্মীদের পরিবারে যেমন ফিরে এসেছে সচ্ছলতা, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও উন্নয়নের প্রভাব পড়েছে। বলতে গেলে অভিবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স এসব দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে মূলধন জোগানোর মূল উৎসে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশে কয়েক বছরের কর্ম শেষে অর্থ ছাড়াও অভিবাসী কর্মীরা নিয়ে আসেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার আরেক মূলধন। যদিও তাদের প্রেরিত অর্থের ব্যবহার কারণে-অকারণে নানাভাবেই হয়ে যায়, কিন্তু তাদের কর্ম-অভিজ্ঞতা কতটুকু কাজে লাগাতে পারে বা লাগানো হয় সে প্রশ্নের উত্তর খুব একটা সন্তোষজনক নয়। একটি পরিকল্পিত রেমিট্যান্স ব্যবস্থাপনার অভাবে অভিবাসীদের প্রেরিত অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করা হচ্ছে না বলে আমাদের অনেকের ধারণা। এত কষ্টে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বেশির ভাগই ব্যয় হয়ে থাকে এমন সব খাতে, যেখান থেকে কোনো আর্থিক লাভ বা আয় আসে না। অর্থাৎ অনুৎপাদনশীল কাজে রেমিট্যান্সের ব্যবহার প্রাধান্য পায়। অথচ কষ্টার্জিত এই বৈদেশিক মুদ্রার পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে শুধু অভিবাসী কর্মীর পরিবারই নয়, গোটা দেশের অর্থনীতির চেহারাই বদলে ফেলা যেত। আর এটা করতে হলে প্রতি অভিবাসী কর্মীকেই তার আর্থিক ও ব্যক্তিগত অবস্থান বিবেচনা করে ব্যবস্থাপত্র দিতে হবে। ওই ব্যবস্থাপত্রে ব্যক্তিগত এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তার করণীয় নির্দিষ্ট করে বলা থাকবে। এ ছাড়া দেশের উন্নয়ন প্রবাহে একজন অভিবাসী কর্মীকে সব সময়ই কিভাবে সম্পৃক্ত রাখা যায় সে নীতিমালা প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। আর এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেই। বিশ্বের কয়েকটি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, রেমিট্যান্সপ্রাপ্ত পরিবারগুলোর আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা নতুন সম্পদ অর্জন ও স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক কর্মে বিনিয়োগ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও মোটামুটি একই রকমের চিত্র পাওয়া যায়। সত্যি বলতে কী, অভিবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স তাদের পরিবারের আয় বাড়ালেও সামগ্রিকভাবে তা দেশেরই প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করে থাকে। তবে আমরা যা-ই বলি না কেন, এই রেমিট্যান্স দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কতটুকু অবদান রাখতে পারবে তা নির্ভর করে দেশের অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা, কর্মক্ষমতা এবং সার্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশের ওপর। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে যে অবদান রাখার কথা প্রকৃতপক্ষে তা রাখতে পারছে না। কেননা, প্রবাসী বাংলাদেশিরা যে পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন তার বেশিরভাগ অর্থই খরচ করতে হচ্ছে অল্প কিছু বিদেশিদের পেছনে। দেশে টেকনিক্যাল পারসন না থাকায় এ লোকসান গুনতে হচ্ছে। সরকারের উচিত হবে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে দেশের টাকা দেশেই রাখা। তাহলে প্রবাসীদের অর্থে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নতি করা সম্ভব হবে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। যদি সে অর্থ দেশের উন্নতিতে কাজে না লাগে। যে পরিমাণ অর্থ পাঠাবে তার অধিকাংশ নিয়ে যাবে অল্প কিছু বিদেশিরা। ফলে হতাশ হওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনশক্তি উন্নয়ন বু্যরোর (বিএমইটি) তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরে প্রায় ১৫ বিলিয়ন (এক হাজার ৫০০ কোটি) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। বাংলাদেশের জিডিপিতে ৩০ শতাংশ অবদান রাখে প্রবাসীদের পাঠানো এই বিদেশি মুদ্রা। এত বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স দিয়ে দেশের কোনো কল্যাণ সাধন হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে রেমিট্যান্স বা বৈদেশিক মুদ্রা সুষ্ঠু ও সঠিক ব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রণের অভাবে লাভবান হচ্ছে অন্য বলয়ের মানুষরা। ফলে বাংলাদেশের উন্নয়ন ভারতের বেড়াজালে আটকা পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে বিভিন্ন সমীক্ষা পরিচালিত হয়েছে। প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে যে, রেমিট্যান্সের আয়ে উৎপাদনমূলক খাতে বিনিয়োগ খুব কম হচ্ছে। সমীক্ষা মতে, শুধু পরিবারের খাবার কেনা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় হয় মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ৭৮ শতাংশ। