দুর্গতিনাশিনী দুর্গা তারাপদ আচার্য্য

জীবনে অশুভ অসুর শক্তির বিনাশ করে শুভ সুর শক্তির প্রতিষ্ঠা দুর্গাপূজার শাশ্বত দর্শন। দেবী মহিষাসুরমর্দিনী এবং সেই কারণেই শিরে শিবধারিণী। মহিষাসুরকে যদি বিনাশ করা যায় তবে সর্বোপরি শিরে শিবকে তথা কল্যাণ বা মঙ্গলকে ধারণ করা সম্ভব হয়। দুর্গাকাঠামোতেও দেখা যায় মহিষাসুর দেবীর পদতলে বিমর্দিত, দেবী রণরঙ্গিনী আর শিব দেবীর মস্তকোপরি অধিষ্ঠিত- এই কাঠামো উন্নত জীবনতত্ত্ব নির্দেশক।

প্রকাশ | ০৮ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ভগবানকে মাতৃভাবে আরাধনা হিন্দুধর্মের একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। এ আরাধনার বিরামহীন ধারা চলে আসছে বৈদিক যুগ থেকে। শক্তি-সাধনার অপ্রতিহত এ ধারা বৈদিক যুগ থেকে প্রবাহিত হয়ে বিবর্তিত আকারে ক্রমে পৌরাণিক এবং তৎপরবর্তী যুগে আরও বিস্তার লাভ করে। সেইসঙ্গে ব্যাপকভাবে সাধনার অবলম্বনরূপে অগণিত মানুষকে পরাশক্তি মহামায়ার আরাধনায় উদ্বুদ্ধ করে এবং আজো করে আসছে। বৈদিক যুগের ঋষিকন্যা বাক্‌ থেকে শুরু করে পরবর্তী যুগসমূহের বিভিন্ন শক্তিসাধকদের জীবন-ইতিহাসই এই ধারার বিরামহীনতা এবং গতিশীলতা প্রমাণ করে। সেই ধারাবাহিকতার আজ সবচেয়ে বড় পূজা হলো দেবী দুর্গার আরাধনা করা। যিনি নিখিল বিশ্বকে ধরে আছেন বা এই জগৎকে ধারণ করে আছেন। যিনি মহাযোগবলে জগৎকে ধরে রয়েছেন, তিনি বিশ্বের ধাত্রীমাতা। বিশ্ববাসীর তিনি রক্ষয়িত্রী, পালয়িত্রী। ধাত্রীমাতারূপে তিনি জগৎকে ধারণ ও পালন করছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন- 'জগৎকে ধারণ করে আছেন। না হলে জগৎ যে পড়ে যাবে।' তিনি যোগিনী, যোগের দ্বারা ধরে রয়েছেন জগৎকে। হিন্দু শাস্ত্রের অসংখ্য শাস্ত্রগ্রন্থের মধ্যে 'দেবীমাহাত্ম্য' অন্যতম। গীতা যেমন মহাভারতের একটি অংশ 'দেবীমাহাত্ম্য'ও তেমনি মহর্ষি বেদব্যাস রচিত মার্কন্ডেয় পুরাণের একটি অংশ। মার্কন্ডেয় পুরাণে ৮১ থেকে ৯৩ এই তেরটি অধ্যায় নিয়ে 'দেবীমাহাত্ম্য'। এ গ্রন্থে দেবী মহামায়ার লীলামাহাত্ম্য বর্ণিত ও কীর্তিত হয়েছে। 'দেবীমাহাত্ম্য' নামেই তার ইঙ্গিত রয়েছে। মার্কন্ডেয় পুরাণের 'দেবীমাহাত্ম্য' অংশের মন্ত্রসংখ্যা সাতশ'। তাই গ্রন্থটিকে 'সপ্তশতী'ও বলা হয়। তবে 'চন্ডী'ই গ্রন্থের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ এবং সুপ্রচলিত নাম। চন্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী- দুর্গ নামক অসুরকে বধ করায় মায়ের নাম হয়েছে দুর্গা। দুর্গ অসুরের কাজ ছিল জীবকে দুর্গতিতে ফেলা। দুর্গকে বধ করে যিনি স্বর্গ বিতাড়িত দেবগণকে হৃতরাজ্য ফিরিয়ে দেন এবং জীবজগৎকে দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন তিনি মা দুর্গা। দুর্গা শব্দটি বিভিন্ন অর্থের দ্যোতক। যিনি দুর্জ্ঞেয়া, অর্থাৎ যার তত্ত্ব দুরধিগম্য- তিনিই দুর্গা। দুর্গতি হতে ত্রাণ করেন বলেই দেবীর নাম হয়েছে দুর্গা। রাজ্যভ্রষ্ট রাজা যুধিষ্টির বিপদ হতে মুক্তিলাভ করার জন্য মা দুর্গার আরাধনা করেছিলেন বলে মহাভারতের বিরাট পর্বের ষষ্ঠ্যাধায়ে উলেস্নখ আছে। দেবীর স্তোত্রে আছে- 'দুর্গাৎ তারয়সে দুর্গে তৎত্বং দুর্গা স্মৃতি জনৈঃ।' 'দ' অক্ষরটি দৈত্যনাশক, 'উ-কার' বিঘ্ননাশক, 'রেফ্‌' রোগনাশক, 'গ' অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রম্ননাশক। