আবরার হত্যা ও চলমান রাজনীতি

হত্যাকারীরাও পিতামাতার স্বপ্নের সন্তান ছিল। এই ঘটনায় তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। বিপথগামিতা ও পরস্পর বিদ্বেষ সুস্থ রাজনীতির পরিচায়ক নয়। আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।

প্রকাশ | ১৫ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

সাইফুজ্জামান
ডেঙ্গু প্রতিরোধ সেলে কাজ করতে গিয়ে দুঃসংবাদ পাই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে মারধর করে হত্যা করা হয়েছে। শরীর ভালো নেই সঙ্গে মনও। কী এক অস্থির সময়ের মধ্যদিয়ে আমরা যাচ্ছি। মানবিকতা উধাও হয়ে গেছে। অন্ধ আনুগত্য ও বিপরীত স্রোতে চলা যেন এক নিত্য নেশা। আমাদের দেশে পরমতসহিষ্ণুতা নেই। গণতন্ত্রে অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করা স্বাভাবিক প্রবণতা। কিন্তু বেপরোয়া তরুণ রাজনীতিক থেকে শুরু করে প্রাপ্ত বয়স্ক পর্যন্ত আমিত্ব আর আমার দল শ্রেষ্ঠ এই মন্ত্রে উজ্জীবিত। দৈনিক সমকাল পত্রিকায় ৯ অক্টোবর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে একদল সন্ত্রাসী বেধড়ক পেটাতে পেটাতে প্রশ্ন করে 'তুই শিবির কর্মী। স্বীকার কর। নইলে তোর রক্ষা নেই। হলে কে কে শিবিরের সঙ্গে জড়িত তোকে বলতে হবে। শিবিরের সঙ্গে জড়িত নেই। এই স্বীকারোক্তির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে নির্যাতন। রোববার রাত ৮টা থেকে ১টা পর্যন্ত কিল-ঘুষি ও লাঠি দিয়ে আবরারকে পেটানো হয়। একটি সংগঠনের ছাত্রনেতা ও কর্মীরা আবরার ফাহাদকে বেধড়ক পিটিয়ে হত্যা করে। এদের মধ্যে কয়েকজন মদ্যপ অবস্থায় ছিল বলে জানা যায়। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ২০১১ ও ২০০৫ কক্ষে আবরার ফাহাদকে নির্যাতন করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া তার এক স্ট্যাটাস কেন্দ্র করে ক্ষুব্ধ হয় সংগঠনের নেতাকর্মীরা। পত্রপত্রিকায় নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত তাদের নাম-ধাম-পরিচয় উঠে এসেছে। আবরার ফাহাদ ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিল '৪৭-এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্র বন্দর ছিল না। তৎকালিন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিছিল। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মোংলাবন্দর খুলে দেয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আজ ইন্ডিয়াকে সে মোংলাবন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে। ২. কাবেরী নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েক বছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজাই অন্য রাজাকে পানি দিতে চায় না। সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড়লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব। কয়েকবছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষা করার দোহাই দিয়ে উত্তর ভারত কয়লা, পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব। এই ঘটনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। গ্রাম-গঞ্জ মহলস্না, থানা, মহকুমা জেলাপর্যায় থেকে ঢাকায় সেরা বিদ্যাপীঠে অসংখ্য ছাত্রছাত্রীরা পড়তে আসে তারা নতুনভাবে ভাবতে শুরু করবে। যেখানে জীবনের নিরাপত্তা নেই, সেখানে উচ্চশিক্ষা বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য। স্বাধীনতার এত বছর পর মত প্রদানের স্বাধীনতা কীভাবে হরণ হয়। সচেতন মহলকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনামলে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। এনএসএফের গুন্ডাবাহিনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দোর্দন্ড দাপট বজায় রাখলো ছাত্রলীগসহ অন্য সংগঠন গণতন্ত্রচর্চা ও স্বাধীনতা আদায়ে জনসভা, বিক্ষোভ, অবরোধ, ধর্মঘট সফলভাবে পালন করে। স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনে ছাত্রনেতারা ছিল প্রধান চালিকাশক্তি। এসব নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না, তারা হয়ে উঠেছিলেন জনগণের নয়নমণি। পরে ছাত্রনেতারা জাতীয় রাজনীতিতে অভিষিক্ত হন। আজ অনেকেই জাতীয় রাজনীতির কান্ডারি। আবরার ফাহাদ নামের মেধাবী ছাত্রের অকাল মৃতু্য অপূরণীয় হিসেবে বিবেচিত হবে। আমরা চাই এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। পথভ্রষ্ট সন্ত্রাসীদের জন্য অনুকম্পা নয়। বরং তাদের বিবেক জাগ্রত হোক- এটুকুই প্রত্যাশা। যে সংগঠনের বুয়েট শাখা এ হত্যাকান্ডে জড়িত সে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা নিন্দা জানিয়েছে। ১১ জন নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বুয়েটে এর আগেও হত্যাকান্ড সংঘঠিত হয়েছে। শিক্ষকসমাজ ও ছাত্রনেতাদের দেখভাল না থাকায় ভেতরে ভেতরে সন্ত্রাসীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন না থাকলে সমাজে বিষবৃক্ষের জন্ম হয়। কীভাবে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের একটি হল টর্চার সেলে পরিণত হলো শেরে-ই-বাংলা হলের প্রভোস্টসহ পরিচালনায় যারা জড়িত তাদের উদাসীনতা কিংবা দায়িত্বহীনতার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যাবে না। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কী দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারবেন? মেধাবী ছাত্রটির মৃতু্যর পর না এসে তিনি কী উদাহরণ স্থাপন করলেন। ইতোমধ্যে জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। দুর্নীতিবাজদের তিনি আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে দুই দলের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে এর আগেও নিরীহ এক ছাত্রকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণ দিতে হয়েছিল। স্বাধীনতা-উত্তর ৭ খুনের ঘটনা ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর তার হত্যাকারী মুক্ত হয়ে যায়। আশির দশক থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত অনেক তাজা তরুণের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে সন্ত্রাসীরা। নব্বইপরবর্তী ছাত্ররাজনীতি সুস্থির ছিল। যেসব হত্যাকান্ড ঘটেছে তার বিচারহীনতা আন্তঃকোন্দলকে উৎসাহিত করেছে।। আজ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায়। অনেক দায়বদ্ধতা রয়েছে এ সরকারের। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যতিক্রম ছিল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। হঠাৎ অস্ত্রের মহড়া এখানে কম ঘটেছে। হত্যাকারীরাও পিতামাতার স্বপ্নের সন্তান ছিল। এই ঘটনায় তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। বিপথগামিতা ও পরস্পর বিদ্বেষ সুস্থ রাজনীতির পরিচায়ক নয়। আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। \হগৌরবময় ছাত্র রাজনীতি নতুন রাষ্ট্র ও পতাকার জন্ম দিয়েছে। ছাত্র রাজনীতিকে ইতিবাচক ধারায় আজ পরিচালিত করতে হবে। মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে বাদ দেয়া সহজ সমাধান নয়। ছাত্র রাজনীতিকে যারা বিষাক্ত করছে তাদের নির্বাসনের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতির গৌরবদীপ্ত অধ্যায় শুরু হতে পারে। সাইফুজ্জামান: কলাম লেখক, গবেষক