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এসব পরিবারের বিদেশের আয় ছাড়া বিকল্প কোনো আয়ের উৎস নেই। এ ছাড়াও এসব পরিবারের সদস্যদের সঞ্চয়ের মনোভাবের অভাব ও বিনিয়োগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। তবে তাদের একটি অংশ খুব সামান্য পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করে ঘর তৈরি, জমি বা ফ্ল্যাট কিনে, যা এক ধরনের অনুৎপাদনশীল খাত হিসেবে গণ্য করা যায়। সরকার ইতোমধ্যে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক গঠন করে বিদেশ যাওয়ার ঋণ ছাড়াও ফেরত প্রবাসীদের জন্য রি-ইন্ট্রিগ্রেশন ঋণ চালু করেছে। ফলে চাকরি থেকে ফিরে আসার পর তারা চাইলে উপযোগী আয়বৃদ্ধিমূলক কাজে পুঁজির জোগান পাবেন। তা ছাড়া 'ওয়েজ আর্নারস বন্ড' চালুর মাধ্যমে সরকারিভাবে প্রবাসীদের সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। সরকারি এসব উদ্যোগ অবশ্যই ভালো; তবে এসবের কলেবর বৃদ্ধি করতে হবে এবং সহজ শর্তে সেবা দেয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সরকারের আরেকটি উদ্যোগ প্রশংসনীয় : সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের প্রতিবছর পুরস্কার দিয়ে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হচ্ছে। এ ধারা চালু থাকলে প্রবাসীরা প্রতিযোগিতামূলকভাবে নিয়মিত রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী হবেন। তবে রেমিট্যান্সের আয়ের বিপরীতে বিনিয়োগে আগ্রহী প্রবাসীদের আরও বেশি পরিমাণে নতুন নতুন সরকারি সুযোগসুবিধা দিলে তারা উদ্বুদ্ধ হবেন। আজকাল অভিবাসী কর্মী প্রেরণকারী অনেক দেশই উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য বিদেশি ঋণ বা অনুদান গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু রেমিট্যান্স থেকে প্রাপ্ত অর্থ বিদেশি কোনো ঋণ, অনুদান বা আর্থিক সাহায্যের বিকল্প হিসেবে মনে করা ঠিক হবে না। তবে, রেমিট্যান্স বিদেশের ওপর দেশের আর্থিক নির্ভরশীলতা অনেক ক্ষেত্রেই কমাতে পারে, যদি যথাযথ পরিকল্পনা নেয়া যায়। যেহেতু এ খাতে প্রাপ্ত অর্থ সম্পূর্ণটাই ব্যক্তিগত, তাই এ অর্থের ব্যবহার হতে হবে আর্থিক লাভজনক কাজকর্মে বা প্রতিষ্ঠানে। আর এর কর্তৃত্ব থাকবে যাদের রেমিট্যান্স সেখানে বিনিয়োগ করা হয়েছে তাদের। এ ক্ষেত্রে সরকার পরিকল্পনা তৈরি করে পথ প্রদর্শকের কাজ করবে, অনুপ্রেরণা জোগাবে; পথ হাঁটতে হবে বিনিয়োগকারীকেই। রেমিট্যান্সের অর্থ কিভাবে ব্যবহার করা হবে তা সম্পূর্ণভাবে রেমিট্যান্স প্রেরক বা প্রাপকের এখতিয়ার। বাস্তবে তা-ই হয়ে আসছে। কিন্তু এই অর্থ যদি সরকারের ব্যবস্থাপনায় বা তত্ত্বাবধানে অধিকতর লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা যায়, তাহলে অভিবাসীরা এ তহবিলে চাঁদা প্রদান করতে অবশ্যই উৎসাহী হবেন। আর এ বিনিয়োগ শুধু রেমিট্যান্সপ্রাপ্ত পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থারই উন্নতি ঘটাবে না বরং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করবে। তবে এ বিষয়ে রেমিট্যান্সপ্রাপ্ত পরিবারগুলোকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে উদ্দীপনামূলক সুযোগ-সুবিধা নির্দিষ্ট করে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করার দরকার হবে। প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি প্রবাসে কর্মরত রয়েছেন এবং প্রতিদিনই কাজ নিয়ে নতুন নতুন কর্মী বিদেশে যাচ্ছেন। কর্ম শেষে আবার অনেকে ফিরে আসছেন। আসা-যাওয়ার প্রক্রিয়ায় বিদেশে কর্মরত আমাদের অভিবাসীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ অবস্থা বিবেচনায় রেখে সব প্রবাসী কর্মী যদি চাঁদা দিয়ে জাতীয় তহবিল গঠন করে তাহলে ওই অর্থ দিয়ে দেশের উন্নয়নমূলক বড় বড় প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করা যেতে পারে, বিদেশি ঋণের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে না বা নানা শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ হতেও হবে না। এতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নই শুধু ঘটবে না, তা আমাদের একটি আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাসম্পন্ন জাতিতে পরিণত করবে। এটি সরকারের দায়িত্ব ও করণীয় বলে গণ্য হবে। ফলে প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থের সঠিক ও সদ্বব্যবহার হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে। ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ: লেখক, কলামিস্ট ও গবেষক