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ, ভয় ও শত্রম্নর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। দেবী দুর্গা মহিষমর্দিনী, শূলিনী, পার্বতী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা, বৈষ্ণবী, কৌমারি, বাহারী, চন্ডী, লক্ষ্ণী, উমা, হৈমবতী, কমলা, শিবাণী, যোগনিদ্রা প্রভৃতি নামে ও রূপে ধরাধামে মায়ের পূজা হয়ে থাকে। বেদ-উপনিষদে বর্ণিত পরব্রহ্ম এবং তন্ত্রেও পরাশক্তি স্বরূপত অভেদ, যেন টাকার এপিঠ-ওপিঠ। শ্রীরামকৃষ্ণের কথায়, 'ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ। অগ্নি আর তার দাহিকা শক্তি যেমন পৃথক নয়, তেমনি।' আশ্বিনের শুক্লাষষ্ঠী থেকে শুক্লানবমী পর্যন্ত দেবী দুর্গার পূজা হয়ে থাকে। দেবীর সঙ্গে যুক্ত হয় আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্যাবিজ্ঞানদায়িনী দেবী সরস্বতী, সর্বৈশ্বর্য প্রদায়িনী দেবীলক্ষ্ণী, সর্বসিদ্ধিদাতা গণেশ, বলরূপী কার্তিক এবং ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন ত্যাগ ও বৈরাগ্যের মূর্তবিগ্রহ দেবাদিদেব মহাদেব। এ যেন একই সঙ্গে শক্তি, জ্ঞান, ঐশ্বর্য, সিদ্ধি, বল ও বৈরাগ্যের এক অপূর্ব সমাবেশ। দুর্গাই সমস্ত শক্তির আধার, নিখিল দেবগণের শক্তিসমূহের ঘনীভূত মূর্তি- 'নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যা।' মা দুর্গা স্নেহময়ী জননী। তার নয়ন থেকে করুণাধারা সতত বর্ষিত হচ্ছে- 'মায়ের স্নেহ-চক্ষে প্রেম-বক্ষে অমিয় ঝরে'। যুদ্ধে যখন তিনি অতি ভীষণা তখনো তার আঁখি করুণায় ঢল ঢল। 'চিত্তে কৃপা সমরনিষ্ঠুরতা'- হৃদয়ে মুক্তিপ্রদ কৃপা এবং যুদ্ধে মৃতু্যপ্রদ কঠোরতা, মায়ের মধ্যে এই দুই ভাবের অপূর্ব সমন্বয় পরিলক্ষিত হয়। শ্রীশ্রীচন্ডীতে বলা হয়েছে- 'ত্বয়ৈব ধার্যতে সর্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্রতে জগৎ'। অর্থাৎ তিনিই এই জগতের সবকিছুর ধারণের মূল, আবার জীবজগৎ সৃজনের মূলেও তিনিই। সৃষ্টিকার্যের তিনি অধিষ্ঠাত্রী এবং পালনকালে তিনি রক্ষাকর্ত্রী। শাস্ত্রে আরো বলা হয়েছে- 'বিশ্বেশ্বরী ত্বং পরিপাসি বিশ্বং বিশ্বত্মিকা ত্বং ধারয়সীতি বিশ্বম্‌।' -অর্থাৎ তুমিই এই বিশ্বের ঈশ্বরী, তুমিই জগৎস্বরূপিণী এবং তুমিই জগতের ধারয়িত্রী। জীবনে অশুভ অসুর শক্তির বিনাশ করে শুভ সুর শক্তির প্রতিষ্ঠা দুর্গাপূজার শাশ্বত দর্শন। দেবী মহিষাসুরমর্দিনী এবং সেই কারণেই শিরে শিবধারিণী। মহিষাসুরকে যদি বিনাশ করা যায় তবে সর্বোপরি শিরে শিবকে তথা কল্যাণ বা মঙ্গলকে ধারণ করা সম্ভব হয়। দুর্গাকাঠামোতেও দেখা যায় মহিষাসুর দেবীর পদতলে বিমর্দিত, দেবী রণরঙ্গিনী আর শিব দেবীর মস্তকোপরি অধিষ্ঠিত- এই কাঠামো উন্নত জীবনতত্ত্ব নির্দেশক। জীবন মানেই সংগ্রাম। সংগ্রামে বিজয় প্রার্থিত। বিজয় লাভ করার জন্যই সবাই সংগ্রাম করে। পরাজয় লাভ করার জন্য কেউ সংগ্রাম করে না। তবুতো পরাজয় ঘটে। কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে কোনো ত্রম্নটির জন্যই পরাজয় ঘটেছে। জীবনে সব ত্রম্নটির মধ্যে বড় ত্রম্নটি হচ্ছে ভগবৎ বিরোধিতা। মানুষের জীবনে ভগবৎ আরাধনা ও ভগবৎ সান্নিধ্য থাকলে জীবন হয় নির্মল আনন্দময়। জীবনে কল্যাণই কাম্য। কিন্তু কল্যাণ কীভাবে আসবে তা অনেকেই জানে না। অকল্যাণকে, অশুভকে ও অসুরকে পরাজিত করতে পারলেই কল্যাণ এবং শুভর দেখা মেলে। তারাপদ আচার্য্য: সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